logo
আপডেট : ১৮ নভেম্বর, ২০২৪ ১০:৩১
প্রয়াণ দিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলি
অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান ছিলেন একজন শ্রেষ্ঠ বাঙালি
গোলাম আশরাফ খান উজ্জ্বল

অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান ছিলেন একজন শ্রেষ্ঠ বাঙালি

আজ অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের প্রয়াণ দিবস। দেশের একজন শ্রেষ্ঠবাঙ্গালি হিসেবে তার এই প্রয়াণ দিবসে জানাই শ্রদ্ধাঞ্জলি। অতীশ দীপঙ্কর বার্মা, নেপাল ও চীনের তিব্বত গিয়ে বৌদ্ধধর্ম প্রচার করেন। আর অতীশ দীপঙ্করের সমাধী সৌধও চীনের তিব্বতে।

অতীশ দীপঙ্করের জন্ম বাংলার অন্যতম প্রাচীন রাজধানী বিক্রমপুরে। বিক্রমপুর আজ মুন্সীগঞ্জ জেলা নামে পরিচিত। মুন্সীগঞ্জের সদর উপজেলার বজ্রযোগিনী গ্রামে বৌদ্ধধর্মের পরম পণ্ডিত শ্রীজ্ঞান দীপঙ্কর ৯৮০ সালে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা কল্যাণশ্রী এবং মাতা প্রভাবতী দেবী। তার বাল্যনাম ছিল চন্দ্রগর্ভ। মায়ের নিকট এবং স্থানীয় বজ্রাসন বিহারে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে তিনি বিখ্যাত বৌদ্ধ গুরু জেতারির নিকট বৌদ্ধধর্ম ও শাস্ত্রে উচ্চশিক্ষা লাভ করেন। এ সময় তিনি সংসারের প্রতি বিরাগবশত গার্হস্থ্যজীবন ত্যাগ করে ধর্মীয় জ্ঞানার্জনের সঙ্কল্প করেন। এ উদ্দেশ্যে তিনি পশ্চিম ভারতের কৃষ্ণগিরি বিহারে গিয়ে রাহুল গুপ্তের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং বৌদ্ধশাস্ত্রের আধ্যাত্মিক গুহ্যবিদ্যায় শিক্ষালাভ করে ‘গুহ্যজ্ঞানবজ্র’ উপাধিতে ভূষিত হন। মগধের ওদন্তপুরী বিহারে মহাসাংঘিক আচার্য শীলরক্ষিতের নিকট দীক্ষা গ্রহণের পর তার নতুন নামকরণ হয় ‘দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান’। একত্রিশ বছর বয়সে তিনি আচার্য ধর্মরক্ষিত কর্তৃক সর্বশ্রেষ্ঠ ভিক্ষুদের শ্রেণিভুক্ত হন। পরে দীপঙ্কর মগধের তৎকালীন শ্রেষ্ঠ আচার্যদের নিকট কিছুকাল শিক্ষালাভ করে শূন্য থেকে জগতের উৎপত্তি এ তত্ত্ব (শূন্যবাদ) প্রচার করেন। ১২ বছর বৌদ্ধশাস্ত্র অধ্যায়ন করে গভীর পাণ্ডিত্য অর্জন শেষে ৪৪ বছর বয়সে তিনি ভারতবর্ষে প্রত্যাবর্তন করেন। ঢাকার অদূরে বিক্রমপুরে অতীশ দীপষ্করের জন্মস্থান এখনো ‘নাস্তিক পণ্ডিতের ভিটা’ নামে পরিচিত। অতীশ দীপঙ্করের নামে ঢাকায় একটি বেসরকারি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় আছে।

বাংলাদেশে ও চীনে অতীশ দীপঙ্করের জন্ম সাল নিয়ে ঐতিহাসিকরা দুভাগে বিভক্ত। একদল ঐতিহাসিকের মতে, অতীশ দীপঙ্কর ৯৮০ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি। অন্য দলের মতামত হলো ৯৮২ সালে। তারা জন্ম তারিখ নির্ধারণ করতে পারেনি। ২৪ ফেব্রুয়ারিও নির্ভরযোগ্য বা প্রমাণিত তারিখ নয়। বিক্রমপুরের ইতিহাস হতে জানা যায়- বিক্রমপুরস্থ বজ্রযোগিনী গ্রামে বৌদ্ধ মহাতান্ত্রিক দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান অতীশ জন্মগ্রহণ করেন। অতীশ দীপঙ্করের এই প্রতিকৃতি তিব্বতের কদম্পা মঠ থেকে পাওয়া যা ক্রনস সংগ্রহশালা ১৯৩৩ সালে নিউ ইয়র্কের মেট্রোপলিটান মিউজিয়াম আর্টকে উপহার দেয়।

দুই হাজার চার সালে বিবিসি বাংলা একটি ‘শ্রোতা জরিপ’- এর আয়োজন করে। বিষয়টি ছিল - সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি কে? তিরিশ দিনের ওপর চালানো জরিপে শ্রোতাদের ভোটে নির্বাচিত শ্রেষ্ঠ ২০ জনের জীবন নিয়ে বিবিসি বাংলায় বেতার অনুষ্ঠান পরিবেশিত হয় ২০০৪-এর ২৬ মার্চ থেকে ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত। বিবিসি বাংলার সেই জরিপে শ্রোতাদের ভোটে শ্রেষ্ঠ বাঙালির তালিকায় ১৮তম স্থানে আসেন অতীশ দীপঙ্কর। আজ তার জীবন-কথা।

দার্শনিক অতীশ দীপঙ্কর, তার জ্ঞান ও প্রজ্ঞা দিয়ে মানুষের মন জয় করেছিলেন- তিব্বত থেকে মালয়েশিয়া পর্যন্ত। তিনি জন্মেছিলেন প্রায় এক হাজার ৪০ বছর আগে আজকের বাংলাদেশের মুন্সীগঞ্জ জেলার বজ্রযোগিনী গ্রামে। বাবা ছিলেন গৌড়ীয় রাজ পরিবারের রাজা কল্যাণশ্রী, মা প্রভাবতী।

বৌদ্ধ ধর্ম ও দর্শন চর্চ্চা এবং প্রচার প্রসারের ক্ষেত্রে পূর্ব এশিয়া জুড়ে স্মরণীয় অতীশ দীপঙ্কর। তার প্রভাব আজও বিরাজ করছে পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ মানুষের মনে। পনের বছর আগে বিবিসি বাংলার এই অনুষ্ঠান তৈরির সময় ভিক্ষু শুদ্ধানন্দ মহাথেরো ছিলেন ঢাকার বৌদ্ধ মহাবিহারের আচার্য।পাল রাজারা মগধে রাজত্ব করতেন। আর মগধের দক্ষিণ-পশ্চিমে নর্মদাতীরে ছিল চেদি রাজ্য, যেখানে রাজত্ব করতেন কলচুরি রাজ লক্ষ্মীকর্ণ। তার রাজধানীর নাম ছিল ত্রিপুরী। নয়পাল আর লক্ষ্মীকর্ণের মধ্যে বংশানুক্রমিক শত্রুতা ছিল। লক্ষ্মীকর্ণের পিতা গাঙ্গেয়দেব এবং নয়পালের পিতা মহীপাল অক্লান্তভাবে সারা জীবন পরস্পর যুদ্ধ করেছিলেন।

‘অতীশ যেখানেই গেছেন, সেখানে সাধারণ মানুষের কষ্ট দেখেছেন। যেখানে তিনি দেখেছেন চাষবাসের জন্য সুবিধা আছে, সেখানে তিনি একজন এনজিনিয়ারের মতো বাঁধ দিয়ে ফসল ফলানোর জন্য মানুষকে একত্রিত করেছেন। কোথাও রোগ, শোক, মহামারি দেখা দিয়েছে- অতীশ সেখানে ছুটে গেছেন। নিজে তো তিনি ডাক্তারিশাস্ত্র জানতেন। মানুষের তিনি সেবা করেছেন, একত্রিত হয়ে যেখানে কাজ করা দরকার, সেখানে তিনি মানুষকে জোটবদ্ধ করেছেন।’

এর পর ১৫ বছর তিনি ভারতের ওদন্তপুরী, সোমপুরী এবং বিশেষ করে বিক্রমশীল বিহারে অধ্যাপনা ও পরিচালনার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। তিব্বতের রাজার আমন্ত্রণে ও একান্ত আগ্রহে ৫৮ বছর বয়সে বিক্রমশীল বিহার থেকে তিনি তিব্বতে যান। সেখানে মহাযান বৌদ্ধধর্ম প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করেন। দুই শতাধিক গ্রন্থ রচনা, অনুবাদ ও সম্পাদনা করে তিনি বিপুল খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তিব্বতবাসীরা শ্রেষ্ঠ গুরু হিসাবে গৌতম বুদ্ধের পরেই তাকে সম্মান ও পূজা করেন। সেখানে তাকে ‘জোবো ছেনপো’ বা মহাপ্রভূরূপে মান্য করা হয়। বাংলাদেশে তিনি অতীত বাংলার একজন শ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসাবে খ্যাত। তিনি তিব্বতের ধর্ম, ইতিহাস, রাজকাহিনী, জীবনীগ্রন্থ, স্তোত্রনামা ও সর্বোপরি ‘তাঞ্জুর’ নামে বিশাল শাস্ত্রগ্রস্থ সষ্কলন করেন। অতীত তিব্বতের কোনো। আলোচনাই তাকে ছাড়া সম্ভব নয়। তিব্বতের লামারা এখনো সেখানকার রাষ্ট্রীয় ও ধর্মীয় ক্ষমতার প্রায় একচ্ছত্র অধিপতি। এই লামারা নিজেদেরকে অতীরে শিষ্য ও উত্তরাধিকারী বলে পরিচয় দিয়ে থাকেন। বর্তমানে ত্বিবত চীনের অধীন হলেও অতীশ দীপষ্কর শ্রীজ্ঞানের প্রভাব এখনো সেখানকার ধর্ম- সংস্কৃতিতে বিদ্যমান। অতীশের রচনা, যা তার মাতৃভাষা বাংলা কিংবা সংস্কৃত ভাষায় ছিল, তার সবই এখন অবলুপ্ত। কিন্তুু তার প্রায় সব গ্রন্থের অনুবাদ আজও তিব্বতে রক্ষিত আছে। তিব্বতী মহাগ্রন্থ ‘তাঞ্জুরে’ সংরক্ষিত আছে দীপষ্কর শ্রীজ্ঞানের নিজের করা ৭৯টি গ্রন্থের তিব্বতী অনুবাদ। এছাড়া তাঞ্জুরে রক্ষিত তার সেসব গ্রন্থের অনুবাদকর্মে তিনি অংশগ্রহণ করেননি তার সংখ্যা ৩৮টি। ১৩ বছর তিব্বতে বাস করে ৭২ বছর বয়সে অর্থাৎ ১০৫৪ খ্রিস্টাব্দে লাসার কাছে ঞেথাং বিহারে পণ্ডিত, ধর্মগুরু, কবি, দার্শনিক, চিকিৎসক, পরিকল্পনাবিদ অতীশ দীপষ্কর শ্রীজ্ঞান পরলোকগমন করেন। ১৯৭৮ সালের ২৮ জুন পণ্ডিত দীপষ্কর শ্রীজ্ঞানের পবিত্র দেহভস্থ চীন থেকে ঢাকার ধর্মরাজিক বৌদ্ধ বিহারে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় আনয়ন ও সংরক্ষণ করা হয়।

দীপঙ্করের সমাধী মন্দিরটি জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে। এটি সংস্কারের প্রয়োজন। বাংলাদেশে দীপঙ্করের নামে রাজধানী ঢাকায় একটি সড়ক আছে। আর আছে একটি স্মৃতি সংসদ। তাও ঢাকা কেন্দ্রিক। দীপঙ্করের গ্রামের বাড়ি মুন্সীগঞ্জ সদরের বজ্রযোগিনীতে একটি স্মৃতিস্তম্ভ ছাড়া আর কিছুই নেই। স্থানীয় লোকজন দাবি করেন, এখানে অতীশ দীপঙ্কর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কথা ছিল। তা ঢাকায় হলো। এটা বজ্রযোগিনীতে হোক। বজ্রযোগিনী উচ্চ বিদ্যালয়ের (১৮৮৩) শিক্ষক মো. ফরহাদ হোসেন বলেন, অতীশ দীপঙ্করের নামে বজ্রযোগিনী অথবা মুন্সীগঞ্জ শহরে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হওয়া উচিত। দীপঙ্করের স্মৃতি ধরে রাখতে মুন্সীগঞ্জে কিছু একটা করা দরকার।

লেখক: সাংবাদিক

 

ভোরের আকাশ/রন