logo
আপডেট : ১৮ নভেম্বর, ২০২৪ ১৬:০০
লাতিন আমেরিকায় চীনের মেগা বন্দর চালু
উদ্বিগ্ন যুক্তরাষ্ট্র

লাতিন আমেরিকায় চীনের মেগা বন্দর চালু

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে আবার ডনাল্ড ট্রাম্পের আগমনে ওয়াশিংটন-বেইজিং সম্পর্ক কোনদিকে মোড় নেবে গোটা বিশ্ব যখন তা দেখার অপক্ষোয়, ঠিক তখনই লাতিন আমেরিকায় পাকাপোক্ত অবস্থান তৈরি করার চূড়ান্ত পদক্ষেপটি নিয়ে ফেলল চীন।

এ সপ্তাহে পেরু উপকূলে চাঙ্কাই বন্দর উদ্বোধন করেছেন খোদ চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্পের আগমনকে চীন কতটা গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে এ তারই ইঙ্গিত।

চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ (বিআরআই) এর আওতায় তৈরি বিশাল এ বন্দর লাতিন আমেরিকা ও এশিয়ার মধ্যকার বাণিজ্যে নতুন মাত্রা যোগ করবে বলে আশা করা হচ্ছে।

ডনাল্ড ট্রাম্প চীনা পণ্য আমদানিতে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপের প্রতিশ্রুতি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয় পেয়েছেন।

কিন্তু দক্ষিণ আমেরিকার দেশ পেরুতে চীনের অর্থায়নে তৈরি নতুন যে মেগা বন্দর চালু হল, তা সম্পূর্ণ নতুন বাণিজ্য রুট তৈরির সম্ভাবনা জাগিয়েছে। এ রুটে উত্তর আমেরিকাকে পুরোপুরি পাশ কাটিয়ে বাণিজ্য পরিচালনা করা সম্ভব হবে।

বিবিসি জানায়, এশিয়া-প্যাসিফিক ইকোনোমিক কো-অপারেশন ফোরাম (এপেক) এর বার্ষিক সম্মেলনে যোগ দিতে পেরু সফরে গিয়েছিলেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি। কিন্তু সবার নজর ছিল চাঙ্কাইয়ের দিকে। কারণ অঞ্চলটিতে ঐতিহাসিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবের মধ্যে এখন চীনের আধিপত্য বাড়তে দেখা যাচ্ছে।

পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ওয়াশিংটন বছরের পর বছর ধরে প্রতিবেশী দেশগুলো এবং তাদের প্রয়োজনের বিষয়টিতে যে উদাসীনতা দেখিয়েছে, এখন তারা এর মূল্য দিচ্ছে।

ওয়াশিংটনে ‘পিটারসন ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল ইকোনোমিকস’ এর সিনিয়র ফেলো মনিকা বলেন, যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘ সময় ধরে লাতিন আমেরিকার দিকে অমনোযোগী থেকেছে। আর এ সময়ে চীন অঞ্চলটিতে আধিপত্য বিস্তার করতে নেমে পড়েছে। চীন এত দ্রুত সেখানে পা ফেলেছে যে, গত দশকে পরিস্থিতি পুরোপুরি বদলে গেছে।

বিবিসিকে তিনি বলেন, “আপনি আমেরিকার উঠান পেয়েছেন, যা সরাসরি চীনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এটা সমস্যা সৃষ্টি করবে।”

বন্দর চালু করার আগে চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কসকো শিপিং কোম্পানি ৩৫০ কোটি ডলার খরচ করে পেরুর ঝিমিয়ে পড়া একটি মৎস শহরকে পাওয়ার হাউসে পরিণত করেছে, যা বদলে দিতে পারে দেশটির অর্থনীতির চিত্র।

চীনের ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির সংবাদপত্র পিপলস ডেইলি একে ‘চীন-পেরুর দুপক্ষের জন্যই লাভজনক এমন সহযোগিতার প্রতিফলন' বলে বর্ণনা করেছে।

মেগা বন্দরটির উদ্বোধনে পেরুর প্রেসিডেন্ট দিনা বোলুয়ার্তে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে একে ‘স্নায়ুকেন্দ্র’ বলে অভিহিত করেছেন। কারণ, এ বন্দর এশিয়ার বিশালকায় বাজারে প্রবেশের ক্ষেত্রে তার দেশের জন্য সংযোগ সেতু হিসেবে কাজ করবে।

চাঙ্কাই বন্দর পুরোপুরি চালু হলে চিলি, ইকুয়েডর, কলম্বিয়া এমনকি ব্রাজিলের পণ্যও এ বন্দর হয়ে সাংহাই এবং এশিয়ার অন্যান্য বন্দরে যাবে।

চীন এরইমধ্যে ওই অঞ্চল থেকে পণ্য আমদানি করতে আগ্রহী। তাদের আগ্রহের তালিকায় রয়েছে- ব্রাজিলের সয়াবিন ও চিলির তামা। এখন এ নতুন বন্দর বড় জাহাজগুলো পরিচালনা করতে পারবে। পাশাপাশি পণ্য পরিবহনের সময়ও কমে আসবে ৩৫ দিন থেকে ২৩ দিনে। নতুন বন্দরে রপ্তানির পাশাপাশি আমদানিও প্রধান্য পাবে।

তবে নতুন বন্দরটি আমদানির পাশাপাশি রপ্তানিতেও ভূমিকা রাখবে। অনলাইনে চীনা পণ্যের কেনাকাটা বেড়ে যাওয়ায় চিলি ও ব্রাজিল দেশি শিল্পের সুরক্ষায় বিদেশি পণ্যের জন্য গ্রাহকের করছাড় বাতিল করেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তাদের আশঙ্কা, চাঙ্কাই বন্দরটি বড় কন্টেইনারবাহী হাজার পরিচালনা করতে পারলে, এ বন্দরের মাধ্যমে চীন তাদের যুদ্ধজাহাজও পরিচালনা করতে পারে।

বিষয়টি নিয়ে কঠোর সতর্কবার্তা দিয়েছেন জেনারেল লরা রিচার্ডসন। সম্প্রতি লাতিন আমেরিকা এবং ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে যুক্তরাষ্ট্রের সাউদার্ন কমান্ডের প্রধানের পদ থেকে অবসর নিয়েছেন তিনি।চাঙ্কাই বন্দরটি চীনের সেনাবাহিনীর নানা কাজে ব্যবহার হওয়াসহ চীনা নৌবাহিনীর কৌশলগত ‘চোক পয়েন্ট’ হিসেবেও ব্যবহার হতে পারে বলে তিনি সতর্ক করেছেন।

তিনি বলেছেন, চীন পুরো অঞ্চলে দ্বৈত-ব্যবহারের প্রকল্প বিকাশের সঙ্গে ‘দীর্ঘ খেলা খেলছে’। ভবিষ্যতে এসব স্থাপনা ও নৌতল্লাশি কেন্দ্রেগুলো চীনা সেনাবাহিনী কাজে লাগাতে পারে।

বিবিসি লিখেছে, এই শঙ্কা যদি বাস্তব রূপ নাও পায়- তারপরও আরেকটি বদ্ধমূল ধারণা তৈরি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ধারণা, চীন তার বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) এগিয়ে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লাতিন আমেরিকায় জমি হারাচ্ছে ওয়াশিংটন।

বিদায়ী মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের জন্য অ্যাপেক শীর্ষ সম্মেলনই তার মেয়াদে দক্ষিণ আমেরিকায় প্রথম ও শেষ সফর। তিনি সেখানে চীনের প্রেসিডেন্টের তুলনায় কম গুরুত্ব পেয়েছেন বলে মন্তব্য করেছেন মিডিয়া ভাষ্যকাররা।

সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে এ উদ্বেগ যদি অবান্তরও হয়, তারপরও চাঙ্কাই বন্দর এটাই প্রমাণ করে যে, চীন যখন তার বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র তখন লাতিন আমেরিকায় তাদের অবস্থান হারাচ্ছে।
লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের গ্লোবাল সাউথ ইউনিটের পরিচালক অধ্যাপক আলভারো মেনদেজ বলেন, যুক্তরাষ্ট্র যখন লাতিন আমেরিকাকে হালকাভাবে নিচ্ছে, তখন শি নিয়মিত ওই অঞ্চল সফর করছেন এবং সুসম্পর্ক গড়ে তুলছেন।

“যুক্তরাষ্ট্র এই বারটি এত নিচে নামিয়ে দিয়েছে যে, দরজা দিয়ে ঢুকতে হলে চীনকে আরেকটু ভালো হতে হবে।”

বিবিসি লিখেছে, বিআরআই প্রকল্পের লক্ষ্য কেবল লাতিন আমেরিকায় নেই। ২০২৩ সাল থেকে চীনের অভূতপূর্ব অবকাঠামোগত বিনিয়োগের অর্থ পেয়েছে প্রায় ১৫০টি দেশ। সবক্ষেত্রেই যে বেইজিং সুবিধা করতে পেরছে- এমনটা নয়। অনেক প্রকল্প অসমাপ্ত রয়ে গেছে, অন্যদিকে অনেক উন্নয়নশীল দেশ ঋণের বোঝায় জর্জরিত হয়েছে।

পিটারসন ইনস্টিটিউটের ডি বোলে বলছেন, “সবকিছুর পরও বামপন্থি ও ডানপন্থি সরকারগুলো চীন সম্পর্কে তাদের প্রাথমিক সন্দেহকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। কারণ তাদের স্বার্থের সঙ্গে বেইজিংয়ের স্বার্থের ঐক্যতান। নিছক প্রয়োজনের কারণেই নিজেদের সন্দেহ দূরে ঠেলছে বিভিন্ন দেশের সরকার।

 

ভোরের আকাশ/রন