ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মণিপুরে নতুন করে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে। রাজ্যটির তিনজন মন্ত্রী ও ৬ জন বিধায়কের বাড়িতে হামলার ঘটনা ঘটেছে। গতকাল রোববার পৃথক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে বার্তাসংস্থা রয়টার্স এবং সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি।সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, মণিপুরে মন্ত্রী-বিধায়কদের বাড়িতে হামলার পর এবার খোদ মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিংয়ের বাড়িতেই হামলা-চেষ্টা করেছে একদল বিক্ষুব্ধ জনতা। দরজা ভেঙে জোর করে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করে বিক্ষোভকারীরা। তাদের প্রতিহত করতে পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনী কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার করে। এদিকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ইম্ফলে আনতে অনির্দিষ্টকালের কারফিউ জারি করা হয়েছে। সাত জেলায় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ইন্টারনেট।
ভারতের মণিপুরে দুইজন মন্ত্রী ও তিনজন বিধায়কের বাড়িতে হামলা চালিয়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে বিক্ষোভকারীরা। ভারতের মণিপুরে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপের দাবিতে রাজ্য সরকারকে ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়েছেন মেইতেই সম্প্রদায়ের সদস্যরা। সহিংসতা মোকাবিলায় রাজ্য সরকার ইম্ফল পূর্ব, ইম্ফল পশ্চিম, বিষ্ণুপুর, থৌবাল এবং কাকচিংসহ পাঁচটি জেলায় অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারি করেছে। ইন্টারনেট সেবাও বন্ধ রাখা হয়েছে সাতটি জেলায়।মুখ্য সচিব বিনিৎ জোশি দাবি করেছেন, ভুল তথ্য ছড়ানো এবং সহিংসতা আরও উসকে দেওয়া রোধ করতে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। জিরিবাম জেলায় অপহৃত নারী-শিশুদের হত্যার ঘটনার প্রতিবাদে গত শনিবার এই হামলা চালানো হয় বলে জানিয়েছে পুলিশ।এ ঘটনার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় অনির্দিষ্টকালের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করেছে ইম্ফল পশ্চিম জেলার প্রশাসন। একইসঙ্গে ইম্ফল পশ্চিম, ইম্ফল পূর্ব, বিষ্ণুপুর, থৌবাল, কাকচিং, কাংপোকপি ও চূড়াচাঁদপুর জেলায় দুইদিনের জন্য ইন্টারনেট ও মোবাইল ডেটা সেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
পুলিশ জানিয়েছে, শনিবার ইম্ফলের লামফেল সানাকেইথেল এলাকায় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী সাপাম রঞ্জনের বাড়িতে বিক্ষোভকারীরা হামলা চালায়। এছাড়া, সাগলবন্দ এলাকায় বিজেপি বিধায়ক আরকে ইমোর বাড়ির সামনে বিক্ষুব্ধ জনতা জড়ো হয়ে স্লোগান দেয়। আরকে ইমো মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিংয়ের জামাতা।
এদিন কেইশামথং এলাকার স্বতন্ত্র বিধায়ক সাপাম নিশিকান্ত সিংয়ের বাড়িতেও বিক্ষোভকারীরা প্রবেশ করে। তবে তাকে বাড়িতে না পেয়ে বিক্ষুব্ধ জনতা তার মালিকানাধীন স্থানীয় একটি সংবাদপত্রের অফিসে হামলা চালায়।
এর আগে, শুক্রবার রাতে মণিপুর-আসাম সীমান্তে জিরি ও বারাক নদীর সংযোগস্থল থেকে তিনটি মরদেহ উদ্ধার করা হয়, যা নিখোঁজ ছয়জনের মধ্যে তিনজনের বলে ধারণা করা হচ্ছে। সূত্রের বরাতে জানা গেছে, নিহতদের মধ্যে দুই শিশু ও একজন নারী রয়েছেন।
এরপর শনিবার দুপুরে আরও তিনটি মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ফলে মোট মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ছয়জনে। তবে পরের তিনজনের পরিচয় এখনো শনাক্ত করা হয়নি।
গত ১১ নভেম্বর জিরিবাম জেলার বোকোবেরা এলাকায় একদল কুকি সন্ত্রাসী বেশ কয়েকজন নারী ও শিশুকে অপহরণ করেছিল। সেই সময় আরেকটি কুকি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সঙ্গে কেন্দ্রীয় রিজার্ভ পুলিশ ফোর্সের (সিআরপিএফ) সংঘর্ষ হয়, যেখানে ১০ জন সন্ত্রাসী নিহত হয়। তবে কুকি সম্প্রদায় দাবি করেছে, নিহতরা ‘গ্রাম স্বেচ্ছাসেবক’ ছিলেন।
প্রসঙ্গত, গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে মণিপুরে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু মেইতেই এবং প্রধানত খ্রিস্টান কুকি সম্প্রদায়ের মধ্যে সংঘর্ষ চলছে। এই সংঘাতের ফলে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে আগের সহাবস্থান ভেস্তে গেছে এবং রাজ্যজুড়ে উত্তেজনা অব্যাহত রয়েছে।
মণিপুরে নারী-শিশুসহ অপহৃত ৬ জনের মরদেহ উদ্ধার:
ভারতের মণিপুরে জিরিবাম জেলা থেকে ছয়জনের মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। নিহতদের মধ্যে তিনজন নারী এবং তিনজন শিশু রয়েছে, যাদের একজনের বয়স মাত্র আট মাস। মেইতেই সম্প্রদায়ভুক্ত এই পরিবারটিকে পাঁচদিন আগে সন্দেহভাজন কুকি সন্ত্রাসীরা অপহরণ করেছিল। রাজ্য সরকারের শীর্ষ সূত্রে শনিবার সকালে এ তথ্য নিশ্চিত করেছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি।
সূত্র জানায়, শুক্রবার রাতে আসামের শিলচরের মর্গে এক নারী ও দুই শিশুর মরদেহ আনা হয়। এসময় মণিপুরের জিরিবাম জেলায় উত্তেজনা বিরাজ করছিল। শিলচর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের (এসএমসিএইচ) মর্গের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রথমে তিনটি মরদেহকে প্রাপ্তবয়স্ক মনে হলেও পরবর্তীতে দুটি মরদেহ শিশুর এবং একটি নারীর বলে নিশ্চিত করা হয়।
এরপর শনিবার দুপুরে আরও তিনটি মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ফলে মোট মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ছয়জনে। তবে এই তিনটি মরদেহ এখনো শনাক্ত করা হয়নি এবং এসএমসিএইচ-এ নিয়ে আসা হয়নি।
লায়শারাম হিরোজিত নামে এক সরকারি কর্মচারী জানিয়েছেন, তার দুই সন্তান, স্ত্রী, শাশুড়ি ও শ্যালিকা অপহৃতদের মধ্যে ছিলেন। তারা সবাই মেইতেই সম্প্রদায়ের সদস্য। হিরোজিত বলেন, সোমবার তার স্ত্রী তাকে ফোনে জানান, সশস্ত্র একদল লোক তাদের ঘিরে রেখেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফোনকলটি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং পরে ফোনও বন্ধ পাওয়া যায়।
পুলিশ ও সিআরপিএফের সঙ্গে কুকি সন্ত্রাসীদের সংঘর্ষ চলাকালে অপহৃতদের একটি নৌকায় তুলে নিয়ে যেতে দেখা যায় বলে জানান হিরোজিতের স্ত্রীর এক বন্ধু।
গত ১১ নভেম্বর সিআরপিএফ ও পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ১০ জন সন্দেহভাজন কুকি সন্ত্রাসী নিহত হয়। তবে কুকি সম্প্রদায় দাবি করেছে, নিহতরা ‘গ্রাম স্বেচ্ছাসেবক’ ছিলেন।
যদিও এই দাবি অস্বীকার করেছে সিআরপিএফ ও পুলিশ। সংঘর্ষস্থল থেকে একে-৪৭ ও ইনসাস রাইফেল এবং রকেট-চালিত গ্রেনেড লঞ্চারের মতো ভারী অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে।
এদিকে, কুকি সম্প্রদায়ের একদল লোক শিলচরের হাসপাতালের বাইরে জড়ো হয়ে প্রতিবাদ করেছে। তাদের দাবি, শিলচরে মর্গে থাকা ১০ জন কুকি পুরুষের মরদেহ মিজোরামের দিকে নিয়ে যেতে দিতে হবে। পুলিশ ও সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে প্রায় এক ঘণ্টার আলোচনার পরও সমঝোতা না হওয়ায় পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে এবং লাঠিচার্জ করতে হয়।এই ঘটনার জেরে আসাম পুলিশের পক্ষ থেকে এলাকায় সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি করা হয়েছে।
এর আগে, শনিবার রাতে প্রতিবাদকারীরা রাজ্যের তিন মন্ত্রী ও ছয় বিধায়কের বাড়িতে হামলা চালায়। মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিংয়ের জামাতা ও বিজেপি বিধায়ক আর কে ইমো সিংয়ের বাড়ি ভাঙচুর করা হয় এবং সম্পত্তিতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। একইভাবে পৌর প্রশাসন মন্ত্রী ওয়াই খেমচাঁদ এবং ভোক্তা বিষয়ক মন্ত্রী এল সুশিন্দ্র সিংয়ের বাড়িতে হামলা হয়।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী সাপম রঞ্জনের বাড়িতেও হামলা চালানো হয়। প্রতিবাদকারীদের আশ্বস্ত করতে তিনি জানিয়েছেন, মন্ত্রিসভার বৈঠকে তাদের দাবি তুলবেন এবং প্রয়োজন হলে পদত্যাগ করবেন।
মণিপুরে মেইতেই ও কুকি সম্প্রদায়ের মধ্যে চলমান সংঘর্ষে এখন পর্যন্ত দুই শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে এবং প্রায় ৫০ হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। মেইতেইরা সংরক্ষিত উপজাতি তালিকাভুক্তির দাবি জানাচ্ছে, অন্যদিকে কুকি সম্প্রদায় পৃথক প্রশাসনিক অঞ্চল চায়।বর্তমান পরিস্থিতিতে রাজ্যজুড়ে উত্তেজনা বিরাজ করছে, যা আরও সহিংসতার দিকে নিয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ভোরের আকাশ/রন