এবছর দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতিতে বেশি মাত্রায় অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর হলো ডেঙ্গুর পিক মৌসুম। অক্টোবর থেকে নতুন রোগী ও মৃত্যুর হার হ্রাস পেতে থাকে। কিন্তু চলতি বছর এক্ষেত্রে অস্বাভাবিক চিত্র লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যেখানে হ্রাস পাওয়ার কথা, সেখানে উল্টো ঘটছে। ডেঙ্গুতে গড়ে দৈনিক মৃত্যু সেপ্টেম্বরে ২ দশমিক ৯ জন এবং অক্টোবরে ৪ দশমিক ৫০ জন। আর চলতি মাসের ১৯ দিনে গড়ে তা দাঁড়াল ৫ দশমিক ৮৮ জনে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে ডেঙ্গু ভয়াবহতা ও মশাবাহিত রোগ সরকারের নজরে আসে ২০০০ সালে। সে বছর থেকেই সরকার ডেঙ্গু সংক্রান্ত হিসাব রাখা শুরু করে। তবে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা পূর্ণ প্রকাশ পায় গত বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালে। সে বছর রোগী বাড়তে শুরু করে মে মাসের মাঝা-মাঝিতে এসে, জুন থেকে শুরু করে ছড়ানো। সেবার ছাড়িয়ে যায় আগের ২২ বছরের হিসাব। রোগটির প্রাদুর্ভাব বাড়ে, ছড়িয়ে পড়ে পুরো দেশে। দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ সংখ্যক রোগী তিন লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন শনাক্ত হয়, মৃত্যু হয় এক হাজার ৭০৫ জনের।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ হিসবে অনুযায়ী, চলতি বছরে এখন পর্যন্ত ৪২২ জন ডেঙ্গুতে প্রাণ হারিয়েছে। এদের মধ্যে গত অক্টোবর মাসে মৃত্যু হয়েছে ১৩৫ জনের। মৃতদের মধ্যে নারীদের সংখ্যা বেশি। এ ছাড়া চলতি বছরে এখন পর্যন্ত ৮২ হাজার ১২০ ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পুরো বছরের তথ্যে দেখা যায়, বছরের শুরুতে অর্থাৎ জানুয়ারিতে হাসপাতালে ভর্তি হন ১ হাজার ৫৫ জন, মৃত্যু হয় ১৪ জনের; ফেব্রুয়ারিতে ভর্তি হন ৩৩৯ জন, মৃত্যু হয় তিনজনের; মার্চে রোগী ছিলেন ৩১১ জন, মৃত্যু পাঁচ জনের; এপ্রিলে আক্রান্ত ৫০৪ জন, মৃত্যু দুইজনের; মে মাসে আক্রান্ত ৬৪৪ জন, মৃত্যু ১২ জনের; জুনে আক্রান্ত ৭৯৮ জন, মৃত্যু আটজনের, জুলাইয়ে আক্রান্ত ২ হাজার ৬৬৯ জন, মৃত্যু ১২ জনের, আগস্টে আক্রান্ত ৬ হাজার ৫২১ জন, মৃত্যু ২৭ জনের, সেপ্টেম্বরে আক্রান্ত ১৮ হাজার ৮৭ জন, মৃত্যু ৮৭ জনের। আর সদ্য শেষ হওয়া অক্টোবরে মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয় সাড়ে চার হাজার, মৃত্যু হয় ১৩৪ জনের। নভেম্বরের ১৮ দিনে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১৯ হাজার ২৫১ জন এবং এসময়ে মারা গেছেন ১০৬ জন। অর্থাৎ চলতি বছর মাসিক হিসাবে ডেঙ্গুতে নভেম্বরে মৃত্যুহার বেশি।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. আবু জামিল ফয়সাল ভোরের আকাশকে বলেন, আগের বছরগুলোতে দেখেছি, ডেঙ্গুর পিকটাইম সেপ্টেম্বরে ছিল পাঁচবার। অক্টোবরে তিনবার, আগস্ট ও নভেম্বরে হয়েছে একবার করে। এবারও অক্টোবর পিকটাইম হয়েছে। কিন্তু সেটা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে।
তিনি আরও জানান, প্রতি বছর সরকার থেকে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়, তার কোনো কার্যকারিতা নেই। শুধু অর্থ ব্যয় করলে হবে না, পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। প্রতিদিন সন্ধ্যায় ফগার মেশিন দিয়ে ধোঁয়া দিলেই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আসবে না। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সুষ্ঠু কার্যকরী পরিকল্পনা নেওয়া দাবি জানান তিনি।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী ভোরের আকাশকে বলেন, সারাবছর ধারাবাহিকভাবে কাজ করায় পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের কলকাতা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। বাংলাদেশে ডেঙ্গুকে মৌসুমি সমস্যা হিসেবে দেখা হচ্ছে। এটা যে জনস্বাস্থ্যের জরুরি সমস্যা, সে চিন্তা থেকে কাজ হচ্ছে না। ফলে এককালীন অর্থ বরাদ্দ করে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা সম্ভব নয়।
কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক কবিরুল বাশার ভোরের আকাশকে বলেন, আমরা মাঠ পর্যায়ে এডিস মশার যে ঘনত্ব বা প্রক্রিয়া ইনডেক্স পেয়েছি সেটা ২০ এর ওপর। যা থেকে বলাই যায় এখানে ডেঙ্গু কমবে না। আমাদের ফোরকাস্টিং মডেল অনুযায়ী, পুরো অক্টোবরজুড়েই থাকবে ডেঙ্গুর প্রকোপ। নভেম্বর, ডিসেম্বরেও ডেঙ্গুর প্রভাব কমবে না।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় সরকারের ঢাকার দুসিটি করপোরেশন সর্বশেষ অর্থবছরে বাজেট ছিল ১৫২ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। সারাদেশে স্থানীয় সরকার বিভাগ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ডেঙ্গু মোকাবিলা, পরিচ্ছন্নতা ও প্রচার খাতে (স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ব্যয়ের বাইরে) ৪০ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছে। পৌর সভাগুলোকে সেখান থেকে শ্রেণিভেদে প্রায় ১ লাখ ২৬ হাজার থেকে ১ লাখ ৮০ টাকার বরাদ্দ ছাড় করা হয়েছে। সরকার থেকে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে এমন বিপুল অর্থ ব্যয়ের পরেও কার্যকরী কোনো নিয়ন্ত্রণে আসতে পারেনি। প্রতিবছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যু দুটো সমান তালে বাড়ছে।
ভোরের আকাশ/রন