logo
আপডেট : ২০ নভেম্বর, ২০২৪ ১০:২৯
বড় যুদ্ধের দামামা
সিরাজুল ইসলাম

বড় যুদ্ধের দামামা

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ১০০০ দিন পূর্ণ হয়েছে গতকাল মঙ্গলবার (১৯ নভেম্বর, ২০২৪)। দিনটি নিয়ে কয়েক দিন ধরে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে ব্যাপক উত্তেজনা বিরাজ করছিল। এর নেপথ্যে রয়েছে আমেরিকার ‘আর্মি টেকনিক্যাল মিসাইল সিস্টেম’ (এটিএসিএমএস) ব্যবহার করে রাশিয়ার অভ্যন্তরে বাইডেন প্রশাসনের হামলার অনুমোদন। এই অস্ত্র ব্যবহার করে গতকাল মঙ্গলবার রাশিয়ায় হামলা করেছে ইউক্রেন। এর আগেই রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন তার দেশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের পরমাণু অস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছেন।

গতকাল পার্লামেন্টে ভাষণ দিয়েছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলাদিমির জেলেনস্কি। যুদ্ধের এক হাজার তম দিনে তিনি বলেন, রাশিয়ার আগ্রাসনের কাছে নতি স্বীকার করবে না ইউক্রেন। জেলেনস্কি এক্সে লেখেন, রাশিয়া আমাদের সীমান্ত অঞ্চলে ত্রাস সৃষ্টি করে চলেছে। তাদের হামলায় এটিই প্রতিপন্ন হচ্ছে। পুতিন চান যুদ্ধ চলতে থাকুক। তিনি শান্তি নিয়ে আলোচনা করতে আগ্রহী নন। ইউক্রেইনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, দখলদারদের কাছে ইউক্রেন কখনও আত্মসমর্পণ করবে না এবং আন্তর্জাতিক আইন ভঙের জন্য রাশিয়ার সেনাবাহিনীকে সাজা দেওয়া হবে। গত সোমবার রাতে ইউক্রেনের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সামি অঞ্চলে ড্রোন হামলায় এক শিশুসহ ৮ জন নিহত হয় এবং গত রোববার আলাদা আরেকটি হামলায় ৮৯ জন নিহত হয়। ছোট্ট শহর হালখিভের আবাসিক ভবনে ড্রোন হামলায় দুই শিশুসহ ১২ জন আহত হয়েছে বলে জানিয়েছে ইউক্রেনের ন্যাশনাল পুলিশ বাহিনী।

বিবিসি বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহ করা দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ইউক্রেন প্রথমবারের মতো রাশিয়ার ভূখণ্ডে হামলা করেছে। গতকাল এই হামলা হয়েছে বলে রাশিয়ার পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।

রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ইউক্রেন গতকাল সকালে আর্মি ট্যাকটিক্যাল মিসাইল সিস্টেম (এটিএসিএমএস) ব্যবহার করে রাশিয়ার ব্রিয়ানস্ক এলাকায় হামলা করেছে। পাঁচটি ক্ষেপণাস্ত্র গুলি করে ভূপাতিত করা হয়েছে এবং একটি ধ্বংস করা হয়েছে। ক্ষেপণাস্ত্রের ধ্বংসাবশেষের কারণে ওই এলাকায় একটি সামরিক স্থাপনায় আগুন ধরেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে হামলা চালানোর কথা ইউক্রেনের গণমাধ্যমেও উঠে এসেছে। তবে এ বিষয়ে এখনো ইউক্রেন সরকারের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। বিবৃতিতে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলেছে, স্থানীয় সময় বিকেল ৩টা ২৫ মিনিটে এই হামলা চালানো হয়েছে। একটি ক্ষেপণাস্ত্রের ধ্বংসাবশেষ পড়ার পর আগুন ধরে যায়। দ্রুত ওই আগুন নেভানো হয়। এ ঘটনায় কেউ হতাহত হননি। এর আগে ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী নিশ্চিত করে, তারা রাশিয়ার ব্রিয়ানস্ক এলাকায় একটি গোলাবারুদের গুদামে হামলা চালিয়েছে। তবে এই হামলায় এটিএসিএমএস ব্যবহার করা হয়েছে কি না সেটা তারা নিশ্চিত করেনি। ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী বলেছে, সীমান্ত থেকে ১০০ কিলোমিটারের মতো দূরে কারাচেভ শহরের কাছে একটি ডিপোতে ওই হামলা হয়েছে। হামলার পর ১২টি বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। সামরিক বাহিনীর সূত্রের বরাত দিয়ে ইউক্রেনের সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, এই হামলায় যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে।

এদিকে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে রুশ বাহিনীকে পরমাণু অস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। গত প্রায় তিন বছর ধরে চলা এই যুদ্ধে প্রথম এমন অনুমতি দিলেন তিনি। রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গতকাল মঙ্গলবার একটি ডিক্রিতে স্বাক্ষর করেছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট। যাতে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র হামলার জবাবে পরমাণু অস্ত্র ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। ভ্লাদিমির পুতিনের মুখপাত্র এবং রুশ প্রেসিডেন্টের কার্যালয় ক্রেমলিনের প্রেস সেক্রেটারি দিমিত্রি পেসকভ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার অভ্যন্তরে সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করার জন্য কিয়েভকে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করার অনুমতি দেওয়ার পরই পদক্ষেপ নিলো রাশিয়া। নতুন নীতিমালায় বলা হয়েছে, যে দেশ পারমাণবিক শক্তিধর নয়; কিন্তু সেই রাষ্ট্র যদি পারমাণবিক শক্তিধর কোনো দেশের সমর্থন পায় তাহলে রাশিয়াও পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে পারবে। দিমিত্রি পেসকভ সাংবাদিকদের বলেন, রাশিয়া সবসময় পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার না করার পক্ষে। আমরা শুধু আমাদের নিরাপত্তা, সার্বভৌমত্ব এবং অখণ্ডতা রক্ষার জন্য এ সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছি। তিনি আর বলেন, ইউক্রেনের বিরুদ্ধে ‘সামরিক অভিযান’ অব্যাহত থাকবে।

প্রসঙ্গত, দূরপাল্লার রকেট যখন ইউক্রেনের হাতে তুলে দেয় আমেরিকা, তখন শর্ত ছিল যুদ্ধক্ষেত্রে তা ব্যবহার করতে হবে। রাশিয়ার ভিতরে এই রকেট ব্যবহার করা যাবে না। গত সোমবার সূত্রকে উদ্ধৃত করে নিউইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র এখন রাশিয়ার ভিতরে এই রকেট হামলার অনুমতি দিয়েছে। এর প্রতিক্রিয়ায় রাশিয়ার সাংসদ মারিয়া বুটিনা বলেছেন, ফলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঝুঁকি বাড়ছে। তবে হোয়াইট হাউস এখনো বিষয়টি নিয়ে কোনো মন্তব্য করেনি।

সূত্র জানিয়েছে, এই এটিএসিএমএস রকেট ৩০৬ কিলোমিটার পর্যন্ত দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতে পারে। জানুয়ারিতেই ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয়বারের জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেবেন। তার আগে এই খবর সামনে এসেছে। তিনি আগে দাবি করেছিলেন, দায়িত্ব নেয়ার আগেই তিনি ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করে দেবেন।

রাশিয়ার পার্লামেন্ট সদস্য মারিয়া বুটিনা গত সোমবার বলেছেন, জো বাইডেন প্রশাসন যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাতে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঝুঁকি বাড়ছে।

বার্তাসংস্থা রয়টার্সকে তিনি বলেছেন, বাইডেন প্রশাসন উত্তেজনা সবচেয়ে বেশি বাড়াবার ব্যবস্থা করছে। তারা যতদিন ক্ষমতায় থাকবে, ততদিন এই উত্তেজনা বাড়াবার চেষ্টা করে যাবে। বুটিনা জানিয়েছেন, আমি আশা করি, ডোনাল্ড ট্রাম্প এই সিদ্ধান্ত বদল করবেন। কারণ, এই সিদ্ধান্ত নেয়া হলে পরিস্থিতি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে এগোবে, ফলে কারুরই লাভ হবে না।

রাশিয়ার সেনা ইউক্রেনের উত্তরপশ্চিমের শহর কুপিয়ানস্ক আবার দখল করতে চাইছে বলে যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে রাশিয়ার সেনা কুপিয়ানস্কে ঢোকার চেষ্টা করছে বলে রিপোর্টে বলা হয়েছে। ইউক্রেন জানিয়েছে, চারবার রাশিয়ার সেনা এই শহরে ঢোকার চেষ্টা করেছিল।

যুক্তরাষ্ট্রের রিপোর্ট অনুসারে, রাশিয়ার সেনা কুপিয়ানস্কের দক্ষিণে ওসকিল নদী পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর রাশিয়া এই শহরটি দখল করে। পরে ইউক্রেনের সেনা আবার তা দখল করে নেয়। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে গত শুক্রবার ফোনে কথা বলেছেন জার্মানির চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎস। চ্যান্সেলর দাবি করেছেন, ইউক্রেন নিয়ে পুতিনের মনোভাবে কোনো পরিবর্তন হয়নি। ব্রাজিলে জি২০ শীর্ষ বৈঠকে যোগ দিতে গিয়ে শলৎস সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে তার বিস্তারিত কথা হয়েছে। কিন্তু তার মতের পরিবর্তন হয়নি। তিনি বলেছেন, এই যুদ্ধ তখনই বন্ধ হতে পারে; যখন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট তার সাম্রাজ্যবাদী উচ্চাশা থেকে সরে আসবেন।

শলৎস জানিয়েছেন, ইউক্রেনের প্রতি পশ্চিমা দেশের সমর্থন এবার কমে যাবে এই ভুল ধারণা ভাঙানো দরকার ছিল। ডোনাল্ড ট্রাম্প আবার মার্কিন প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নিচ্ছেন। এই সময় ট্রাম্পের পাশাপাশি পুতিনের সঙ্গেও কথা বলা দরকার। পোল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড টুস্ক বলেছেন, দুই বছরের মধ্যে প্রথমবার পুতিনের সঙ্গে ফোনে কথা বললেন শলৎস। তারপরেই ইউক্রেনে সবচেয়ে বড় ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করলো রাশিয়া। বোঝা যাচ্ছে, ইউক্রেনের সমর্থনের বিকল্প টেলিফোন-কূটনীতি হতে পারে না। তার মতে আগামী কয়েক সপ্তাহ শুধু যুদ্ধের ক্ষেত্রে নয়, ভবিষ্যতের জন্যও খুব গুরুত্বপূর্ণ।

 

ভোরের আকাশ/রন