এক মেঘলা দিনে নদীর পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় হঠাৎ একটি মস্তকবিহীন শবদেহ ভেসে উঠতে দেখলাম। ভয়ে চিৎকার করে চোখ বন্ধ করলাম। পরে বুঝলাম ভয়াবহ এক দুঃস্বপ্ন ছিল। ঘুমটা ভেঙে গেল, ভাবলাম কেন এমন স্বপ্ন দেখলাম? আমিতো হরর মুভির বা ক্রাইম থ্রিলারের দর্শক নই। বুঝলাম আমার দেশের পরিস্থিতি এজন্য দায়ী।
শুধু হত্যা নয়, ভয়াবহ কায়দায় হত্যার ঘটনা দিন দিন বাড়ছে। বাড়ছে বললে কম বলা হবে, বলতে হবে খুব ঘন ঘন এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। প্রতিটি ঘটনা আলাদা এবং এতোটাই নিষ্ঠুর যে মানুষ বিস্মিত বা শোকাভিভূত হওয়ার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলছেন। অথচ অবচেতনে মনের ভেতরে এর প্রভাব পড়ছে ঠিকই।
যেমন এই লেখাটা লেখার প্রস্তুতি নেওয়ার সময়ই দেখলাম পরপর তিন-চারটি বীভৎস হত্যাকাণ্ড ঘটে গেছে। চুয়াডাঙ্গায় ২৫ বছরের যুবক সবুজকে নির্মমভাবে মোটরসাইকেলসহ পুড়িয়ে হত্যার ঘটনা ঘটেছে যেদিন, ঠিক এর আগের দিন বগুড়ার দুপচাঁচিয়ায় বাড়ির ডিপ ফ্রিজ থেকে নারীর লাশ উদ্ধার করা হলো। আর সর্বশেষ রূপগঞ্জের লেকের পাড় থেকে তিনটি পলিথিনের বস্তায় যুবকের শরীরের বিভিন্ন অংশ উদ্ধার করেছে। এর আগে, সাভারে নারী দেহের তিনটি খণ্ড পাওয়া গেল।
আমরা অবাক হই এই ভেবে যে, এমন নির্মম কাজ মানুষ কি করতে পারে? তবে হ্যাঁ মানুষই, একমাত্র মানুষই এমন কাজ করতে পারে। মানুষ শুধু মানুষকেই হত্যা করে না, করে অন্যান্য পশুপাখিকেও। কোনো কারণ ছাড়াই বছর দুই আগে নীল মাছরাঙা পাখিটির দ্বিখণ্ডিত দেহ ও তার ডিমগুলো ভেঙে ফেসবুকে ছবি দিয়েছিল এক অমানুষ। সেই অমানুষটি মাছরাঙ্গা পাখিটির বাসায় হামলা চালিয়ে মা পাখিটির মাথা ছিঁড়ে আলাদা করে এবং সেটা ডিমগুলোর পাশে রেখে ছবি তুলে ফেসবুকে আপলোড করেছে। জানতে ইচ্ছা করে— যে অপরাধী, তার মনের গঠনটি কেমন?
গত কয়েকবছর যাবৎ একের পর এক নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ড সমাজে গভীর উদ্বেগের সৃষ্টি করছে। একে শুধু ‘একক ঘটনা’ হিসেবে না দেখে, বরং ‘একটি প্রবণতা’ হিসেবে দেখতে হবে। একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা, সহানুভূতি এবং মানবিকতার পরিবর্তে এক ধরনের সহিংস মনোভাব তৈরি হচ্ছে। ভার্চুয়াল জগতের অন্ধকার দিক, ঘৃণা, সহিংস প্রোপাগাণ্ডা বাস্তব জগতে মানুষকে নিষ্ঠুরতার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। অনলাইনে হিংসাত্মক কনটেন্ট, ভিডিও গেমস এবং অপরাধমূলক উপাদানগুলো শিশু-কিশোর ও তরুণদের মধ্যে সহিংস আচরণকে উস্কে দিচ্ছে।
পাশাপাশি অর্থনৈতিক বৈষম্য, দারিদ্র্য, বেকারত্ব, লোভ এবং সামাজিক অস্থিরতা মানুষের মধ্যে হতাশা এবং ক্ষোভ সৃষ্টি করছে। এ ধরনের হতাশা মানুষকে অপরাধের দিকে ঠেলে দেয় এবং মানুষ যেকোনো ধরনের নিষ্ঠুর ও ভয়ঙ্কর কাজের প্রতি সহজেই আগ্রহী হয়ে ওঠে।
যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস অ্যাট অস্টিনের পুরকৌশল, স্থাপত্য ও পরিবেশ কৌশল অনুষদের অধ্যাপক নাভিদ সালেহ, লিখেছেন, ‘সিগমুন্ড ফ্রয়েড মানবমনের গঠনকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনটি নির্দিষ্ট আঙ্গিক চিহ্নিত করেছেন- ইড, ইগো ও সুপার ইগো। ইড মানব মনের প্রথম আঙ্গিক, যা জন্ম থেকেই ব্যক্তিক চাহিদা তৈরি করে। ইগো বহির্জগতের সঙ্গে ইডের সংযোগ স্থাপন করে। অর্থাৎ, ইগো হলো মানব মনের যুক্তিকেন্দ্র। আর সুপার ইগো হলো নীতিজ্ঞানের জায়গা, যা সমাজ প্রতিষ্ঠিত নিয়ম ও মানদণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যক্তির ক্রিয়াকর্মের নৈতিকতাকে বিচার করে থাকে।’ ‘অপরাধী যখন সুপার ইগোকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে কেবল ইড চরিতার্থের নেশায় মত্ত হয়, তখন সমাজ নির্ধারিত ঠিক-বেঠিকের ধার ধারে না। আর ইগোকে সে কাজে লাগায় ইডের চাহিদা মেটানোর প্রয়াসে, যুক্তির খোলসে আবৃত করে। আর ইডকে ইন্ধন জোগায় অতীতে অনুভূত কোনো গভীর মনোকষ্ট বা ট্রমা, তীব্র কোনো অবচেতন বাসনা। নির্মমতার সূত্রপাত ঘটে তখনই, যখন মানবমনের তিন নির্দিষ্ট আঙ্গিকের ভারসাম্যে ছেদ পড়ে। এমন ব্যক্তি ‘সাইকোপ্যাথ’ বলে চিহ্নিত।’
আর তাই আমরা দেখি, যারা সাইকোপ্যাথ বা এই মনস্ক মানুষ, তারা অন্যের অমঙ্গল বা কষ্টে সহানুভূতিবোধ করেন না, থাকে না কোনো অনুতাপ; বরং থাকে অসত্য বলার প্রবণতা, সমাজ-বিচ্ছিন্নতা ও চটকদার হাবভাব। একজন সাইকোপ্যাথ তাই অনুতাপ ও অনুশোচনা ছাড়াই ভয়ানক অপরাধ ঘটাতে পারেন। কেন মানুষ নির্মমভাবে অন্য মানুষকে হত্যা করে? এর পেছনে আছে ব্যক্তির আবেগ, সামাজিক পরিবেশ ও পরিস্থিতি। গত বছর আনারকলি নামে ২০ বছরের ফুটফুটে একটি মেয়ে শ্বশুরের কাটা মাথা নিজের ব্যাগে বহন করছিলেন সমুদ্রের পানিতে ফেলে দেবেন বলে। অথচ একজন স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে এরকম একটা দৃশ্য ভাবলেও গা গুলিয়ে ওঠার কথা। পরে সেই মাথা আনারকলি ফেলে দিয়েছিলেন পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত এলাকায়।
সম্পত্তি ভাগাভাগিকে কেন্দ্র করে ওই ব্যবসায়ী খুন হন তার সন্তানদের হাতে। হত্যার আলামত গায়েব করতে গিয়ে স্ত্রী ও সন্তানেরা ১০ টুকরো করেছিলেন হাসান আলীর দেহ। সেখানেই থেমে থাকেননি তারা, পরে নগরীর তিনটি স্থানে ফেলে দেন মৃতদেহের বিভিন্ন অংশ। লাশ গুম করার এই ভয়াবহ ঘটনা যেকোনো অপরাধ থ্রিলারকে হার মানিয়েছে।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দীন আহমেদ বলেন, ‘খুব ছোটবেলা থেকেই কোনো শিশুকে যদি বোঝানো হয় জগতে শক্তি প্রয়োগই একমাত্র সম্পদ, তখন তার জ্ঞান বিকাশের জগতে পরিবর্তন ঘটতে থাকে।’
মনোবিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েডের মতে, অমানবিক নিষ্ঠুর আচরণের পেছনে থাকে মানুষের অবদমিত কামনা-বাসনা। অবচেতনে মানুষ যা কামনা করে, চেতন মনে সে তার শিক্ষা, সভ্যতা, সামাজিকতা আর নৈতিকতা দিয়ে সেগুলো ঢেকে রাখে। এই অবদমিত চাহিদাগুলো সরাসরি পূরণ হয় না বলে হিংস্রতা আর নৃশংসতার মধ্য দিয়ে ঘুরপথে পূরণ করার চেষ্টা চলে। তখনই নিষ্ঠুরতার প্রকাশ ঘটে।
মানুষের মধ্যে এই হিংস্রতার ব্যাখ্যায় মনোবিজ্ঞানীরা আরও বলেন, একজন মানুষ নিজের হতাশা থেকেই মূলত আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। নিজের হতাশা কাটাতে সে বেছে নেয় দুর্বল একজনকে। এই দুর্বলের ওপর হিংস্রতা দেখিয়ে সে এক ধরনের মানসিক আনন্দ লাভ করে ও হিংস্রতার স্বপক্ষে নিজস্ব যুক্তি তৈরি করে। এই তত্ত্বকে বলা হয় ‘ফ্রাস্টেশন-অ্যাগ্রেশন-হাইপোথিসিস’।
ভালোবাসা ও অর্থের অভাব, অর্থের প্রতি তীব্র আকর্ষণ, পরিবারিক অশান্তি, শিশুর প্রতি সহিংসতা, নিরাপত্তাহীনতা, পারস্পরিক অবিশ্বাস, অসুস্থ যৌনতা, সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অস্থিরতা, অল্প সময়ে ধনী হওয়ার আকাঙ্ক্ষা যতো বাড়ছে, মানুষ ততোই হিংস্র হয়ে উঠছে।
হত্যাকারীদের মধ্যে অনেক সময় এমন এক ধরনের গভীর রাগ, মানসিক চাপ, এবং ক্ষোভ তৈরি হয়- যা তারা অন্যের ওপর প্রকাশ করে। এই আবেগগুলো যখন দীর্ঘসময় ধরে জমা হয়, তখন তার সঙ্গে মানসিক চাপ যুক্ত হয়। বিশেষ কিছু মানসিক অসুস্থতা যেমন- অ্যান্টিসোশ্যাল পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার, সোশিওপ্যাথ, পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার এবং পারানয়েড ডিসঅর্ডার নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের একটি কারণ হতে পারে। যাদের এ ধরনের মানসিক সমস্যা রয়েছে, তারা সাধারণত অন্যদের অনুভূতি ও বোধকে অগ্রাহ্য করেন, তারা নিজেদের সুবিধার জন্য অন্যের ওপর অত্যাচার করতে বা অন্যকে হত্যা করতে পারেন। সোশিওপ্যাথরা কখনো কখনো, হত্যাকে আত্মহত্যার একটি বিকল্প পদ্ধতি মনে করেন। যেখানে অপরাধী নিজের যন্ত্রণা বা মনের ক্ষোভ মেটানোর জন্য অন্যকে মেরে ফেলতে পারেন।
পারিবারিক সহিংসতা, অবহেলা বা শোষণের শিকার হওয়া শিশু বড় হয়ে সহিংস আচরণ করতে পারে। শিশুরা যখন ঘরে ও বাইরে সহিংসতার শিকার হয় ও নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে- তখন তাদের মানসিক বিকাশ চরমভাবে বিঘ্নিত হয়। একসময় তারা সহিংসতা বা হত্যাকে স্বাভাবিক বলে মনে করে।
বাংলাদেশের সমাজে শ্রেণিভেদ চরম আকার ধারণ করছে। বাড়ছে মানসিক অস্থিরতা, বেকারত্ব, হতাশা, বিচারহীনতা; কমছে সামাজিক যোগাযোগ ও সম্পর্ক। ব্যক্তিগত জীবনের দুঃখ-কষ্ট মানুষকে একা ও আগ্রাসী করে তুলছে।
দেশে সম্প্রতি বিনা কারণে বা খুব ছোট কারণে পৈশাচিক কায়দায় মানুষ হত্যা করা হচ্ছে। আরও ভয়াবহ ব্যাপার হচ্ছে সেইসব পৈশাচিক দৃশ্য ভিডিও করে সামাজিকমাধ্যমে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে, যাতে অন্যরা দেখে বিকৃত আনন্দ পায় ও এক ধরনের অভ্যস্ততা তৈরি হয়। অপরাধ করে দিনের পর দিন যখন অপরাধীরা পার পেয়ে যায়, তখন একদিকে অপরাধী নিজেকে শক্তিশালী ভাবতে শেখে, অন্যদিকে সাধারণ মানুষের ভেতর এই ধারণা তৈরি হয় যে এভাবে অপরাধ করে, তারাও পার পেয়ে যেতে পারবেন।
আমাদের সামাজিক মূল্যবোধ দুর্বল হয়ে উঠছে, সোশ্যাল কন্সট্রাক্টগুলো আমরা হারিয়ে ফেলছি, বাড়ছে মাদক গ্রহণ। সোজা করে বলা যায়- সামাজিক সঙ্গ, আমাদের চিন্তা-ভাবনার বা সচেতন মনের বিচার এবং মনের গভীরের মূল্যবোধ- এই সর্বশেষ কারণটি সব বাহ্যিক প্রভাবের বাইরে। আমাদের যদি তৃতীয়টা না থাকে তাহলে আমরা ক্ষুব্ধ হয়ে বা মব প্ররোচিত হয়ে নিকৃষ্টতম অপরাধও করতে পারি, যা এখন আমরা অহরহ করছি।
তাহলে কি ‘আইয়ামে জাহেলিয়াত’ এর অন্ধকার যুগ ফিরে আসছে আমাদের সমাজে। মানুষকে পুড়িয়ে ঝুলিয়ে রাখা, মেরে সাত টুকরো করা, মৃত মানুষের মাথা ব্যাগে করে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো সবই জাহেলি যুগের বৈশিষ্ট্য। মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পেছনে অনেক কারণ দেখানো হয়। তবে এই ঘটনাগুলোকে শুধুমাত্র মনোবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করা কঠিন, কারণ এই অপরাধ একাধিক কারণ দ্বারা প্রভাবিত।
এ কারণে, নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের প্রতিকারেও সমন্বিত মনোবিদ্যা, সামাজিক সচেতনতা, শাস্তিমূলক ব্যবস্থা এবং রাষ্ট্রীয় নীতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। আমরা চাই সুস্থ মন, সুস্থ সমাজ। ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য এই নৃশংসতা ও বর্বরতা বন্ধ হোক। দেশের মানুষকে নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই মানবিক পথে ফিরতে হবে।
লেখক: যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও কলাম লেখক
ভোরের আকাশ/রন