দক্ষিণ এশিয়ায় জলবিদ্যুৎ শক্তি ব্যবহার করে একটি আঞ্চলিক গ্রিড গড়ে তোলার প্রস্তাব ক্রমেই আলোচনার কেন্দ্রে উঠে আসছে। সদ্য সমাপ্ত কপ-২৯ জলবায়ু সম্মেলনে আমাদের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সমন্বিত গ্রিড বা ‘দক্ষিণ এশিয়া গ্রিড’ তৈরির আহ্বান জানিয়েছেন। তার উপস্থাপনটি অভূতপূর্ব এবং যৌক্তিক বলা যেতে পারে।
দক্ষিণ এশিয়া একটি অত্যন্ত সমৃদ্ধ এবং বৈচিত্র্যময় অঞ্চল। এই অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সর্ম্পক এবং সহযোগিতার অভাব অনেক সময় উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে। তবে জলবিদ্যুৎ শক্তি একটি সম্ভাব্য ক্ষেত্র; যেখানে আঞ্চলিক সহযোগিতার মাধ্যমে বৃহত্তর সুবিধা লাভ করা সম্ভব। ভারত, নেপাল ও ভুটান, যাদের পাহাড়ি অঞ্চলে ব্যাপক জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে, তাদের শক্তি উৎপাদন পুরোপুরি বাস্তাবায়ন অন্য দেশগুলোর সহযোগিতা ছাড়া সম্ভব নয়। বাংলাদেশর ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান এবং এই অঞ্চলের জলসম্পদের ব্যবহারকে যদি প্রাধান্য দেওয়া হয়, তবে এটা প্রতীয়মান হতে পারে যে, দক্ষিণ এশিয়া একটি জলবিদ্যুৎ গ্রিড গঠনের জন্য উপযুক্ত এবং যৌক্তিক সময়ে পৌঁছেছে।
দক্ষিণ এশিয়ার বিদ্যুৎ চাহিদা ও উৎসের বৈষম্য: দক্ষিণ এশিয়ায় বিদ্যুৎ চাহিদা দ্রুত বাড়ছে। তবে এই অঞ্চলে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে বড় বৈষম্য রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, নেপাল এবং ভুটানে প্রাকৃতিকভাবে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের বিপুল সম্ভাবনা থাকলেও, তারা তাদের দেশের চাহিদার বেশি উৎপাদন করতে পারছে না। অন্যদিকে, ভারত এবং বাংলাদেশ বিদ্যুতের বড় ভোক্তা, কিন্তু তাদের নিজস্ব জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা সীমিত। এক্ষেত্রে, জলবিদ্যুৎ শক্তি একটি উপযুক্ত বিকল্প হতে পারে, যেখানে উজানের দেশ নেপাল এবং ভুটান তাদের সম্পদ ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে এবং বাংলাদেশ, ভারতসহ অন্যান্য দেশগুলো এই বিদ্যুৎ ব্যবহার করতে পারবে আমদানির মাধ্যমে।
আঞ্চলিক সহযোগিতা এবং সাশ্রয়ী জলবিদ্যুতের ব্যবহার: দক্ষিণ এশিয়ার জলবিদ্যুৎ সম্ভাবনাকে একত্রিত করার মাধ্যমে একটি আঞ্চলিক গ্রিড গঠন করা সম্ভব; যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে সাশ্রয়ী জলবিদ্যুতের ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারে। বর্তমানে, জলবিদ্যুৎ উৎপাদনে নানা সীমাবদ্ধতার কারণে অনেক দেশ তাদের সম্ভাবনার পূর্ণ ব্যবহার করতে পারছে না। একদিকে নেপাল ও ভুটান তাদের বিপুল জলবিদ্যুৎ সম্ভাবনা সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারছে না, অন্যদিকে ভারত এবং বাংলাদেশে প্রয়োজনের তুলনায় জলবিদ্যুৎ উৎপাদনে সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
একটি গ্রিড গঠন করে, এই দেশগুলো একে অপরের বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ করতে পারবে বলে ধরে নেওয়া যায়। একদিকে নেপাল এবং ভুটান তাদের অতিরিক্ত বিদ্যুৎ অন্য দেশগুলোতে সরবরাহ করবে, অন্যদিকে ভারত এবং বাংলাদেশ নিজেদের চাহিদা মেটাতে সাশ্রয়ী মূল্যে বিদ্যুৎ পাবে। এভাবে, দক্ষিণ এশিয়ায় জলবিদ্যুৎ উৎপাদন এবং ব্যবহারের মধ্যে ভারসাম্যে পরিকল্পনা করা সম্ভব হতে পারে।
পরিবেশগত সুবিধা: দক্ষিণ এশিয়ায় জলবিদ্যুতের উৎপাদন পরিবেশগতভাবে টেকসই, কারণ এটি জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমাতে সাহায্য করবে। জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের মাধ্যমে, দেশের কার্বন নির্গমণ কমানো সম্ভব; যা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সহায়ক। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে থাকা বাংলাদেশের জন্য এই ধরনের সহযোগিতা বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। উপরন্তু, জলবিদ্যুৎ এক ধরনের ‘সবুজ জ্বালানি’ এবং এর পরিবেশগত ক্ষতি অন্যান্য জ্বালানির উৎসের তুলনায় অনেক কম। তাই দক্ষিণ এশিয়ায় একটি জলবিদ্যুৎ গ্রিড তৈরি হলে শুধু জ্বালানি সংকটেরই সমাধান হবে না বরং এটি একটি টেকসই সমাধানে পরিণত হবে।
অর্থনৈতিক লাভ এবং আঞ্চলিক ঐক্য: দক্ষিণ এশিয়ায় জলবিদ্যুৎ গ্রিড তৈরি হলে, এটি আঞ্চলিক অর্থনীতিকে শক্তিশালী করবে। জলবিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য ট্রানজিট ফি এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক সুবিধা বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশগুলোর জন্য একটি বড় সুযোগ হয়ে উঠবে। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশসহ যে দেশের ভূখণ্ডের মধ্য দিয়ে অন্য দেশের জলবিদ্যুৎ গ্রিড চলাচল করবে, ওই দেশটি ট্রানজিট ফি আদায় করতে পারবে; যা দেশের অর্থনীতির জন্য লাভজনক হবে। আমরা বহুল আলোচিত নর্ডস্ট্রিমের উদাহরণ দিতে পারি। এছাড়া, একটি শক্তিশালী আঞ্চলিক গ্রিড আঞ্চলিক ঐক্য ও সহযোগিতা বৃদ্ধি করবে; যা দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতা এবং শান্তির পথে সহায়ক হবে। দেশগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা সহজ হবে।
আন্তর্জাতিক আইন এবং ন্যায্য ব্যবহারের দাবি: বাংলাদেশের ভূখণ্ড দিয়ে বিশ্ববিখ্যাত তিনটি নদী গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র এবং মেঘনা প্রবাহিত এবং এর পানি ব্যবহারে ন্যায্য অধিকারী। আন্তর্জাতিক আইন যেমন- ‘হেলসিংকি রুলস’ (১৯৬৬) এবং ‘জাতিসংঘের জলস্রোত কনভেনশন’ (UN Watercourses Convention 1997) বলছে যে, একটি নদী বা পানিসম্পদের ওপরে বিভিন্ন দেশের অধিকার থাকতে পারে। তবে প্রতিটি দেশকেই ‘ন্যায্য এবং সঙ্গতভাবে’ পানিসম্পদের ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
এই আইন অনুযায়ী, বাংলাদেশ এই পানিসম্পদের ন্যায্য অংশীদার হতে পারে এবং তার অংশে উৎপাদিত জলবিদ্যুৎ ব্যবহারের মাধ্যমে বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণ করতে পারে। অন্যদিকে, বাংলাদেশের ভূখণ্ডে প্রবাহিত এসব নদীর পানি অন্যান্য দেশের জলের ব্যবহারকে প্রভাবিত করতে পারে, তাই দক্ষিণ এশিয়ার জলবিদ্যুৎ গ্রিড গঠন একটি আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি সম্মান দেখানোর একটি উপায় হতে পারে।
বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক ভূমিকা: বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানে রয়েছে, কারণ দেশের নদীগুলোর প্রবাহ আসছে প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্য দিয়ে। এই কারণে, বাংলাদেশের অংশগ্রহণ ছাড়া দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের জলবিদ্যুৎ সম্ভাবনা পুরোপুরি বান্তবায়ন করা হয়তো সম্ভব নয়। দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সৌহার্দ্যের অনুপস্থিতি এই মহান উদ্যোগের অন্তরায় হতে পারে। আন্তঃদেশীয় নদীগুলো কোনো একটি দেশকে বেশি সুবিধা দিতে বাধ্য। যদি না দেশগুলোর মধ্যে সমঝোতা এবং দ্বিপক্ষীয় উন্নয়ননীতি অভিন্ন না হয়। এর ফলে উজানের দেশগুলো তুলনামূলকভাবে বেশি সুফল পাবে বা পেতে পারে। আবার ভাটি অঞ্চল ওই একই নদীকেন্দ্রিক সমস্যাগুলোর সম্মুখীন হতে পারে।
ট্রান্সবাউন্ডারি নদী নিয়ে আমাদের আলোচনা, পর্যালোচনা কেবল পানিবণ্টনে সীমাবদ্ধ থাকা যৌক্তিক নয়। যদিও সুষম পানি বণ্টন অন্যতম প্রধান ইস্যু। তদুপরি, নদীবিধৌত অর্থনীতি, পরিবেশ দূষণের মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো উপেক্ষিত রয়ে যায় বা গেছে। দক্ষিণ এশিয়ার জলবিদ্যুৎ গ্রিড গঠন শুধু বিদ্যুৎ উৎপাদন ও ব্যবহারের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং এটি আঞ্চলিক সহযোগিতা, পরিবেশগত সুরক্ষা, অর্থনৈতিক উন্নতি এবং আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি সম্মান দেখানোর একটি কার্যকর পদক্ষেপ হতে পারে। জলবিদ্যুৎ শক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হতে পারে, যার ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান এবং জলসম্পদের প্রতি ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করতে দক্ষিণ এশিয়ায় একটি শক্তিশালী গ্রিড গঠন অপরিহার্য। শুধু বিদ্যুতের জন্য নয়, বরং এটি হবে সুষম উন্নয়ন ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার প্রতীক।
লেখক: ইন্টারন্যাশনাল কোস্টাল ক্লিআপর বাংলাদেশের সমন্বয়ক
ভোরের আকাশ/রন