বাংলাদেশের স্থলবন্দরগুলো দিয়ে মূলত ভারত প্রবেশ করা যায়। কিন্তু জুলাই আন্দোলনের পর থেকে ভ্রমণ ভিসা বন্ধ রেখেছে ভারত। কেবল মাত্র স্টুডেন্ট এবং চিকিৎসা ভিসা দিচ্ছে, তাও হাতে গোনা। ফলে সবগুলো বন্দর দিয়েই যাতায়াত কমেছে অনেক। ফলে ‘ভ্রমণকর’ও আসছে না, ফলে বাংলাদেশের আয় কমে গেছে। মানিচেঞ্জার থেকে শুরু করে দূরপাল্লার পরিবহন কাউন্টার, ট্যুর গাইড, ভিসা সহায়তা কেন্দ্র, বাস-ট্রেন-প্লেনের টিকিট বুকিং এজেন্সি এবং হোটেল, রেস্তোরাঁসহ ছোটখাটো এসব প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা-বাণিজ্য পুরোপুরিই চেকপোস্ট ব্যবহারকারী যাত্রীদের ওপর নির্ভরশীল। এখন যাত্রী কমে যাওয়ায় প্রতিষ্ঠানগুলোও চরম দুঃসময় পার করছে। বড় ধাক্কা লেগেছে তাদের ব্যবসায়।
কাস্টমস কর্তৃপক্ষ বলছে, আগে এ বন্দর দিয়ে দুই দেশের মধ্যে প্রতিদিন সাত থেকে নয় হাজার যাত্রী পারাপার হতো, ভ্রমণ কর থেকে প্রতিমাসে রাজস্ব আয় হতো গড়ে ১৫ কোটি টাকার। কিন্তু ৫ অগাস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে প্রতিদিন যাত্রী পারপার নেমেছে পাঁচ হাজারে। আর বর্তমানে রাজস্ব আদায় হচ্ছে মাসে আট কোটি টাকা।
স্থলপথে দেশের সবচাইতে বড় আন্তর্জাতিক চেকপোস্ট বেনাপোল থেকে ভারতের কলকাতার দূরত্ব ৮৪ কিলোমিটার। দূরত্ব কম ও যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো হওয়ায় স্থলপথের অধিকাংশ যাত্রীই এ চেকপোস্ট দিয়ে ভারত যেতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। আর ভারত-বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের যাতায়াতকারী এই মানুষদের সহযোগিতার জন্য বেনাপোল চেকপোস্টে এলাকায় গড়ে উঠেছে নানা প্রতিষ্ঠান।
বেনাপোল সোহাগ পরিবহনের স্থানীয় অফিস ব্যবস্থাপক শহিদুল ইসলাম বলেন, আগে যেখানে প্রতিদিন বেনাপোল থেকে দেড়শ দূরপাল্লার বাস বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় উদ্দেশে ছেড়ে যেত। এখন সেখানে ২০ থেকে ৩০টা বাস ছেড়ে যাচ্ছে। তারপরও অধিকাংশ বাসই খালি যাচ্ছে। পরিবহন ব্যবসা টিকিয়ে রাখতেই কোম্পানির মালিকরা লসের টাকা মাথায় নিয়েই পরিবহন ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। ভারতীয় ‘ভ্রমণ ভিসা’ প্রদান শুরু না হলে খুব শিগগিরি পরিবহন ব্যবসা বেনাপোল থেকে গুটিয়ে নিতে হবে।
চেকপোস্টের রাজা-বাদশা মানিচেঞ্জারের মালিক আবুল বাশার বলেন, আমরা সাধারণত এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ব্যবসায়ী ও ভারত যাতায়াতকারী পাসপোর্ট যাত্রীদের টাকা এক্সচেঞ্জ করে থাকি। এদের যাতায়াত কমে গেলে আমাদের কাজও কমে যায়।চেকপোস্টের ব্যবসায়ী শামীম হোসেন বলেন, চেকপোস্ট এলাকায় অন্তত চার শতাধিক বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে। যারা শুধুমাত্র পাসপোর্ট যাত্রীদের ওপর নির্ভরশীল। স্থানীয়রা খুব বেশি পণ্য কিনতে এখানে আসে না। পাসপোর্ট যাত্রী কমে যাওয়ায় অনেকের ব্যবসা গুটিয়ে নিতে হচ্ছে।
বেনাপোল আন্তর্জাতিক চেকপোস্ট ইমিগ্রেশন ওসি ইমতিয়াজ মো. আহসানুল কাদের ভূঁইয়া প্রতিবেদককে জানান, স্বাভাবিক সময়ে বেনাপোল দিয়ে প্রতিদিন গড়ে সাড়ে ৪ হাজার থেকে পাঁচ হাজার যাত্রী ভারতে যেত। এখন সেটা কমে গড়ে দেড় হাজার থেকে দুই হাজারে এসে দাঁড়িয়েছে।
এদিকে, বাংলাদেশ ভারত চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির ডিরেক্টর মতিয়ার রহমান বলেন, ভিসাকেন্দ্রগুলো এখন কেবল জরুরি মেডিকেল ও স্টুডেন্ট ভিসার জন্য সীমিত পরিসরে সøট দিচ্ছে। ব্যবসা ও ভ্রমণ ভিসার যাত্রীদের সংখ্যা নেই বললেই চলে। ভারত সরকার ব্যবসা (বিজনেস) ভিসা না দেওয়ায় বেকায়দায় পড়েছেন তারা। এর প্রভাব স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যেও পড়তে শুরু করেছে।
আমদানি-রপ্তানিকারক আবু নিদাল ফয়সল জানান, প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে যেসব পণ্য আমদানি করা হয় তা কেনার আগে দেশটির বিভিন্ন জায়গাতে গিয়ে বিভিন্ন ধরনের পণ্য পছন্দ করে থাকেন তারা। কিন্তু ভিসা জটিলতার কারণে এখন তারা এ কাজ করতে পারছেন না। ফলে অনেকেই ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছেন।
এদিকে, ভারতের সাতটি প্রদেশ-অরুণাচল,মেঘালয়, মণিপুর, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, আসাম এবং ত্রিপুরা জাতিগত ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনের কারণে একত্রে সেভেন সিস্টার্স নামে পরিচিত। আর এ সেভেন সিস্টার্সের অন্যতম প্রবেশদ্বার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া স্থলবন্দর। তবে ভারতীয় ভিসা জটিলতাসহ নানা কারণে সদ্য সমাপ্ত (২০২৩-২৪) অর্থবছরে আগের অর্থবছরের তুলনায় যাত্রী পারাপার কম হলেও বেড়েছে ভ্রমণকর বাবদ রাজস্ব আদায়।
আখাউড়া স্থল শুল্ক স্টেশনের তথ্যমতে ২০২২-২৩ অর্থবছরে এ বন্দর দিয়ে যাত্রী পারাপার হয় ২ লাখ ৬০ হাজার ৬৬ জন। এসময় ভ্রমণকর বাবদ রাজস্ব আদায় হয়েছিল ৭ কোটি ৮৫ লাখ ১৫ হাজার টাকা। আর সদ্য সমাপ্ত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এ বন্দর ব্যবহার করে যাত্রী পারাপার হয়েছে ২ লাখ ৫ হাজার ১৯ জন। এতে করে সরকার ভ্রমণকর হিসেবে রাজস্ব পেয়েছে ১৩ কোটি ৯১ লাখ ৫২ হাজার ৫০০ টাকা।২৩-২৪ অর্থবছরে ভ্রমণকর পাঁচশত টাকা থেকে বাড়িয়ে ১ হাজার টাকা করেছে সরকার।
মূলত বন্দর পার হলেই ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলা শহর। আর শহর থেকে খুব কাছেই বিমানবন্দর ও রেলওয়ে স্টেশন। ফলে সম্ভবাবনাময় আখাউড়া স্থলবন্দর ব্যবহার করে ভারতগামী যাত্রীদের আগ্রহ রয়েছে। কিন্তু আগরতলা স্থলবন্দরের অলিখিত কিছু পলিসির কারণে যাত্রী পারাপার কিছুটা কমেছে। আখাউড়া ইমিগ্রেশন চেকপোস্টের ওসি মো. খাইরুল আলম বলেন, সম্ভবাবনাময় আখাউড়া স্থলবন্দর ব্যবহার করে ভারতগামী যাত্রীদের আগ্রহ রয়েছে।কিন্তু আগরতলা স্থলবন্দরের অলিখিত কিছু পলিসির কারণে যাত্রী পারাপার কিছুটা কমেছে। আখাউড়া স্থল শুল্ক স্টেশনের রাজস্ব কর্মকর্তা আব্দুল কাইয়ুম তালুকদার বলেন, বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম স্থলবন্দর আখাউড়া। ভৌগোলিক অবস্থানের ফলে এ বন্দর ব্যবহারে দিনদিন যাত্রীদের আগ্রহ বাড়ছে।
ভোরের আকাশ/রন