logo
আপডেট : ২৩ নভেম্বর, ২০২৪ ১০:৪২
বিশ্বের সামনে দুই বিশ্বযুদ্ধ
দীর্ঘ ভোগান্তির আশঙ্কা
আব্দুর রহিম

বিশ্বের সামনে দুই বিশ্বযুদ্ধ

৫ নভেম্বর বিশ্বের জন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ দিন ছিল। এটা ছিল আশান্বিত হওয়ার দিন। এদিন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, তিনি নতুন করে কোনোও যুদ্ধ শুরু করবেন না। তিনি সব যুদ্ধ থামিয়ে দিবেন। তবে এর আগে তিনি বলেছিলেন ‘আমেরিকা ফার্স্ট’।

তার এই দুটি বাক্য অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ অর্থ বহন করে।

প্রথমত, ডোনাল্ড ট্রাম্প যুদ্ধ থামিয়ে দেওয়ার কথা বলেছেন। হয়তো তিনি সেটা করবেন এবং তিনি সেটা পারবেন। কিন্তু তার আগেই তো তার উত্তর ও পূর্বসূরি জো বাইডেন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বাজিয়েছেন। গত সপ্তাহে তিনি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের আগুনে ঘি ঢেলে দিয়েছেন। তিনি ইউক্রেনকে মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্র রাশিয়ার অভ্যন্তরে হামলা করার অনুমতি দিয়েছেন। এর পরই জেলেনস্কির উত্তেজনার পারদ উঠে গেছে কয়েক ডিগ্রি। তিনি এই অস্ত্র দিয়ে রাশিয়ার অভ্যন্তরে হামলা করবেন কি না- সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে তিনি বলেছেন, অস্ত্রগুলো নিজেরাই কথা বলবে। এর দুই দিন পর ইউক্রেন মার্কিন অস্ত্র দিয়ে রাশিয়ার অভ্যন্তরে হামলা চালায়। পাল্টা জবাব দিয়েছে মস্কো। হামলা জোরদার করেছে রুশ বাহিনী। দোনেৎস্ক অঞ্চলে ইউক্রেনের কয়েকটি গ্রাম রুশ বাহিনী দখল করে নিয়েছে। এর আগে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন পরমাণু অস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছেন। যদিও মস্কো এখনও পরমাণু হামলা করেনি। তবে রাশিয়ার হামলার আশঙ্কায় কিছুটা ভয় আমেরিকা পেয়েছে। এরই মধ্যে হামলার আশঙ্কায় কিয়েভে মার্কিন দূতাবাস বন্ধ করে দিয়েছে ওয়াশিংটন। ইউরোপে মার্কিন মিত্রদের স্থাপনায় হামলার আশঙ্কা রয়েছে।

পুতিন বলেছেন, ইউক্রেন সংঘাত এখন একটি আঞ্চলিক যুদ্ধ থেকে বৈশ্বিক সংঘাতে পরিণত হওয়ার পথে রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য ইউক্রেনকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে তাদের অস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি দেওয়ার পর এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার তিনি পশ্চিমাদের হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, রাশিয়া পাল্টা আঘাত করতে প্রস্তুত। পুতিন বলেছেন, রাশিয়া ইতোমধ্যে একটি নতুন ধরনের মাঝারি পাল্লার হাইপারসনিক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে ইউক্রেনের একটি সামরিক স্থাপনায় আঘাত হেনেছে। ভবিষ্যতে আরও এমন আক্রমণ হতে পারে। তবে তিনি জানান, এসব আঘাতের আগে বেসামরিক জনগণকে সতর্ক করা হবে। তিনি বলেছেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রশাসনের অনুমোদনে ইউক্রেন নভেম্বরের ১৯ তারিখে ছয়টি এএটিএসএমএস এবং ২১ নভেম্বর ব্রিটিশ স্টর্ম শ্যাডো ও মার্কিন হিমার্স ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে রাশিয়ায় হামলা চালায়। এরপর থেকেই আঞ্চলিক সংঘাত বৈশ্বিক রূপ নিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বকে একটি বৈশ্বিক সংঘাতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

পুতিন হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, যদি আগ্রাসী কার্যক্রম বৃদ্ধি পায়, আমরা সমানভাবে প্রতিক্রিয়া জানাব। তার ভাষ্য, মার্কিন এএটিএসএমএস দিয়ে চালানো ইউক্রেনীয় হামলায় তেমন কোনও ক্ষতি করতে পারেনি। তবে ২১ নভেম্বর স্টর্ম শ্যাডো ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে কুরস্ক অঞ্চলে একটি কমান্ড সেন্টারে হামলা চালানো হয়েছে। এতে প্রাণহানি ও কয়েকজন আহত হয়েছেন। শত্রুর এমন অস্ত্র ব্যবহার সামরিক কার্যক্রমের গতিপথ বদলাতে পারবে না।

পুতিন বলেন, যেসব দেশ তাদের অস্ত্র আমাদের সামরিক স্থাপনায় ব্যবহারের অনুমতি দিচ্ছে, তাদের সামরিক স্থাপনাগুলোতে আঘাত করার অধিকার রাশিয়ার রয়েছে। কেউ যদি এটি নিয়ে সন্দেহ করে, তবে তারা ভুল করছে। এর প্রতিক্রিয়া অবশ্যই হবে। রাশিয়া বর্তমানে ইউক্রেনের ১৮ শতাংশ ভূখণ্ড নিয়ন্ত্রণ করছে। এর মধ্যে রয়েছে পুরো ক্রিমিয়া, ৮০ শতাংশ ডনবাস অঞ্চল এবং জাপোরিজ্জিয়া ও খেরসন অঞ্চলের ৭০ শতাংশের বেশি ভূখণ্ড। ইউক্রেন ও পশ্চিমারা রাশিয়ার এই কর্মকাণ্ডকে সাম্রাজ্যবাদী ভূখণ্ড দখলের চেষ্টা হিসেবে দেখছে এবং আশঙ্কা করছে, ইউক্রেন জয়ী হলে রাশিয়া ন্যাটোর কোনও সদস্য দেশেও আক্রমণ করতে পারে। পুতিন বলেছেন, রাশিয়া সম্প্রতি ‘ওরেশনিক’ নামে একটি নতুন মাঝারি পাল্লার হাইপারসনিক নন-নিউক্লিয়ার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা করেছে। ইউক্রেনের ডনিপ্রো শহরে অবস্থিত একটি ক্ষেপণাস্ত্র ও মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র এই হামলার লক্ষ্যবস্তু ছিল। তিনি দাবি করেছেন, এই আঘাত সফল হয়েছে।

পুতিন যুক্তরাষ্ট্রের ২০১৯ সালে ইন্টারমিডিয়েট-রেঞ্জ নিউক্লিয়ার ফোর্সেস (আইএনএফ) চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেন, মার্কিন পদক্ষেপ একটি বড় ভুল। রাশিয়া একতরফাভাবে আইএনএফ চুক্তির আওতায় থাকা ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি বন্ধ রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। তবে পুতিন বলেন, আমাদের ভবিষ্যৎ পদক্ষেপ পশ্চিমাদের কার্যক্রমের ওপর নির্ভর করবে।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, পুতিনের সাম্প্রতিক মন্তব্য ইউক্রেন সংঘাতকে আরও জটিল ও বিপজ্জনক অবস্থায় নিয়ে যাচ্ছে। পশ্চিমা অস্ত্রের ব্যবহার এবং রাশিয়ার পাল্টা হামলা বিশ্বকে নতুন এক সংঘাতময় পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

আবার আসি ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমেরিকা ফার্স্ট প্রসঙ্গে। তিনি অবৈধ অভিবাসী তাড়ানোর পক্ষে রয়েছেন। এটা তো স্বাভাবিক ব্যাপার। শুধু তিনি কেন যে কোনও রাষ্ট্র বা সরকার প্রধান তার দেশে অবৈধভাবে বসবাসকারী ব্যক্তিকে নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে পারেন কিংবা আইনি ব্যবস্থা নিতে পারেন। তো তিনি বলতেই পারেন আমেরিকা ফার্স্ট। অর্থাৎ আগে আমেরিকা পরে অন্যদেশ। তিনি অবশ্য অভিবাসীর বিষয়টি বোঝাননি। তিনি বুঝিয়েছেন বাণিজ্যকে। এর আগের শাসনামলে তিনি সামরিক যুদ্ধ করেননি। তবে তিনি বাণিজ্য যুদ্ধ করেছেন। তিনি চীনা পণ্যে মাত্রাতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করেছিলেন। পাল্টা ব্যবস্থা নিয়েছিল চীনও। এবারও হয়তো তিনি নিজ দেশের শিল্প প্রসারে অন্যদেশের পণ্যে মাত্রাতিরিক্ত শুল্ক বসাবেন। অন্যরাও একই পদক্ষেপ নেবেন। ফলে দুর্ভোগে পড়বেন বিভিন্ন দেশের মানুষ। বিশ্লেষকরা বলছেন, বিশ্ব অর্থনীতির অঙ্গনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সম্ভাব্য বাণিজ্যযুদ্ধ এক বিস্ময়কর এবং বিতর্কিত কৌশল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। একদিকে চীনের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধ ঘোষণা করে ট্রাম্প প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রের শিল্প ও বাণিজ্যক্ষেত্রে সুরক্ষা দিতে চায়, অন্যদিকে এই পদক্ষেপ নিজ দেশের জনগণের জন্যও এক অনিশ্চিত অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ বয়ে আনতে পারে। এই সিদ্ধান্ত কী সত্যিই যুক্তরাষ্ট্রের শিল্প পুনর্জাগরণে সহায়ক হবে, নাকি এটি মুদ্রাস্ফীতি ও বেকারত্বের জোয়ারে দেশকে ভাসিয়ে দেবে? ট্রাম্পের সমরযুদ্ধের প্রতি তার কোনো আগ্রহ নেই। তার যত চিন্তা বাণিজ্যযুদ্ধকে ঘিরে। যুক্তরাষ্ট্র সকল আমদানি দ্রব্যে ১০-২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করতে পারে। তবে এটা চীনের পণ্যে হবে সর্বোচ্চ ৬০ থেকে ১০০ শতাংশ। বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপি প্রায় ২৮ ট্রিলিয়ন ডলার। তাদের এমন মনোভাবে চীনসহ অন্য দেশগুলোর জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেননা, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তো বাণিজ্য করতেই হবে। এ কারণে রপ্তানিনির্ভর প্রায় সকল দেশকেও নিজ নিজ বাণিজ্য নীতিতেও পরিবর্তন আনতে হবে। বিশ্বের সব দেশের জনগণকে দ্রব্যমূল্যের উলম্ফন নিয়ে ভুগতে হবে। এ থেকে বাদ যাবেন না মার্কিন জনগণও। এটা ট্রাম্পের জন্য বুমেরাং হতে পারে। অবশ্য বিষয়টি ট্রাম্প প্রশাসনকে ভাবতে হবে। কেননা, আগের মেয়াদে এ ইস্যুতে তার অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। গতবার যখন ট্রাম্প আমদানি করা পণ্যে অতিরিক্ত বিক্রয় কর আরোপ করেন; তখন ধরে নেওয়া হয়েছিল মানুষ এগুলো কেনা থেকে বিরত থাকবে। মানুষ নিজেদের দেশে তৈরি পণ্য কিনবে। দেশীয় পণ্যের চাহিদা বাড়বে। বাড়বে উৎপাদন। কারখানায় বাড়তি লোক নিয়োগ হবে। নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। বেকারত্ব কমে যাবে। আরও শক্তিশালী হবে অর্থনীতি। বাস্তবে সেটা হয়নি।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক।

 

ভোরের আকাশ/রন