logo
আপডেট : ২৪ নভেম্বর, ২০২৪ ১০:২৪
বাজারের আগুন যেন ছড়িয়ে না পড়ে
তারেক অপু

বাজারের আগুন যেন ছড়িয়ে না পড়ে

কে ক্ষমতায় এলো আর কে গেল, তা নিয়ে ভাবেন এদেশের খুব কম সংখ্যক মানুষ। তবে একটা জিনিস নিয়ে প্রায় সবাই ভাবেন। সেই জিনিসটা কী? সেটা হলো পণ্যের মূল্য। বর্তমানে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে যে অধিকাংশ মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে; তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিছুদিন আগে মাছ রাঙা টেলিভিশনে একটি খবর প্রকাশ করা হয়। সেখানে এক ব্যক্তি দ্রব্যমূল্য নিয়ে কথা বলতে গিয়ে এক পর্যায়ে কেঁদে ফেলেন। তার প্রশ্ন- জিনিসপত্রের এতো দাম। বাঁচবো কী খেয়ে? তিনি প্রকাশ্যে কেঁদেছেন। অনেকে কাঁদছেন গোপনে। হয়তো তার মতো অনেকেই প্রশ্ন করছেন- বাঁচব কেমন করে?

৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অনেক কিছু বদলে গেছে। বদলেছে বাজারের চিত্রও। তবে জিনিসপত্রের দাম কমেনি, উল্টো বেড়েছে। সরকার পতনের দুই-তিন দিনের মাথায় জিনিসপত্রের দাম কিছুটা কমে যায়। তখন ব্যবসায়ীরা বলে ছিলেন- এতোদিন ঘাটে ঘাটে চাঁদাবাজি হতো। সিন্ডিকেট ছিল। এগুলোর নেতৃত্বে ছিল আওয়ামী লীগ। শুধু কারওয়ান বাজার থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী (এখন পলাতক) আসাদুজ্জামান খান কামাল দিনে দেড় কোটি টাকা নিতেন- এমন খবর এসেছে গণমাধ্যমে। চাঁদাবাজি আর সিন্ডিকেটের কারণে জিনিসপত্রের দাম কমানো যাচ্ছিল না। সরকার পতনের পর চাঁদাবাজি হচ্ছে না। ফলে জিনিসপত্রের দাম কমেছে। একই ধরনের কথা বলা হয়েছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন আর অন্তর্বর্তী সরকারের তরফে। তাদের কথায় মানুষ আশান্বিত হয়েছিল। তবে সেই আশা দূরাশায় পরিণত হতে খুব বেশি সময় লাগেনি। মাত্র ৫ থেকে ৭ দিনের মাথায় সবজির দাম বেড়ে যায় অস্বাভাবিক হারে। তখন এ নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেন খোদ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। তারা বাজার মনিটরিং শুরু করেন। কয়েকটি বাজারে গিয়ে তারা পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দেন। কিন্তু সেটা খুব কাজে আসেনি। বাজারে শীতের সবজি চলে এসেছে। এখনো একশ টাকা কেজির ওপরে অনেক সবজি। ৮০ টাকা কেজি বেশিরভাগ সবজি। কাঁচা পেঁপের কেজিও ২৫-৩০ টাকা। এখানেই শেষ নয়; একটা সময় বলা হতো অতিরিক্ত আলু খেয়ে ভাতের চাপ কমান। এখন সেই আলুর কেজি ৭০ টাকা; যা ছাড়িয়ে গেছে চালের দামকে। কয়েক দিন আগে দৈনিক ভোরের আকাশের প্রতিবেদনে বলা হয়, মুন্সীগঞ্জে হিমাগারের প্রতিকেজি আলুর দাম ২৮ টাকা। অথচ ঢাকায় সেই আলু বিক্রি হচ্ছে ৭০ টাকা। মাত্র ৭০ কিলোমিটার রাস্তা যেতেই আলুর দাম দ্বিগুণের বেশি হয়ে যায়! কারা এর সঙ্গে জড়িত? সরকারের গোয়েন্দা সংস্থা কিংবা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর কি সেটা জানে না? কারা সাধারণ মানুষের পকেট কাটছে; সেই খবর কী সরকার জানে না? অবশ্যই জানে। তাহলে ব্যবস্থা নিচ্ছে না কেন- এই প্রশ্ন তো করাই যায়। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর কেজিতে চালের দাম বেড়েছে ৪ থেকে ৫ টাকা। আচ্ছা, সবজি না হয় যখন উৎপাদন, তখন বিক্রি। এ কারণে দাম কমবেশি হয়। কিন্তু চাল তো অনেক আগেই উৎপাদন করা হয়েছে। তাহলে কেন সরকার পরিবর্তন হওয়ার পর এর দাম বাড়ল? এই প্রশ্নের উত্তর কে দেবেন? সরকার অবশ্য নানা চেষ্টা করছে বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে; কিন্তু পারছে না। কয়েকদিন আগে সরকারের একজন উপদেষ্টা বলেছেন, আমন ধান বাজারে এলে চালের দাম কমতে পারে। তার মানে যতদিন আমন ধান বাজারে আসবে না, ততদিন চালের দাম কমবে না। আর আমন ধান বাজারে এলেই চালের দাম কমবে; তিনি কী সেই গ্যারান্টি দিতে পারবেন?

সরকারের হিসেবেই গত মাসে (অক্টোবর) মূল্যস্ফীতি আবারো দুই অংক ছাড়িয়ে দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশে। এর মধ্যে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয়েছে ১২ দশমিক ৬৬ শতাংশ। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর এটিই মূল্যস্ফীতির সর্বোচ্চ হার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ৮ নভেম্বর প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবর শেষে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশে; যা এর আগের মাসে ছিল ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। গত মাসে দেশে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১২ দশমিক ৬৬ শতাংশ এবং খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৩৪ শতাংশে। আর সেপ্টেম্বরে এ হার খাদ্যপণ্যে ছিল ১০ দশমিক ৪০ শতাংশ ও খাদ্যবহির্ভূত পণ্যে ৯ দশমিক ৫০ শতাংশ। এ সময় শহরের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে মূল্যস্ফীতির তীব্রতা বেড়েছে। অক্টোবরে শহরাঞ্চলে মূল্যস্ফীতির হার ১০ দশমিক ৪৪ শতাংশ। গ্রামাঞ্চলে তা ১১ দশমিক ২৬ শতাংশে। কয়েকদিন আগে বিডিনিউজের খবরে বলা হয়, মানুষ সঞ্চয় করতে পারছে না। জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতেই সব শেষ। অনেক ক্ষেত্রে মানুষ দেনা হচ্ছে। এখন কথা হলো সরকার পণ্যমূল্য কমানোর চেষ্টা করছে কি না। হ্যাঁ, করছে। তবে অসাধু ব্যবসায়ীদের সরকার বাগে আনতে পারছে না। দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখতে এবং দৈনন্দিন দরকারি পণ্যের দাম যাতে যৌক্তিক পর্যায়ে থাকে সে জন্য বাজার তদারকি করতে জেলায় জেলায় বিশেষ টাস্কফোর্স করেছে সরকার। সেই টাস্কফোর্স কাজও করছে। তবে খুব একটা ফল আসছে না।

যদিও বিশ্লেষকরা বলছেন বাজারে পণ্য সরবরাহ ঠিক রাখা ও দাম যৌক্তিক পর্যায়ে রাখার কার্যকর মেকানিজম বা কৌশল না থাকার সুযোগ নিয়ে দাম বাড়াচ্ছেন এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী। এ সমস্যার ‘স্থায়ী বা দীর্ঘমেয়াদী’ সমাধান টাস্কফোর্স দিয়ে সম্ভব হবে বলে মনে করেন না তারা।

ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ বা ক্যাবের সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির ভুঁইয়া বলছেন, বাজার পরিস্থিতি দেখে তাদের কাছে মনে হয়েছে যে দাম বাড়াচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীরা।

বর্ষা-বন্যার কারণে দাম হয়ত কিছুটা বাড়ত। কিন্তু যেভাবে বাড়ানো হয়েছে সেটা কারসাজি। আশা করছি টাস্কফোর্সের মনিটরিং শুরু হলে এর সুফল পাওয়া যাবে। যদিও অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলছেন, বাজারের সংকট অনেক গভীর এবং ছোটখাটো যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তাতে আপাতত কিছুটা লাভ হলেও দীর্ঘমেয়াদে লাভ হবে না।

গত কিছুদিন ধরেই গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপকভাবে আলোচনায় এসেছে ডিম আর কাঁচামরিচের দাম। যে ডিম ১১ টাকা পিস বিক্রি হতো; তা হঠাৎ করে ১৫ টাকা হয়ে যায়। অর্থাৎ এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী এখন টাকা ইনকামের মোক্ষম সময় মনে করছেন। পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে সাড়ে চার কোটি ডিম আমদানির জন্য সাময়িকভাবে অনুমতি দিয়েছে। এর আগে বেনাপোল বন্দর দিয়ে ভারত থেকে এসেছে কয়েক লাখ পিস ডিম। আপাতত ডিমের দাম কিছুটা কমেছে। এখন প্রতিডজন ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৫০ থেকে ১৫৫ টাকা; অর্থাৎ প্রতি পিস সাড়ে ১২ থেকে সাড়ে ১৩ টাকা। এটাও অতিরিক্ত বলে মনে করছেন ভোক্তারা। এখানে একটা বিয়ষ লক্ষণীয়- বাজারে ডিমের দাম বাড়লেও খামারিরা সেটা পাননি। তার মানে মধ্যস্বত্বভোগীরা সেটা খেয়ে ফেলেছে। কিন্তু অদৃশ্য কারণে অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। এভাবে চলতে থাকলে অচিরেই সরকারের জনপ্রিয়তা শূন্যে নেমে আসবে। ৮ আগস্ট যখন ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শপথ নেয়; মানুষ তখন নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিল। সেই স্বপ্ন এখন দুঃস্বপ্নে পরিণত হচ্ছে কেবল দ্রব্যমূলের ঊর্ধ্বগতির কারণে। আশাকরি সরকার বিষয়টি অনুধাবন করবে এবং সেই অনুসারে ব্যবস্থা নেবে। যেকোনো মূল্যে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সরকারের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত এটি। তারা যত সংস্কার করার উদ্যোগ নিয়েছে; সেগুলোর মধ্যে দ্রব্যমূল্যের বিষয়টি নেই। মনে রাখতে হবে- মানুষের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেলে সে আর ভয় পায় না। তখন সে রুখে দাঁড়ায়; বিপ্লব করে। এমনই এক বিপ্লবে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে।

লেখক: সাংবাদিক

 

ভোরের আকাশ/রন