আমাদের তিলোত্তমা নগরী ঢাকায় ব্যাটারিচালিত অটো চলাচল সমস্যা নতুন কিছু বলে আমরা মনে করি না। রাজধানীর অলিগলিসহ প্রধান প্রধান সড়কে দীর্ঘদিন যাবৎ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। ফলে এই শহরে দুর্ঘটনা ও যানজট এখন নিত্যদিনের সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। এতে করে বাড়ছে দুর্ভোগ ও দুর্ঘটনাও। এই সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হলে বিপাকে পড়ে যান আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও। গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে অটোরিকশা চালকদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে বলে গতকাল দৈনিক ভোরের আকাশে খবর ছাপা হয়েছে। ফলে অটোরিকশা চলাচল বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্তও এখন সহজেই কার্যকর করা সম্ভব হচ্ছে না। অন্যদিকে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা বন্ধ হলে বেকার হয়ে পড়বেন ১২ লক্ষাধিক চালক। এতে বন্ধ হয়ে যাবে ২৫ লক্ষাধিক মানুষের জীবনজীবিকা সেই কথাটিও বিবেচনায় রাখতে হবে। একারণেই বিষয়টি জটিল হয়ে পড়েছে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেও একবার ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালানো বন্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু চালকদের আন্দোলনের ফলে আবারও চালানোর অনুমতি দিতে বাধ্য হয় সরকার। এবার অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা বন্ধে উদ্যোগ নিয়েছে হাইকোর্ট। এলক্ষ্যে গত ১৯ নভেম্বর বিচারপতি ফাতেমা নজীব ও বিচারপতি মাহমুদুর রাজীর হাইকোর্ট বেঞ্চ ঢাকা মহানগর এলাকায় তিন দিনের মধ্যে ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল বন্ধের আদেশ দিয়েছেন। তবে অযান্ত্রিক রিকশাচালকদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯ নভেম্বর উচ্চ আদালত ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার চলাচল পুরোপুরি বন্ধের নির্দেশ দেননি। তারা বলেছেন, বন্ধ বা বিধিনিষেধ আরোপ করা হোক। স্বরাষ্ট্র সচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শক, ঢাকার জেলা প্রশাসক, দুই সিটি করপোরেশনের প্রশাসক, ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারসহ বিবাদীদের প্রতি এ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে পুলিশ, সিটি করপোরেশন, বিআরটিএ কোনো সংস্থারই ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চলাচল বন্ধ করার বিষয়ে কোনো ধরনের কার্যক্রম, পদক্ষেপ চোখে পড়েনি। হাইকোর্টের নির্দেশ সত্ত্বেও রাজধানীতে বন্ধ হয়নি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চলাচল। বরং অটোরিকশা চালকরা হাইকোর্টের নির্দেশ অমান্য করে রাস্তায় নেমে রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। ফলে রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। ভোগান্তিতে পড়েন সাধারণ মানুষ। সংশ্লিষ্টরা জানান, ব্যাটারিচালিত রিকশার জন্য প্রচুর বিদ্যুৎ খরচ হয়। বিদ্যুৎ ঘাটতির সময়ে অবৈধ এই যানবাহন চলতে দেওয়া কোনোভাবেই উচিত হচ্ছে না। এছাড়া এই বাহনও নিরাপদ নয়। সাধারণ রিকশার অবকাঠামো কিছুটা পরিবর্তন করে তৈরি এসব রিকশা বেপরোয়া গতিতে চলাচল করে। এতে প্রায়ই সড়কে দুর্ঘটনা ঘটছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরই) তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ব্যাটারিচালিত তিন চাকার যানবাহনের কারণে সারাদেশে ৯০০টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এর মাঝে ৫৮২টিই ছিল মারাত্মক। যাতায়াতে সহজ বাহন হিসেবে অটোরিকশা মানুষের উপকার হলেও দুর্ঘটনার বিষয়টি মেনে নেওয়া যায় না।
আমরা মনে করি, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চলাচল বন্ধ করার পক্ষে পায়ে চালিত রিকশা চালকদের দাবি কিছুটা সঠিক হতে পারে, তবে বিষয়টি কিছুটা জটিল। পায়ে চালিত রিকশা চালকদের মতে, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা তাদের আয়ের ওপর প্রভাব ফেলছে, কারণ এগুলো দ্রুত এবং সহজে চলতে পারে, যার ফলে তারা কম যাত্রী পাচ্ছে। এছাড়াও, ব্যাটারিচালিত রিকশাগুলো ট্রাফিক জ্যাম এবং দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে। তবে যে পেশার সঙ্গে লাখ লাখ মানুষের ভাগ্য জড়িত, তাদের বিকল্প জীবিকার ব্যবস্থা না করে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে ব্যাটারিচালিত রিকশা পুরোপুরি বন্ধ করা কতটা সমীচীন, তাও ভেবে দেখার বিষয়।
আমরা মনে করি, রাতারাতি অটোরিকশা চলাচল বন্ধ করাটা জটিল। তাই আপাতত মূল সড়কে এই ধরনের যানবাহন বন্ধ করতে হবে। এছাড়া ঢাকায় অটোরিকশার চলাচল বন্ধ করা পুলিশ বিভাগের জন্যও বড় চ্যালেঞ্জ। জনগণের সার্বিক সহযোগিতা না থাকলে অটোরিকশা বন্ধ করা সম্ভব নয়। ব্যাটারিচালিত রিকশার বিষয়ে বাস্তবভিত্তিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। প্রধান সড়কে এই যান চলাচল বন্ধ রেখে অলিগলির জন্য চালু রাখা যেতে পারে। সমস্যা সমাধানে কর্তৃপক্ষ অংশীজনদের সঙ্গে কথা বলে যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নেবে, এটাই প্রত্যাশিত। আমরা আশা করবো, সরকার এই সমস্যা সমাধানে পরিকল্পিত উদ্যোগ গ্রহণ করবে।
ভোরের আকাশ/রন