ঢাকার মহাখালীতে বিশালায়তনের ডিএনসিসি কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালে ১০৫৪টি শয্যা, যার মধ্যে ২১২টি আইসিইউ, এইচডিইউ শয্যা ২৮৮টি। প্রতিটি শয্যায় রয়েছে অক্সিজেন সংযোগ। রোগ নির্ণয়ের আধুনিক যন্ত্রপাতিও আছে। ঢাকার অন্য হাসপাতালগুলো যখন রোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে, তখন এই হাসপাতালের বেশিরভাগ শয্যা ফাঁকা পড়ে থাকছে। শুধু ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। চিকিৎসক-নার্সসহ প্রয়োজনীয় লোকবল না থাকায় বড় পরিসরে চিকিৎসা দেওয়া যাচ্ছে না। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকার মাঝা-মাঝি এলাকায় এই হাসপাতালে প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ দিয়ে সেবার পরিধি বাড়ালে অন্য হাসপাতালগুলোর ওপর চাপ কমবে। রোগীদের সেবা পাওয়ার সুযোগও বাড়বে।
মহাখালীর ডিএনসিসি হাসপাতালের আয়তন এক লাখ ৮০ হাজার ৫৬০ বর্গফুট। কারওয়ানবাজারের বিকল্প হিসেবে মহাখালী বাসস্ট্যান্ডের পাশে ৭ দশমিক ১৭ একর জমিতে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এখানে মার্কেট তৈরি করেছিল। তবে ব্যবসায়ীরা এখানে আসেননি। ২০২০ সালে কোভিড মহামারীর সময় ছয় তলা ভবনটি কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতাল ঘোষণা করা হয়। তখন হাসপাতালে মোট এক হাজার ৫৪টি শয্যার ব্যবস্থা করা হয়। এরমধ্যে ২১২টি আইসিইউ, ২৮৮টি এইচডিইউ এবং ৫৫৪টি সাধারণ শয্যা। সাধারণ শয্যার প্রতিটিতেই আছে সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইন। হাসপাতালটিতে ১৪৮টি হাই-ফ্লো নেইজল ক্যানুলা, ৫২টি বাইপেপ, ৬৫০টি অক্সিজেন সিলিন্ডার আছে। সব প্যাথলজি পরীক্ষার সঙ্গে সিটি স্ক্যান, এক্সরে, আল্ট্রাসনোগ্রাফিসহ ৫০ ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার আধুনিক যন্ত্রপাতি স্থাপন করা হয়েছে এ হাসপাতালে। অথচ চিকিৎসক মাত্র ৮৪ জন! নার্স আছেন ৭০ জনের মত।
২০২২ সালে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়লে কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালটি ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসার জন্য খুলে দেওয়া হয়। ২০২৩ সালের ১৩ জুলাই এই হাসপাতালকে ডেঙ্গুর জন্য ডেডিকেটেড ঘোষণা করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। গত শুক্রবার সেখানে ১৫৮ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ভর্তি ছিল। এছাড়া শিশু, হৃদরোগ, মেডিসিন এবং গাইনি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরাও রোগী দেখেন। শিশু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক শনিবার এবং মঙ্গলবার সকাল ৯টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত রোগী দেখেন। বাকি বিভাগগুলোয় শুক্রবার ছাড়া বাকি দিনগুলোতে রোগী দেখেন চিকিৎসকরা। এই হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স আসে স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে, সশস্ত্র বাহিনী থেকে আসা চিকিৎসক-কর্মকর্তারা প্রশাসনিক দিকটি দেখেন, কর্মচারীদের আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়া হয়।
ডিএনসিসি হাসপাতালের নিচতলায় প্রশাসনিক ব্লক, ট্রায়াজ, বহির্বিভাগ এবং ফার্মেসি। দ্বিতীয় তলায় রোগ নির্ণয় কেন্দ্র। তৃতীয় তলায় নারী, চতুর্থ এবং পঞ্চম তলায় পুরুষ ওয়ার্ড। ষষ্ঠ তলা জুড়ে আছে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র। গত বুধবার মহাখালী ডিএনসিসি হাসপাতালের প্রতিটি ফ্লোর ঘুরে দেখা গেছে, পুরো হাসপাতাল প্রায় ফাঁকা। ওয়ার্ডগুলোয় কিছু ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ভর্তি আছেন। ষষ্ঠ তলায় আইসিইউ-১, ২, ৩, ৪, ৫ এবং ৬ ফাঁকা। এখানে কোনো রোগী নেই। আইসিইউ-৭, ৮ ও ৯ এ রোগী আছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাসপাতালের একজন চিকিৎসক বলেন, কোভিড এবং ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এখন কোভিড রোগী নেই। ডেঙ্গুর চাপ বাড়লে বেডগুলো পরিষ্কার করে রোগীদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়। অন্য সময় ফাঁকা থাকে। রোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই হাসপাতালের চিকিৎসার মান এবং ব্যবস্থাপনায় তারা সন্তুষ্ট। তবে বহির্বিভাগের সেবাসহ অন্যান্য জরুরি চিকিৎসার ব্যবস্থা না থাকায় তাদের হতাশাও আছে।
লোকবলসহ নানা সীমাবদ্ধতার কথা স্বীকার করলেন ডিএনসিসি ডেডিকেটেড কোভিড-১৯ হাসপাতালের পরিচালক কর্নেল এ কে এম জহিরুল হোসাইন খান। তার ভাষ্য, হাসপাতালে চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীর ঘাটতি আছে। কিছু নতুন চিকিৎসক-নার্স পেয়েছেন, কিন্তু তারা এখনও যোগ দেননি। এটা খুবই সীমিত জনবল। কারণ আমাদের এখানে আসা রোগীদের দিনে অনেকবার দেখতে হয়। ডেঙ্গু রোগীদের বারবার ফলোআপ করতে হয়। সে হিসেবে জনবলের স্বল্পতা আছে। ২৪ ঘণ্টা বা ক্রিটিক্যাল পেশেন্ট দেখার জন্য যে দক্ষ জনবল দরকার সেটা আমাদের এখানে নাই। এনেস্থেসিয়ার মাত্র দুজন ডাক্তার আছে। এ কারণে আইসিইউ, ভেন্টিলেশন সুবিধা দেওয়া যাচ্ছে না। তিনি বলেন, গত জুলাই থেকে বহির্বিভাগে গাইনি, মেডিসিন, কার্ডিওলজি, শিশু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বসানোর ব্যবস্থা করেছেন। পরিচালক বলছেন, এত বড় হাসপাতাল চালানোর সক্ষমতা ডিএনসিসির নেই। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় দায়িত্ব নিলে ব্যাপকভাবে সেবা দেওয়া সম্ভব। এ ধরনের কোনো প্রস্তাব দিয়েছেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা আসলে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের বিষয়। তবে আমাদের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে একটা প্রস্তাব দেওয়া আছে। এখানে মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগের একটা ব্যাপার আছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. আবু জাফর সম্প্রতি ওই হাসপাতালটি পরিদর্শন করার কথা বলেছেন। তিনি বলেন, কোনো জনবল কাঠামো না থাকায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর অন্য হাসপাতালের চিকিৎসকদের সংযুক্তি দিয়ে পাঠানো হচ্ছে। সেখানে কোনো ম্যানপাওয়ার নাই, অ্যাটাচমেন্টে চিকিৎসকদের দিতে হয়। হাসপাতালের ডিমান্ড অনুযায়ী আমরা কিছু চিকিৎসক দিই। ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে যেসব চিকিৎসকরা প্রশিক্ষণে আসে আমরা তাদের সেখানে দেব এক মাসের জন্য। তাতে স্বল্পতা কিছুটা কাটবে। তিনি বলেন, পুরোপুরি হাসপাতাল হিসেবে পরিচালনা করতে চাইলে সিটি করপোরেশন থেকে নিয়ে নিতে হবে। আমাদের মিনিস্ট্রি থেকে সেটা প্রসিড করতে হবে। একটা পার্মানেন্ট হাসপাতাল করতে হলে একটা অর্গানোগ্রাম লাগে। এ বিষয়ে সরকার কোনো সিদ্ধান্ত নেবে হয়ত।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর খায়রুল আলম বলেছেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এই হাসপাতালের দায়িত্ব নিতে চাইলে তারা সহায়তা দেবেন। এখানে আমাদের অবকাঠামো ব্যবহার করা হয়েছে। আমাদের কিছু সিম্পল ইনভলবমেন্ট ওখানে আছে। সেবার পরিধি বাড়ানো যায় কি না সেটা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় দেখবে। তারা যদি মনে করে এটাকে জেনারেল হাসপাতালে কনভার্ট করবে, সেক্ষেত্রে আমাদের দিক থেকে সহযোগিতা করা হবে।
ভোরের আকাশ/রন