আন্তর্জাতিক নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা দূরীকরণ দিবস আজ। ১৯৬০ সালের ২৫ নভেম্বর ডোমিনিকান প্রজাতন্ত্রে ৩ জন নারী নির্যাতিত হয়। এ ঘটনার স্মরণে ১৯৮১ সালের জুলাই মাসে প্রথম ল্যাটিন আমেরিকায় নারী অধিকার সম্মেলনে ২৫ নভেম্বরকে নির্যাতনবিরোধী দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং প্রতি বছর ২৫ নভেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত পক্ষকালব্যাপী সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রচারণা চালানোর সিদ্ধান্ত হয়। ১৯৯৩ সালের ২৫ নভেম্বর জাতিসংঘ ‘নারী নির্যাতন দূরীকরণ ঘোষণা’ প্রকাশ করে। ১৯৯৯ সালের ১৭ ডিসেম্বর জাতিসংঘ ডোমিনিকান প্রজাতন্ত্রের খসড়া অনুমোদন করে প্রতি বছর ২৫ নভেম্বরকে আনুষ্ঠানিকভাবে আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন দূরীকরণ দিবস' হিসেবে গ্রহণ করে। বাংলাদেশে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক প্রতিবাদ দিবস উদ্যাপন কমিটি ১৯৯৭ সাল থেকে এই দিবস ও পক্ষ পালন করছে।
নারীর প্রতি এই সহিংস নির্যাতনের মাত্রা দিন দির বৃদ্ধি পাওয়ায় ক্ষুণ্ন হচ্ছে নারীর সুষ্ঠুভাবে বেঁচে অধিকার, পক্ষান্তরে বৃদ্ধি পাচ্ছে অপরাধপ্রবণতা। এ ছাড়াও নারী নির্যাতন বা নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে বাংলাদেশে ১৯৮৫ সালের পারিবারিক আদালত, ১৯৯৫ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন আইন, ২০০০ ও ২০০৩ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, সিটিজেনশিপ অ্যাক্ট-২০০৮, হাইকোর্ট নির্দেশিত পাশবিক নিপীড়নবিরোধী নীতিমালা-২০০৮ পাস হয়েছে। কিন্তু এত আইন বা নীতিমালা পাস হওয়া সত্ত্বেও নারী নির্যাতন বন্ধ হচ্ছে না কারণ আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও ক্ষমতাশীলদের ক্ষমতার অপব্যবহারে কারণে। এর কারণে আইন করেও পুরোপুরি দমন করা যাচ্ছে না বরং বেড়েছে ভয়াবহতা ও নৃশংসতা।
সার্বজনীন নারী অধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘনমূলক অপরাধ নারী নির্যাতন। ধারণাগতভাবে এটি আবার নারীর প্রতি সহিংসতা, নিপীড়ন এবং নারীর সঙ্গে অপব্যবহার ইত্যাদিও বোঝায়। এটি সমাজে মহিলাদের প্রতি অমানবিক ও অনৈতিক আচরণের মধ্যেও প্রকাশ পায়। সহিংসতার শিকার নারী বা পুরুষ উভয়েই হতে পারে। আবার নারী বা পুরুষ বা উভয়ের দ্বারা সহিংসতা সংঘটিত হতে পারে। সাধারণত সবশ্রেণির পুরুষই সহিংসতার শিকার হন না; কিন্তু সব শ্রেণির নারীই সহিংসতার শিকার। যৌন হয়রানি বা যৌন নিপীড়ন হচ্ছে নারী-সহিংসতার অন্যতম দিক। জরিপে জানা গেছে, বিশ্বের তিন ভাগের এক ভাগ নারী তাদের জীবনে শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। এর মধ্যে বেশির ভাগ হয় তাদের পরিবারের বা খুব কাছের সদস্য দ্বারা। পারিবারিক ক্ষেত্রে হিংসাত্মক ঘটনা হচ্ছে নারীর মানবাধিকার ও মৌলিক অধিকারের লঙ্ঘন। নারীদের নির্যাতিত হওয়ার কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে যৌতুক। যদিও আমরা ঘটা করে প্রচার করছি যৌতুক একটি সামাজিক ব্যাধি। যৌতুক নেওয়া বা দেওয়া দুটিই অপরাধ। কিন্তু আমাদের প্রচার-প্রচারণা আদৌ সুফল বয়ে আনছে কি? না এখনো কোনো সুফল পাইনি।
দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও অশিক্ষাসহ নানা কারণে নির্যাতিত হচ্ছে নারীরা। যৌতুকের দাবি মেটাতে না পেরে অসংখ্য নারীর জীবন হয়ে উঠেছে দুর্বিষহ। যৌতুক, বাল্যবিয়ে, বহুবিয়ে, তালাকসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিদ্যমান আইনগুলোর যথাযথ প্রয়োগ নেই। তা ছাড়া এ সব আইন সম্পর্কে সাধারণ মানুষ সচেতনও নয়। দুঃখজনক হলেও সত্যি, পৃথিবীব্যাপী এ সব সহিংসতার শিকার হয়ে প্রতি বছর অসংখ্য নারীর মৃত্যু হচ্ছে।
এক গবেষণা প্রতিবেদনে নারীর প্রতি যৌন সহিংসতার ঘটনায় তরুণদের সম্পৃক্ততা বেড়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। ঢাবির অপরাধ বিদ্যা বিভাগ ও বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ যৌথভাবে এই গবেষণা পরিচালনা করে। প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী ৩৮৪ জন উত্তরদাতার মধ্যে ৮২.৩ শতাংশ তরুণ মনে করে যে, যুব জনগোষ্ঠীর যৌন সহিংসতার শিকার হওয়ার প্রবণতা বেশি এবং ৫৯.৪ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন যুব জনগোষ্ঠী যৌন সহিংসতার অপরাধী হওয়ার প্রবণতা বেশি।
গবেষণা প্রতিবেদনে তরুণ সমাজকে এই ভয়াবহ অপরাধ প্রবণতা থেকে রক্ষা করতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যুবকদের শিক্ষামূলক জীবনমুখী প্রশিক্ষণ প্রদান, যৌন শিক্ষার মাধ্যমে পর্নোগ্রাফি রোধ করা এবং এর বিরুদ্ধে সচেতনতা সৃষ্টির সুপারিশ করা হয়। এতে শিক্ষা পাঠ্যক্রম ও যথাযথ শিক্ষক প্রশিক্ষণেরও সুপারিশ করা হয়। সমাজের যেকোনো অংশে সহিংসতা আমাদের সবার ওপর প্রভাব ফেলে। বিষয়গুলো পরবর্তী প্রজন্মের মনে যেমন দাগ কাটে, একইভাবে সামাজিক বন্ধন দুর্বল করে দেয়।
আমরা নারীর প্রতি সহিংসতা, নাগরিক নিপীড়ন ও সহিংস সংঘাতের মধ্যে একটি সরলরেখা দেখতে পাচ্ছি। এই সরলরেখার ব্যাপ্তী যুদ্ধে ধর্ষণ ও যৌন দাসত্বকে যেমন অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার থেকে সহিংস চরমপন্থায় নারীর প্রতি অবমাননা পর্যন্ত। তবে নারীর প্রতি সহিংসতা অনিবার্য কিছু নয়। সঠিক নীতি আর কর্মসূচি এ ক্ষেত্রে পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটাতে পারে।
অর্থাৎ সহিংসতার মূল কারণগুলোকে মোকাবিলায় সক্ষম ব্যাপক ও দীর্ঘমেয়াদি কৌশল নারী ও কন্যাশিশুদের অধিকার রক্ষা করতে পারে এবং শক্তিশালী ও স্বনিয়ন্ত্রিত নারী অধিকার আন্দোলনকে বেগবান করতে পারে। জাতিসংঘ ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে অংশীদারত্বের ভিত্তিতে ঠিক এই মডেলই তৈরি করেছে, যা স্পটলাইট ইনিশিয়েটিভ নামে পরিচিত।
গত বছর অংশীদার দেশগুলোতে আমরা নারীর প্রতি সহিংসতার অপরাধে অপরাধীদের বিচার ২২ শতাংশ বৃদ্ধি পেতে দেখেছি। ৮৪টি আইন ও নীতি প্রণয়ন অথবা জোরদার করা হয়েছে। এবং মহামারির কারণে বিধিনিষেধ সত্ত্বেও সাড়ে ছয় লাখের বেশি নারী ও কন্যাশিশু লিঙ্গ পরিচয়ভিত্তিক সহিংসতার শিকার হওয়ার পর সেবা নিতে দেখেছি। পরিবর্তন সম্ভব। এখন সময় আমাদের এই প্রচেষ্টাকে দ্বিগুণ জোরদার করা, যাতে করে আমরা এক সঙ্গে ২০৩০ সালের মধ্যে নারী ও কন্যাশিশুর প্রতি সহিংসতার অবসান ঘটাতে পারি।
নারীদের ওপর সহিংসতার আরেকটি কারণ হলো এদের ওপর সমাজের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। নারী নিজ পরিবারেও নির্যাতিত হচ্ছে। বিদ্যমান সমাজ ব্যবস্থায় সহিংসতার শিকার অনেক নারী চাইলেও আইনের আশ্রয় নিতে পারেন না বরং পরিবার ও সন্তানের কথা ভেবে সহ্য করছেন বাধ্য হয়ে। তাই নারীর প্রতি সহিংসতা রোধের জন্য আইন ছাড়াও আমাদের প্রয়োজন দৃষ্টিভঙ্গির ইতিবাচক পরিবর্তন। এই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনই নারীর প্রতি সহিংসতার প্রতিরোধ করতে পারবে যার মাধ্যমে নারী পাবে সহিংসতার প্রতিকার, গড়ে উঠবে নারী সহিংসতা মুক্ত একটি সুন্দর সমাজ। তাই নারীদের প্রতি আমাদের এই দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে পরিবার ও সমাজ তথা আমাদের সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। নারীদেরও সোচ্চার হতে হবে নিজ অধিকার আদায়ে।
বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্বের জন্য এখন নারীর অধিকার রক্ষায় শুধু নির্ধারিত ইস্যু নয়, বরং সামগ্রিক বিষয় নিয়ে কাজ করা প্রয়োজন। নারীর সামাজিক ক্ষমতায়ন, আর্থসামাজিক উন্নয়ন, নারীর নিরাপত্তাসহ অন্যান্য বিষয় নিয়ে আলাদা আলাদাভাবে যে সব সংস্থা কাজ করে, তাদের একই নীতিমালা অনুসরণ করে একই লক্ষ্যে সব সময় অবিচল থাকতে হবে। সে ক্ষেত্রে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে নারী ও শিশু ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার গড়ে তোলা জরুরি। এখানে নারী সদস্যরা সহিংসতার ব্যাপারে সাহায্য করবে। নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে সরকার কাজ করছে। নারীদের জন্য যে সব সেবার ব্যবস্থা করেছে, সেগুলো সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্য গণমাধ্যমই পারে তাদের কাছে পৌঁছে দিতে। এ সব সেবাই তাদের সহিংসতা থেকে রক্ষা করতে পারবে বলে মনে করা হচ্ছে। গ্রাম পর্যায় থেকে শুরু করে সংসদেও প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে নারী ও শিশুবিষয়ক উন্নয়ন কমিটি আছে। এ কমিটিগুলোর কার্যক্রম মূল্যায়ন করতে হবে। জনগণ যেন তার অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়, সে ব্যাপারে আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে। অর্থাৎ নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে ব্যক্তি থেকে সমাজ, প্রাতিষ্ঠানিক ও রাষ্ট্রীয়পর্যায়ে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন দরকার। এ ক্ষেত্রে নিজে নির্যাতন থেকে দূরে থাকলেই চলবে না, সেই সঙ্গে আমাদের আশপাশে ঘটে যাওয়া যেকোনো নির্যাতনের প্রতিবাদ করতে হবে। সম্মিলিতভাবে রুখে দাঁড়াতে হবে।
লেখক: সহকারী শিক্ষক, বালিগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়
ভোরের আকাশ/রন