দেশে গত ৫ আগস্টে ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানের পর পুলিশি ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। এতে করে যে দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিরও অবনতি ঘটেছে সেকথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। দেশে বেড়েছে খুন, চুরি, ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা। এতে করে নিরাপত্তা নিয়ে জনমনে বিরাজ করছে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা। এই পরিস্থিতিতে পলাতক পুলশ সদস্যদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে মর্মে দৈনিক ভোরের আকাশে গতকাল খবর ছাপা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, সরকার পরিবর্তনের পর দেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসলেও কাজে যোগদান থেকে বিরত থেকেছেন ১৮৭ জন পুলিশ সদস্য। এই অপরাধের জন্য তাদের বিরুদ্ধে কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর। বেতন ভাতা বন্ধসহ পলাতক থাকার কারণে তাদের বিরুদ্ধে অন্যান্য আইনি ব্যবস্থাগ্রহণে থানায় মামলা করা হচ্ছে। এমনকি তাদের গ্রেপ্তারে আলাদা টিমও গঠন করেছে পুলিশ। তারা যেন বিদেশে পালাতে না পারেন, সে জন্য বাতিল হচ্ছে তাদের অফিশিয়াল পাসপোর্ট। পুলিশ সদর দপ্তরের সূত্র বলছে, কাজে যোগ না দিয়ে পলাতক থাকা পুলিশ সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন ১ জন ডিআইজি, ৭ জন অতিরিক্ত ডিআইজি, ২ জন পুলিশ সুপার, ১ জন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, ৫ জন সহকারী পুলিশ সুপার, ৫ জন পুলিশ পরিদর্শক, ১৪ জন এসআই ও সার্জেন্ট, ৯ জন এএসআই, ৭ জন নায়েক এবং ১৩৬ জন কনস্টেবল। পলাতক কনস্টেবলদের মধ্যে দুজন নারী সদস্য রয়েছেন।
আমরা মনে করি, পুলিশ রাষ্ট্রের একটি অপরিহার্য বাহিনী। পুলিশ ছাড়া আধুনিক রাষ্ট্র চলতে পারে না। দেশে আজ পুলিশ বাহিনীর যে অবস্থা, তার জন্য যৌথভাবে বিগত সরকার ও পুলিশ বাহিনী উভয়ই দায়ী। সরকার ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য পুলিশকে ব্যবহার করেছে আর পুলিশও তার পেশাদারত্বের বাইরে গিয়ে ব্যবহৃত হয়েছে। এর বিনিময়ে অনেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা নানা সুবিধাও বাগিয়ে নিয়েছে। বিগত সরকারের আমলে পুলিশের অনেকেই বিশাল সম্পদের মালিক হয়েছেন। বিগত সরকারের আমলে পুলিশ বাহিনী তার পেশাদারত্ব হারিয়ে সরকারদলীয় এক বাহিনীতে পরিণত হয়েছিল। বিরোধী রাজনৈতিক দলকে দমন করতে গিয়ে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করা হয়েছে। পুলিশের রাজনৈতিক ব্যবহার নতুন নয়। ব্রিটিশ আমল থেকেই পুলিশের এ রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবহার শুরু হয়। ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের প্রেক্ষাপটেই প্রণয়ন করা হয় পুলিশ আইন। ব্রিটিশ সরকার এদেশ ও এদেশের মানুষের ওপর শাসন ও শোষণ নির্বিঘ্ন করতেই পুলিশ আইন তৈরি করে। সেই থেকে ব্রিটিশ ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে সব সরকারই পুলিশকে সেভাবেই ব্যবহার করেছে। দেশের আইনশৃঙ্খলা, অপরাধ ও অপরাধীদের নিয়ে পুলিশ কাজ করে। এ কাজ করতে গিয়ে পুলিশের কোনো কোনো সদস্য নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। আইনে পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়েরের ব্যবস্থা থাকতে হবে ও তার ভিত্তিতে পুলিশের বিচারও হতে হবে। পুলিশের অপরাধ তদন্তের কাজ পুলিশকে দিয়ে করালে সেখানে সঠিক তদন্ত হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। পুলিশের বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ সাধারণ নাগরিকের অপরাধের অভিযোগের চেয়েও গুরুত্ব দিয়ে বিচার করতে হবে। পুলিশের অপরাধের বিরুদ্ধে শুধু প্রশাসনিক বা বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণই যথেষ্ট নয়।কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। আর এজন্য স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন করতে হবে। এ কমিশনে সরকার ও বিরোধী দলের সদস্যদের সমান অংশগ্রহণ জরুরি। এছাড়া নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিও থাকতে হবে। সার্বিকভাবে পুলিশ কাজ করবে কমিশনের অধীনে। নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি থাকবে কমিশনের অধীনে। দক্ষতা, যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, শিক্ষা ইত্যাদির ভিত্তিতে পুলিশের বদলি ও পদোন্নতি নিশ্চিত করতে হবে।
আমরা মনে করি, আপদে-বিপদে পুলিশকে জনগণের প্রথম ভরসাস্থল হয়ে উঠতে হবে। মনে রাখতে হবে পুলিশের অর্জনও যেমন অনেক তেমনি ত্যাগও অনেক। পাশাপাশি গ্লানিও কম নয়। অতীতের সেই গ্লানি মুছে গিয়ে পুলিশকে হয়ে উঠতে হবে জনগণের সেবক ও বন্ধু। জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ও দেশটাকে নতুনভাবে গড়তে পুলিশের অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। সেলক্ষ্যে সরকার পুলিশ বাহিনীকে ঢেলে সাজাবে সেটাই আমাদের প্রত্যাশা ও দাবি।
ভোরের আকাশ/রন