দেশ এগিয়েছে অনেক দূর। এগিয়েছে সমাজও; কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের মানসিকতার তেমন পরিবর্তন হয়নি। আর সেটাই প্রমাণ করে দেশের নারী নির্যাতনের চিত্র। দৈনিক ভোরের আকাশ-এ প্রকাশিত প্রতিবেদন বলছে, দেশে প্রতি ৯ ঘণ্টায় একজন নারী ধর্ষণের শিকার হচ্ছে।
২০২০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত কেবল সংবাদ মাধ্যমে আসা তথ্য থেকে এই চিত্র পাওয়া গেছে। এর বাইরেও অনেক ঘটনা সংবাদ মাধ্যমে আসে না। সেই হিসাব ধরলে অবস্থা ভয়াবহ। ধর্ষণ ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের যৌন নির্যাতন হচ্ছে।
কয়েকটি গবেষণা সংস্থা বলছে, গত চার বছরে ৪ হাজার ৭৮৭টি ধর্ষণের ঘটনার মধ্যে মামলা হয়েছে ৩ হাজার ৪১৯টির। যার অর্থ ধর্ষণের ঘটনার তিনটির মধ্যে কমপক্ষে একটি ঘটনার কখনো মামলা বা অভিযোগ দায়ের হয়নি। নারী অধিকারকর্মী খুশি কবির এজন্য আইনি ব্যবস্থা সহায়তার অভাবকে দায়ী করেছেন। নারীরা আদালতে যন্ত্রণাদায়ক পরিস্থিতির মুখোমুখি হন এবং ৮-১০ বছর পর্যন্ত মামলা টানতে হতে পারে। ফলে অভিযোগকারীদের পক্ষে মামলার ব্যয়, সামাজিক চাপ এবং দীর্ঘ লড়াই চালিয়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। পাঁচ বছরের তথ্য বিশ্লেষণে আরও দেখা গেছে, এই সময়ের মধ্যে শূন্য থেকে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত ২ হাজার ৮৬২ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। অর্থাৎ প্রতি পাঁচজনের মধ্যে তিন জনই শিশু। মামলা থেকে দেখা গেছে ভুক্তভোগীদের ৪৭ শতাংশের বয়স ১৩ থেকে ১৮ বছর। ধর্ষণ-যৌন হয়রানির বাইরেও নারী নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতার শিকার হচ্ছে। এখনো পোশাক নিয়ে নারীকে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। নারী বাল্যবিবাহের শিকার, যৌতুক-প্রথার শিকার, পারিবারিক নির্যাতনের শিকার, যৌন-নির্যাতনের শিকার। নারীর প্রতি সহিংসতা রোধের আহ্বান জানিয়ে ২৫ নভেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ ও বিশ্ব মানবাধিকার দিবস পালন করা হবে। এবারের প্রতিপাদ্য ‘নারী-কন্যার সুরক্ষা করি, সহিংসতামুক্ত বিশ্ব গড়ি’। দিবসটি উপলক্ষে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও বিভিন্ন স্থানে মানববন্ধন ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। গত সোমবার সকালে খাগড়াছড়ি প্রেস ক্লাবের সামনে আয়োজিত মানববন্ধনে ১৩টি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা অংশ নেয়। মানবন্ধনে অংশ নিয়ে বক্তারা বলেন, ‘পাহাড় ও সমতলে নারীর প্রতি সব ধরনের সহিংসতা প্রতিরোধ করতে হবে। এ জন্য সবার আগে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে।’ রাজধানী ঢাকায়ও নানা আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বিভিন্ন সভায় বক্তারা একটা কথাই জোর দিয়ে বলেছেন, বাংলাদেশে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন আছে; কিন্তু আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ নেই। গত সোমবার পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা যায়, নারী নির্যাতনের ৬৮ ভাগ আসামি গ্রেপ্তারই হয়নি ২০২৪ সালে। দেশের বিভিন্ন থানার মামলার তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, একক ধর্ষণের ঘটনা ছাড়া বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নির্যাতনের ঘটনায় আসামি থাকেন একাধিক ব্যক্তি। যৌতুকের মতো পারিবারিক নির্যাতনের ঘটনায় স্বামীর সঙ্গে পরিবারের অনেক সদস্যকেও আসামি করা হয়। তবে মামলার পর আসামিদের বড় একটি অংশ পুলিশের নাগালের বাইরে থেকে যায়। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুসারে, জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে সারা দেশের থানা ও আদালতে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০-এর যৌতুক, ধর্ষণ, ধর্ষণচেষ্টা, দাহ্য পদার্থ নিক্ষেপ ও অপহরণ ধারায় মোট ১২ হাজার ৭৬৯টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে শুধু নারী নির্যাতনের অভিযোগে মামলা হয়েছে ১০ হাজার ৬৮৬টি। বাকিগুলো শিশু নির্যাতনের অভিযোগে। আসলে শুধু আইন দিয়ে নারী নির্যাতন কিংবা নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ করা সম্ভব না। এজন্য প্রয়োজন দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টানো। যতদিন আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন না হবে, ততদিন নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ হবে না।
ভোরের আকাশ/রন