শেষ পর্যন্ত নিজের কঠোর অবস্থানে থাকতে পারলেন না বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। টাকা ছাপিয়ে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে সহায়তা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরই মধ্যে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক নিয়েছে ৭ হাজার ৯০০ কোটি টাকা; ন্যাশনাল ব্যাংক সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকা এবং অন্য তিনটি ব্যাংক নিয়েছে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া আরও ৭০ হাজার কোটি টাকার চাহিদা রয়েছে। দায়িত্ব নেওয়ার পর গত ২০ আগস্ট গভর্নর সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, টাকা ছাপিয়ে কোনো ব্যাংককে সহায়তা করা হবে না। সেপ্টেম্বরেও তিনি একই কথা বলেছিলেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক হুসনে আরা শিখা জানান, তারল্য সংকটে থাকা ‘দুর্বল’ ব্যাংকগুলোকে সচল রাখতে বিভিন্ন হিসাব-নিকাশ বিবেচনায় নিয়ে গ্যারান্টির মাধ্যমে আন্তঃব্যাংক বাজার থেকে নগদ টাকার ঋণ সহায়তার ব্যবস্থা করা হবে। সেই পদ্ধতিতে দুর্বল ব্যাংকগুলো প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা ধার নিয়েছে। কিন্তু তাতে সংকট মোকাবিলা না হওয়ায় টাকা ছাপিয়ে সহায়তা দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানান, গ্রাহকের আস্থা ফেরাতে ৫টি ব্যাংককে ভল্ট থেকে গত সোমবার সাড়ে ১৮ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। এদিন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে ৭ হাজার ৯০০ কোটি টাকার তারল্য সহায়তা নিয়েছে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক (এফএসআইবিএল)। এছাড়া ন্যাশনাল ব্যাংক নিয়েছে সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকা এবং অন্য তিনটি ব্যাংক নিয়েছে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা। গত মঙ্গলবার অন্য দুটি ব্যাংককে দেওয়া হয়েছে আড়াই হাজার কোটি টাকা।
একজন ডেপুটি গভর্নর নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, গত মঙ্গলবার ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের (এমডি) সঙ্গে বৈঠক করে ব্যাংকগুলো কত টাকা জোগান পেলে সংকট থেকে বের হতে পারবে, সেই তথ্য নিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। পরে প্রতিটি ব্যাংকের চেয়ারম্যান-এমডিদের সঙ্গে পৃথকভাবে সভা করেছেন তিনি। তখন কোন ব্যাংককে কী পরিমাণ অর্থ সহায়তা দেওয়া হবে, সে বিষয়ে ধারণা দেন গভর্নর। সব মিলিয়ে ৭০ হাজার কোটি টাকার চাহিদা দিয়েছে দুর্বল ব্যাংকগুলোর।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব নাজমা মোবারেক গত মঙ্গলবার অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, যেসব ব্যাংক অর্থ সংকটের কারণে আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না, তাদের সহায়তার জন্য খুব শিগগিরই আপনারা নতুন উদ্যোগ দেখতে পাবেন।
আলোচিত ৫টি ব্যাংকসহ অন্তত ১২টি ব্যাংক বিভিন্ন ঋণ জালিয়াতি ও অনিয়মের কারণে চরম তারল্য সংকটে রয়েছে। এর মধ্যে আটটি ব্যাংকের মালিকানায় এর আগে ছিল বিতর্কিত শিল্পগোষ্ঠী এস আলম গ্রুপ। এসব ব্যাংকের চলতি হিসাবে ঘাটতি থাকার পরেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রক বিধিমালা ভঙ্গ করে সহায়তার অনুমোদন দেওয়া হলো।
ছাত্র-জনতার অভ্যুস্থানে গত ৫ আগস্ট পতন হয় শেখ হাসিনা সরকারের। ৮ আগস্ট শপথ নেয় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার। কয়েক দিন পর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের দায়িত্ব পান অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর। ২০ আগস্ট তিনি সংবাদ সম্মেলনে বলেন, দুর্বল ও সমস্যাযুক্ত ব্যাংকগুলোকে টাকা ছাপিয়ে আর সহায়তা দেওয়া হবে না। হঠাৎ করে ব্যাংক বন্ধ করে কিংবা ব্যাংকের জন্য টাকা ছাপিয়ে কোনো সমাধানের পথে যাওয়া যাবে না। রাজধানীর মতিঝিলে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত এক বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের আলোচনার বিষয়বস্তু সম্পর্কে জানানোর সময় গভর্নর এসব কথা বলেন।
শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোর দুর্বল পরিস্থিতি ও চলমান অস্থিরতা নিয়ে গভর্নর আহসান এইচ মনসুর এক প্রশ্নে সাংবাদিকদের বলেন, এত দিন যা হওয়ার, তা হয়েছে। এখন ওই ব্যাংকগুলোকে উদ্ধারের প্রক্রিয়া আলাদা হবে। তবে ব্যাংকগুলো থেকে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা যেন আর টাকা সরাতে না পারেন, সেই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পরবর্তী সময়ে ব্যাংকিং কমিশন গঠন হলে দুর্বল ব্যাংকগুলোর সংখ্যা কমিয়ে বা তাদের একীভূত করে সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে। কিন্তু ব্যাংক বন্ধ বা টাকা ছাপিয়ে তা সমাধান করা হবে না। তবে নানাভাবে চেষ্টা করেও গভর্নরের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
ভোরের আকাশ/রন