আজ ২৮ নভেম্বর ঝিনাইগাতী যুদ্ধ দিবস। ১৯৭১ সালের এদিনে বাংলার দামাল ছেলে বীর মুক্তিযোদ্ধারা ঝিনাইগাতী সদরের রাজাকার ক্যাম্পে অপারেশন চালিয়ে ৮টি থ্রি নট থ্রি রাইফেল উদ্ধারসহ ৭ জন রাজাকার সৈনিককে আটক করে নিয়ে যায়। এ যুদ্ধের মাত্র ৭ দিন পরই শত্রুমুক্ত ঝিনাইগাতীতে মুক্তিযোদ্ধারা প্রবেশ করে প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন।
শুরু হলো প্রতিরোধ সংগ্রাম। যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে ঝিনাইগাতীর রাংটিয়া কুম্ভী পাতার ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ শিবির স্থাপন করা হয়। শেরপুর শহর থেকে কর্নেল আরিফ, আক্তারুজ্জামান, মন্জু, ফনু, হিমু, অদুসহ ১২ জন যুবককে নিয়ে অস্ত্র প্রশিক্ষণ শুরু করা হয়। অপরদিকে, ওই গ্রামের জগৎ মাস্টারের বাড়িতে রাতারাতি অস্থায়ী টেলিফোন স্টেশন স্থাপন করা হয় যোগাযোগ রক্ষার জন্য। ওই বাড়ি থেকে তার টানিয়ে ভারতের সিসিংপাড়া বিএসএফ ক্যাম্প পর্যন্ত টেলিফোনে যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু করা হয়।
ঝিনাইগাতীর নকশী ইপিআর ক্যাম্পের ইনচার্জ কোম্পানি কমান্ডার সুবেদার হাকিম, স্থানীয় ইপিআর, পুলিশ, আনসার, স্বেচ্ছাসেবক (মুজিব বাহিনী) নিয়ে পাক সেনাদের প্রতিহত করার জন্য মধুপুরে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। পাক বাহিনীর ভারী অস্ত্র ও গুলি বর্ষণে টিকতে না পেরে ১৪ এপ্রিল পিছু হেটে প্রতিরোধ বাহিনী দিকপাইতে ফিরে আসে। এরপর, পিছু হটে জামালপুর ব্রহ্মপুত্র নদের চরে ব্যাঙ্কার তৈরি করে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। কিন্তু পাক বাহিনীর প্রচণ্ড চাপের মুখে ২৫ এপ্রিল প্রতিরোধ বাহিনী ভারতে আশ্রয় নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ২৬ এপ্রিল বিকেলে সুবেদার হাকিমের খোলা জীপ এসে দাঁড়ায় ঝিনাইগাতী পাঁচ রাস্তার মোড় আমতলায়। জিপ থেকে নেমে সুবেদার হাকিম সমবেত জনতাকে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে অনুরোধ করেন। এসময় সুবেদার হাকিমের চোখের জল ছলছল করছিল, লক্ষ্য করলেন লেখক। কারণ পাক-হানাদার বাহিনীর ভারী অস্ত্রের বিরুদ্ধে মোকাবিলা করতে না পেরে ব্রহ্মপুত্রের বেরিকেড ভেঙে প্রতিরোধ বাহিনী এদিন সন্ধ্যার পর ভারতে চলে যায়। ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত ঝিনাইগাতী শত্রুমুক্ত ছিল।
২৭ এপ্রিল পাক-হানাদার বাহিনী গোলাবর্ষণ করতে করতে গাড়ি বহর নিয়ে এসে পৌঁছায় ঝিনাইগাতী। ঝিনাইগাতী ঢুকেই স্থানীয় সংগ্রাম পরিষদের অফিস হারুন অর রশিদ মাস্টারের ঘর আগুন দিয়ে পুড়ে দেয়। এরপর, গাড়িবহর নিয়ে রাংটিয়া মোড় পর্যন্ত গিয়ে আবার পেছনে ফিরে আসে। ফেরার পথে ঝিনাইগাতীর কোয়ারীরোডে অবস্থিত হাতিবান্দা মালিঝিকান্দা ইউনিয়ন পরিষদ ভবনে ক্যাম্প স্থাপন করে। পরদিন ২৮ এপ্রিল ঝিনাইগাতীর নেতৃবৃন্দদের কোয়ারীরোডের ক্যাম্পে ডেকে নিয়ে যায়। সংবাদ পেয়ে ওই ক্যাম্পে যান তৎকালীন চেয়ারম্যান আফাজ উদ্দিন, সাহাজ উদ্দিন সরকার, শফি উদ্দিন, সিরাজ পাঞ্চায়েত, আক্কেল সুফী, হোসেন মুন্সী, মাফাজ মেম্বার, সুরুজ মাওলানা, আহাম্মদ মেম্বার, আবুল হোসেন মেম্বার, সৈয়দুর রহমান ছুডি প্রমুখ। সাক্ষাৎ শেষে একমাত্র সৈয়দুর রহমান ছুডি ছাড়া সকলেই ফিরে আসেন। তাকে পাক-বাহিনী আটকে রাখে এবং ওই রাতেই তাকে গুলি করে মেরে ফেলে। পাক-বাহিনীর হাতে ঝিনাইগাতীর প্রথম শহীদ সৈয়দুর রহমান ছুডি। পরবর্তীতে পাক-বাহিনী আহাম্মদনগর হাইস্কুল, নকশী ইপিআর ক্যাম্প, হলদীগ্রাম ইপিআর ক্যাম্প, তাওয়াকোচা ইপিআর ক্যাম্প, শালচূড়া ও মোল্লাপাড়ায় ক্যাম্প স্থাপন করে।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ৩০ এপ্রিল ঝিনাইগাতীর জগৎপুর গ্রামে হানা দিয়ে পাক-হানাদার বাহিনী ৪১ জন গ্রামবাসীকে গুলি করে হত্যা করে এবং বাড়িঘর লুটপাট করে আগুন দিয়ে গ্রামটি জ্বালিয়ে দেয়। বীর মুক্তিযোদ্ধা কোম্পানি কমান্ডার নাজমুল আহসানের নেতৃত্বে মুক্তি বাহিনী ৫ জুলাই রাতে কাটাখালী ব্রিজ ও তিনআনী ডিনামাইট দিয়ে ধ্বংস করে। ভোর হয়ে আসায় পার্শ্ববর্তী রাঙ্গামাটিয়া গ্রামে আশ্রয় নেয়। পরিশ্রান্ত মুক্তিযোদ্ধারা সবেমাত্র ঘুমিয়েছিল। যে বাড়িতে ঘুমিয়েছিল, সেই বাড়ির মালিক খাসি জবাই করে কেবল রান্না বসিয়েছেন। এমন সময় খবর এলো পাক-বাহিনী সারা গ্রাম তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলেছে। একমাত্র পথ খোলা রাঙ্গামাটি বিল। কমান্ডার নাজমুল নির্দেশ দিলেন, বিলের মাঝ দিয়ে সাঁতরে পিছু হটতে। ইতোমধ্যেই পাক বাহিনী তাদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে লাগলো। কমান্ডার নাজমুল বিলের পানিতে দাঁড়িয়ে এলএমজি দিয়ে কভারিং ফায়ার করে মুক্তিযোদ্ধাদের চলে যাওয়ার পথ তৈরি করে দেন। অকস্মাৎ পাক-বাহিনীর ব্রাশ ফায়ার কমান্ডার নাজমুলের বুক ঝাঁঝরা হয়ে যায়। ওই লাশ আনতে গিয়ে নাজমুলের ভাই মোফাজ্জল ও ভাইপো আলী হোসেনও শহীদ হয়। এই তিন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার রক্তে সেদিন রাঙ্গামাটি বিলের পানি রাঙ্গা হয়ে উঠেছিল। পরে রাঙ্গামাটি খাটুয়াপাড়া গ্রামে হানা দিয়ে বাড়িঘরে আগুন দিয়ে লুটপাটসহ নারীদের শ্লীলতাহানি করে। গ্রামের পুরুষদের এক লাইনে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে। এতে ৯ জন শহীদ হয়। অনেকে আহত হয়ে এখনো শরীরে গুলি নিয়ে বেঁচে আছেন।
৩ আগস্ট নকশী বিওপি ক্যাম্প দখল নিয়ে নেওয়ার জন্য মুক্তি বাহিনী তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলে গুলিবর্ষণ করতে থাকে। পাক-বাহিনীও পাল্টা গুলি চালায়। সম্মুখ যুদ্ধে পাক-হানাদার বাহিনীর ৩৫ জন সৈন্য নিহত হয়। অপরদিকে, ২৬ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদসহ মোট ৩১ জন নিখোঁজ হন। ১১ নং সেক্টরের বিপরীতে পাক-বাহিনীর শক্তিশালী ঘাঁটি আহসম্মদ নগর ক্যাম্প কমান্ডার মেজর রিয়াজ জিপ গাড়িতে নকশী বিওপি ক্যাম্পে যাওয়ার পথে ২৬ নভেম্বর সকালে রাংটিয়া মোড়ে মুক্তিযোদ্ধা গুলি করে। গুলি মেজর রিয়াজের পায়ে বিদ্ধ হলে পেছনে ফেরার পথে রামেরকুড়া মসজিদের সামনে পাকিদের দালাল রাংটিয়া গ্রামের কাশেমকে রাংটিয়া গ্রামে মুক্তি বাহিনীর আস্তানা রয়েছে বলে বেধড়ক মারপিট করে। এতে দালাল কাশেম গুরুতর আহত হয় এবং ওই রাতেই ভারতে পালিয়ে জীবন বাঁচায়।
১৯৭১ সালের ২৭ নভেম্বর রাতে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার জাফর ইকবালের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা ঝিনাইগাতী সদরের রাজাকার ক্যাম্পের সেন্ট্রিকে কৌশলে আটক করে ক্যাম্পে অপারেশন চালিয়ে ৮টি রাইফেলসহ ৮ রাজাকার সদস্যকে আত্মসমর্পণ করিয়ে ধরে ভারতের সিসিংপাড়া ক্যাম্পে নিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা ঝিনাইগাতী অপারেশন শেষে ফিরে যাবার পথে আহাম্মদ আলী মেম্বারকে ঝিনাইগাতী থেকে ধরে নিয়ে গারোকোনা সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার সময় মহারশী নদীর তীরে তাকে হত্যা করে। পরদিন ২৯ নভেম্বর খৈলকুড়া গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা মকবুল হোসেনের পুত্র শিশু খালেক (১১), আড়াইআনী গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা এবিএম সিদ্দিকের ছোট ভাই শিশু ওমর আলী (১২), জড়াকুড়া গ্রামের সেকান্দর আলী, পাকিদের দালাল ভারুয়া গ্রামের গুজরত আলী ও পাকিদের দালাল ফাকরাবাদ গ্রামের আঃ রহমানসহ ৮ জনকে আহাম্মদনগর পাকী ক্যাম্পে ধরে নিয়ে ২৯ নভেম্বর রাতেই গুলি করে হত্যা করে এক গর্তে মাটি চাপা দেয়।
এর মাত্র ৭ দিন পর ৪ ডিসেম্বর পাক-হানাদার বাহিনীর শক্ত ঘাঁটি কামালপুর দুর্গের পতন হওয়ার সংবাদ পেয়ে এ অঞ্চলের পাকি ক্যাম্পের সৈন্যদের মনোবল ভেঙে পড়ে। যে কামালপুরে মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস ধরে প্রায় প্রতিদিনই রক্তেরঞ্জিত হচ্ছিল, সেই কামালপুর দুর্গের পতন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাক-বাহিনী মেঘালয় সীমান্তের সব এলাকায় মনোবল হারিয়ে ফেলে এবং দ্রুত পশ্চাৎপসারণ করে। কামালপুরে পরাজিত হয়ে পাকস্তানি সৈন্যরা পিছু হটতে থাকে। ৪ ডিসেম্বর রাত আনুমানিক দেড়টার দিকে পাক-বাহিনী তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার, আল বদরদের নিয়ে নকশী, শালচুড়া, আহাম্মদ নগর ক্যাম্প গুটিয়ে মোল্লাপাড়া ক্যাম্পের সৈন্যদের সঙ্গে নিয়ে পিছু হটে ওই রাতেই শেরপুর শহরে আশ্রয় নেয়। এভাবে বিনা যুদ্ধে ঝিনাইগাতী শত্রুমুক্ত হয়। ৫ ডিসেম্বর সকালে মিত্র বাহিনীর সহযোগিতায় মুক্ত ঝিনাইগাতীতে মুক্তিযোদ্ধারা প্রবেশ করে প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়ায়।
লেখক: সাংবাদিক
ভোরের আকাশ/রন