logo
আপডেট : ২৮ নভেম্বর, ২০২৪ ১৭:৪৪
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বিএনপির বৈঠক
জাতীয় ঐক্য বজায় রাখার আহ্বান মির্জা ফখরুলের
ভোরের আকাশ প্রতিবেদক

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বিএনপির বৈঠক

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, চলমান সংকট নিরসনে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন জাতীয় ঐক্য। আমাদের সামনে অনেক বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য বিশেষ করে যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি হয়ে দাঁড়ায়, যারা এর স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করতে চায়, তাদের প্রতিহত করার জন্য আমাদের অবশ্যই জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে হবে।

দেশের উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক শেষে একথা বলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে দলটির ৫ সদস্যের প্রতিনিধিদল অংশ নেয়। বৈঠকে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও সালাহউদ্দিন আহমেদ উপস্থিত ছিলেন।

বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘দেশের চলমান উদ্ভূত পরিস্থিতিতে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে দেখা করে কথা বলেছি। বিশেষ করে কয়েক দিন ধরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, কয়েকটি কলেজের শিক্ষার্থীদের যে সংঘর্ষ আমরা আমাদের দলের পক্ষে উদ্বেগ জানিয়েছি। আমরা আশা করেছি যে প্রধান উপদেষ্টা তার পরিষদ নিয়ে দ্রুত এসব বিষয়ে শান্তিপূর্ণ সমাধান করবেন। দেশে যেন কোনো পরিস্থিতির সৃষ্টি না হয়। বিশেষ করে বিভাগের পরিস্থিতি।’

তিনি বলেন, ‘একই সঙ্গে দ্রব্য মূল্যবৃদ্ধির কারণে জনগণের দুর্ভোগ হচ্ছে। আমরা বলেছি টিসিবির ট্রাক বৃদ্ধির কথা বলেছি। কৃষিতে সার বিতরণের যে সমস্যা আছে, সেগুলো নিরসনের কথা বলেছি। এখনও ফ্যাসিবাদের দোসররা নিয়ন্ত্রণ করছে। সে জন্য জনগণের পক্ষে যারা আছেন, তাদের নিয়ে আসার কথা বলেছি, যাতে বিষয়টি সহজ ব্যবস্থা করার জন্য অনুরোধ করেছি।’ তিনি বলেন, গার্মেন্টসহ সব সেক্টরের শ্রমিক যেন বেতন পান সেদিকে জোর দেয়া, আওয়ামী লীগের আমলের জোর-জবরদস্তি করে নির্বাচিত ইউপি চেয়ারম্যানদের অপসারণ করে নতুন নির্বাচন ও বিগত সরকারের আমলের দলের নেতাকর্মীদের নামে থাকা মামলা প্রত্যাহারে প্রধান উপদেষ্টার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি।

বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খান জানান, দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চলমান পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ ও সরকারকে পরামর্শ দিতে আজকের এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে।

তিন মাস না যেতেই আসল চেহারা বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে
’৯০ এর গণঅভ্যুত্থানে শহীদ ডা. শামসুল আলম খান মিলনের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে গতকাল ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ড্যাব) জাতীয় প্রেসক্লাবে এক আলোচনা সভার আয়োজন করে। ড্যাবের সভাপতি ডা. হারুন আল রশিদের সভাপতিত্বে ও জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব মো. মেহেদী হাসানের সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় আরও বক্তব্য দেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমানউল্লাহ আমান ও ফরহাদ হালিম ডোনার, ড্যাবের মহাসচিব ডা. মো. আবদুস সালাম, বিএনপির স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক ডা. মো. রফিকুল ইসলাম, ড্যাবের সাবেক সভাপতি এ কে এম আজিজুল হক প্রমুখ।

এই সভায় বক্তব্য দেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, ৫ আগস্টের বিপ্লবের তিন মাস না যেতেই আসল চেহারা বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। গত কয়েক দিনে ঢাকা-চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ ও হানাহানির ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেছেন, ‘এই চেহারা নিয়ে কোনো দিনই সাফল্য অর্জন করা যায় না, যতই বড় বড় কথা বলি, যতই লম্বা লম্বা বক্তৃতা করি। নিজের ঘরেই যদি বিভেদ থেকে যায়, আমরা সেটা কখনোই ঠিক করতে পারব না।’

বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য দীর্ঘ ১৫ বছর লড়াই করেছে, প্রাণ দিয়েছে, কারাগারে গেছে, নির্যাতিত হয়েছে। সেই মানুষগুলো ২০২৪-এর ৫ আগস্ট আরেকটি বিজয় অর্জন করেছে। সেই বিজয় অর্জন হয়েছে রাজপথে অনেক রক্তের মধ্য দিয়ে, অনেক প্রাণের ভেতর দিয়ে। কিন্তু তার ফল কি এই বাংলাদেশ? তিন মাস হয়নি, এখনই রাস্তায় রাস্তায় লড়াই শুরু হয়েছে। একজন আরেকজনের বুকের রক্ত ঝরাচ্ছি। এখন পত্রিকা অফিস পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, আক্রমণ করছে।’

তিনি বলেন, ‘এই কয়টা দিনে আমরা খুব চিন্তিত, উদ্বিগ্ন, ভয়াবহভাবে উদ্বিগ্ন। আপনি চিন্তা করতে পারেন, ধর্মকে কেন্দ্র করে কী উন্মাদনা শুরু হয়েছে বাংলাদেশে! আপনি চিন্তা করতে পারেন, যে মুক্ত স্বাধীন মিডিয়ার জন্য আমরা এত দিন লড়াই করলাম, তার অফিস পুড়িয়ে দিচ্ছে! এই বাংলাদেশ তো আমরা দেখতে চাই না, আমি অন্তত চাই না।’

বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘কী উন্মাদনা! কিছুসংখ্যক মানুষ আছেন...আপনাদের সোশ্যাল মিডিয়া আমি দেখি না সহজে। কিন্তু যখন দেখি, আতঙ্কিত হই। পুড়িয়ে দাও জ্বালিয়ে দাও- এ ধরনের কথাবার্তা। চিন্তা করতে পারেন, কোন জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশকে। আমরা কি বুঝি আমাদের ভয়টা কোথায়, আতঙ্কটা কোথায়? আমরা কি বুঝি আততায়ী কোথায় ছুরি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, আমাদের পেছনে। বুঝি না, বুঝলে এ ধরনের দায়িত্বহীন কথাবার্তা আমাদের মুখ দিয়ে বের হতো না।’

তিনি বলেন, ‘দুর্ভাগ্য আমাদের, কিছুসংখ্যক মানুষ- তারা নিজেদের অত্যন্ত জনপ্রিয় সবচেয়ে দেশপ্রেমিক মনে করেন, আর গোটা জাতিকে আজকে তারা বিভাজনের দিকে উসকে দিয়ে একটা অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন।’ কারও নাম উল্লেখ না করে বিএনপি মহাসচিব উপস্থিত চিকিৎসকদের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনারা গভীরভাবে চিন্তা করবেন, আমি কারও নাম বলব না। কারও নাম বলতে চাই না। আপনারা ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করবেন যে যারা আজকে দেশকে বিভাজনের দিকে ঠেলছে, অনৈক্যের দিকে ঠেলছে, তারা আমাদের আসলে শত্রু না মিত্র। এ জিনিসগুলো বুঝতে হবে। আমি কথাগুলো ইচ্ছে করেই আজকে তুলে ধরলাম।’

বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘আমি তীব্রভাবে নিন্দা জানাচ্ছি প্রথম আলো, ডেইলি স্টারসহ অন্যান্য সব পত্রিকার ওপর যে আক্রমণ শুরু হয়েছে। আমি তীব্র নিন্দা জানাই তার। কারণ আমি সারা জীবন সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছি। এটা আমার বিশ্বাস, আস্থা।’ তিনি বলেন, ‘গণতন্ত্র মানেটা কী, যে আপনি আপনার কথা বলবেন। আপনার সঙ্গে আমি একমত হতে না-ও পারি। কিন্তু আপনার মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে আমি আমার জীবন দিয়ে রক্ষা করব-এটাই গণতন্ত্র।’ তিনি বলেন, ‘আপনি এক ফ্যাসিস্টকে উৎখাত করেছেন। কারণ, সে আপনার গলা টিপে ধরেছিল, সে আমাদের মেরে ফেলছিল, কথা বলতে দিত না, ভোট দিতে দিত না, হত্যা করেছে, নির্যাতন করেছে। আবার এখন আরেকটা...একে বলতে দেওয়া যাবে না, একে নিশ্চিহ্ন করো, হাউ ডু ইউ জাস্টিফায়েড। আপনারা বলেন, এভাবে একটা সমাজ এগোতে পারে?’

বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘আমি ১৪-১৫ বছর ধরে লড়াই করেছি, বহুবার জেলে গেছি, যেকোনো সময় আবারও জেলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত আছি। কিন্তু আমি এই বাংলাদেশ দেখতে চাই না। আমি যা বিশ্বাস করি, আমার দল যা বিশ্বাস করে, আমি সেই কথা আমার প্রাণ গেলেও আমি বলব। আমি বিশ্বাস করি, উদারপন্থী গণতন্ত্রে, বিশ্বাস করি বাক্স্বাধীনতায়, ভোটের স্বাধীনতায়। আমি জানি, অনেকে অনেক কিছু বলেন, কিন্তু আমি এতটুকুও চিন্তা করি না। কারণ, আমরা রাস্তায় থেকে লড়ে লড়ে এই জায়গায় এসেছি। সময়-সুবিধামতো পালিয়ে যাই না আমরা, সামনেই দাঁড়াই।’

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আমি এই কথাটা আজকে এ জন্যই বলছি, ডা. মিলন যে প্রাণ দিয়েছেন। এখানে আমরা সবাই তার অনেক গুণগান করলাম। আমাদের কী দুর্ভাগ্য, কী ব্যর্থতা- আমরা মিলনের সেই আত্মত্যাগ সত্যিকার অর্থে বাস্তবে রূপ দিতে পারিনি। তারা ১৯৯০ সালে প্রাণ দিয়েছিলেন ভোটের অধিকারের জন্য, স্বৈরাচার দূর করার জন্য। আর আজকে এই ২০২৪ সালে ভোটের অধিকারের জন্য যুদ্ধ করতে হয়েছে। এ কোন জাতি আমরা। এবার যে সুযোগ হয়েছিল সবাই মিলে একসঙ্গে একজোটে একটা পরিবর্তন নিয়ে আসার। ছেলেরাও ছিল, আমরাও ছিলাম।’

আক্ষেপ প্রকাশ করে ফখরুল বলেন, ‘তিনটা মাস হয়নি এখনো, এর মধ্যে আমাদের আসল চেহারা বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। এই চেহারা নিয়ে কোনো দিনই সাফল্য অর্জন করা যায় না-যতই বড় বড় কথা বলি, যতই লম্বা লম্বা বক্তৃতা করি।’ তিনি দ্রুত সময়ের মধ্যে সংস্কার করে নির্বাচনের পথে যেতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।

 

ভোরের আকাশ/রন