স্বাস্থ্য খাতের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হওয়া সত্ত্বেও নন-মেডিকেল করে রেখে ‘বৈষম্য তৈরি’র প্রতিবাদে মহাসমাবেশ করেছে মেডিকেল টেকনোলজি ও ফার্মেসি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। গতকাল শুক্রবার (২৯ নভেম্বর) রাজধানীর শহীদ মিনারে ৬ দফা দাবিতে এ মহাসমাবেশ হয়। সংগঠনের সভাপতি আব্দুস সামাদ হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, ২০ ডিসেম্বরের মধ্যে ৬ দফা দাবি মেনে না নিলে আমরা আরও কঠোর কর্মসূচি দিতে বাধ্য হবো।
আব্দুস সামাদ বলেন, আমরা বিশ্বাস করি ৬ দফা রাষ্ট্রের সাধারণ জনগণের স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রিক আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। নানাবিধ বৈষম্য দূরীকরণে যে ৬ দফা দাবি আমরা উপস্থাপন করেছি সেগুলোর যথাযথ মূল্যায়ন, যৌক্তিকতা আলোচনা পর্যালোচনা এবং সর্বোপরি সেগুলোর আশু বাস্তবায়নের লক্ষ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের সমন্বিত একটি স্টেয়ারিং কমিটি গঠনের উদ্যোগ করা প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি। তাতে শিক্ষার্থী প্রতিনিধি ও পেশাজীবী পরিষদের প্রতিনিধিত্ব¡ নিশ্চিত করারও দাবি জানান তিনি। সেখানে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক আলী মুজাহিদ বলেন, আমি ৬ দফা দেখেছি। এগুলো দাবি নয়, অধিকার। আমি আপনাদের সঙ্গে সহমত পোষণ করছি। পরে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসউদ মহাবেশে বলেন, যৌক্তিক যেকোনো দাবির পক্ষে আমি সব সময় ছিলাম, আছি, থাকবো। আপনাদের এগুলো দাবি নয়, অধিকার। সুতরাং আমার পূর্ণ সমর্থন রইলো। অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে সহ-সভাপতি মোশাররফ হোসেন, মহাসচিব রিমন শিকদার, দপ্তর সম্পাদক মো. সোহেল রানাসহ সারাদেশ থেকে আসা হাজারো শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিলেন। তাদের মুহুর্মুহু সেøাগানে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার।
বৈষম্যবিরোধী মেডিকেল টেকনোলজি ও ফার্মেসি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের দাবিগুলো হলো-
১. স্বতন্ত্র পরিদপ্তর গঠন করতে হবে। মেডিকেল টেকনোলজিস্ট ও ফার্মাসিস্ট পেশাজীবী, শিক্ষার্থী, বেসরকারি চাকরিজীবী, পাস করা কর্মসংস্থানহীন জনবলের তদারকি, পেশাজীবীদের পেশাগত লক্ষ্য বাস্তবায়ন, বদলি, পদোন্নতি, উচ্চশিক্ষা, প্রশিক্ষণ, দক্ষতা বৃদ্ধি, সমন্বয়ের জন্য কোনো স্বতন্ত্র উইং, পরিদপ্তর কিংবা অধিদপ্তর নেই। এমনকি নীতি নির্ধারণী সকল জায়গায় অন্য স্টেকহোল। তাদের কোনো প্রকার অংশগ্রহণ না থাকা এবং একপেশে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা বাকি জনবলকে কোণঠাসা করে রাখা হয়েছে। অথচ স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার সুষ্ঠু বণ্টনে সকলের অংশগ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ এবং ন্যায্য বিষয়।
২. ডিপ্লোমা মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের দশম গ্রেড প্রদান করতে হবে। সরকারি চাকরিতে ডিপ্লোমা মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের দশম গ্রেডে উন্নীতকরণের বিষয়টি নতুন কোনো বিষয় নয়। স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়েই এ পেশা এবং পেশাজীবীদের পথচলা শুরু হলেও ১৯৮৯ সাল পরবর্তী মেডিকেল টেকনোলজিস্ট পেশাজীবীদের দশম গ্রেড বা দ্বিতীয় শ্রেণির পদমর্যাদা দাবিটি অব্যাহতভাবে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোতে বারংবার উপস্থাপিত হয়ে আসছে। অধিকার বাস্তবায়নে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে আন্দোলন, সংগ্রাম, সহায়ক কর্মসূচি পালন, দাপ্তরিক চিঠি চালাচালি, আবেদন, সর্বোপরি জনপ্রশাসন বিধি শাখার সমস্ত চাহিদা পূরণ করা হয়েছে তা সত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতনদের সদিচ্ছার অভাব, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও নানাবিধ উদ্দেশ্যে মন্ত্রণালয় অবিরতভাবে কোয়ারি দেওয়ার মাধ্যমে সময়ক্ষেপণ ও জটিলতাই তৈরি করেছে। সুতরাং দশম গ্রেড বাস্তবায়ন ও ব্লক পোস্টের অবসান ঘটানোসহ পদ পদবি, পদন্নোতির বিষয়গুলোকে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় রূপদান করা হোক। দেশের মানুষের কল্যাণ, পেশাজীবীদের আত্মমর্যাদা, সামাজিক অবস্থান, স্বাস্থ্যসেবায় গুরুত্ব বিবেচনা এবং এর অক্লান্ত পরিশ্রমকে স্বীকৃতি দেওয়া এখন সময়ের দাবি।
৩. মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের জন্য পদ সৃজন করতে হবে। রোগীর সেবাদান কার্যক্রমে চিকিৎসক নার্সের পাশাপাশি রোগ নির্ণয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জনবল মেডিকেল টেকনোলজিস্ট। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা গাইডলাইন অনুযায়ী ১ জন চিকিৎসকের বিপরীতে ৩ জন নার্স ও ৫ জন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট থাকা প্রয়োজন। দীর্ঘ ১৪ বছরেরও অধিক সময় প্রশাসনিক জটিলতায় মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের নিয়োগ কার্যক্রম বন্ধ থাকায় সরকারি চাকরিতে কর্মরত মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের সংখ্যা মাত্র ৪১০৬ এবং মোট পদ ৫৯৭৫টি। চিকিৎসক ও নার্সের বিদ্যমান সংখ্যার অনুপাত যেটি হওয়ার কথা ছিল ৮০ হাজারেরও বেশি। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের ঘাটতি রয়েছে। ফলে অনেক ক্ষেত্রে সঠিকভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা বা রোগ নির্ণয় করা সম্ভব হচ্ছে না। বর্তমানে সরকারিভাবে পর্যাপ্ত মেডিকেল টেকনোলজিস্ট নিয়োগ না থাকায় রোগীদের চিকিৎসা ব্যয়ও বেড়ে যাচ্ছে এবং সময়মতো সেবা পাওয়া যাচ্ছে না। ৫০ হাজার নতুন পদ সৃষ্টি এবং দ্রুত নিয়োগ দিলে এই ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব হবে এবং স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নত হবে।
৪. ডিপ্লোমা মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের জন্য দ্বিতীয় শ্রেণির পদমর্যাদা প্রদান করে দশম গ্রেডের পাশাপাশি গ্রাজুয়েট মেডিকেল টেকনোলজিস্টদেও জন্য নবম গ্রেডের পদ সহ ৩য় গ্রেড পর্যন্ত পদোন্নতির সুযোগ সৃষ্টি করার দাবিটি অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত এবং সময়োপযোগী। মেডিকেল টেকনোলজি শিক্ষায় ডিপ্লোমার পাশাপাশি বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে মেডিকেল টেকনোলজি বিষয় সমূহে উচ্চ শিক্ষা চালুর বিশ বছর পেরিয়ে গেলেও এর গ্র্যাজুয়েটদের জন্য কোনো প্রকার পদসৃজন করা হয়নি। দশ সহস্রাধিক গ্র্যাজুয়েট টেকনিক্যাল বিষয়ে যোগ্যতা দক্ষতা অর্জন করলেও তাদের কাজে লাগানো হচ্ছে না। সর্বোপরি, মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের কাজের সঠিক স্বীকৃতি এবং পদমর্যাদা নিশ্চিত করা হলে দেশের স্বাস্থ্যসেবার মান আরও উন্নত হবে। সঠিক পদমর্যাদা এবং বেতন কাঠামো পেলে টেকনোলজিস্টরা আরও দায়িত্বশীল এবং সক্রিয়ভাবে কাজ করবেন; যা দেশের স্বাস্থ্যখাতে সেবার গুণগত মান বাড়াবে।
ঢাকা আইএইচটি-কে ‘বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব মেডিকেল সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি’ নামকরণে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করতে হবে এবং উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য সকল আইএইচটিসমূহের জন্য মেডিকেল টেকনোলজিস্ট ও ফার্মাসিস্ট শিক্ষকদের স্বতন্ত্র ক্যারিয়ার প্ল্যান গঠন করে বিদ্যমান নিয়োগ বিধি ও অসংগতিপূর্ণ গ্রেড সংশোধন করতে হবে। সারাবিশ্বে ইনস্টিটিউট কেন্দ্রিক ধারণাটি সার্বজনীন এবং এর পরিসর বৃহত্তর। একটি ইনস্টিটিউট একই সঙ্গে শিক্ষা ও গবেষণার কাজ করে থাকে। এমনকি শিক্ষার সর্বোচ্চ সনদ পিএইচডি কিংবা পোস্ট-ডক্টরাল স্বীকৃতি দেয়। ইনস্টিটিউট নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে উচ্চ গবেষণার ও পেশাগত দক্ষতা অর্জনের স্থান। যেখানে ব্যবহারিক বা হাতে কলমে শিক্ষা মুখ্য।
বাংলাদেশে শিক্ষাক্ষেত্রে ইনস্টিটিউট ধারণাটি ডিপ্লোমা শিক্ষা কেন্দ্রিক যেখানে ৪ বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা কোর্স পরিচালিত হয়। যদিও আরো কিছু ইনস্টিটিউট আছে তাদের অবকাঠামোগত ও অন্যান্য সুবিধাদি আলাদা। হেলথ টেকনোলজি ইনস্টিটিউটগুলো শুরুর প্রাক্কালে যে জনবল কাঠামোয় তা তৈরি হয়েছিল আজ পাঁচ দশকের পরে এসেও এগুলোকে জনবল কেন্দ্রিক সংস্কার করা হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক চার বছর মেয়াদি ব্যাচেলর কোর্সগুলো চালু করার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ পরিদর্শক স্বাক্ষরিত কিছু শর্তসমূহ প্রতিপালনের জন্য নির্দেশনা ছিল তার মধ্যে অন্যতম হলো আনুপাতিক হারে শিক্ষক নিয়োগ যাদের যোগ্যতার ক্ষেত্রগুলো ক্রমান্বয়ে প্রভাষক থেকে সহযোগী অধ্যাপক পর্যন্ত। এক এক করে সরকারি পর্যায়ে ২৩টি প্রতিষ্ঠান অনুমোদন দেওয়া হয়েছে ৩-৪টি ব্যতীত বাকি সবগুলোয় বেহাল দশা। সরকারের রাজস্ব ব্যয়ের মাধ্যমে এসব প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে এসব প্রতিষ্ঠানগুলোকে সত্যিকার্থে গড়ে তোলা হলে সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যসেবার পরিধি বাড়বে। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিশ্বায়নের পথে হাঁটতে হলে এ ভঙ্গুর শিক্ষাব্যবস্থা দিয়ে দক্ষ জনবল তৈরি চিন্তা শুধু অসম্ভবই নয় বরং এটি দিবাস্বপ্ন।
শিক্ষার এ অসুস্থ খাতকে নিয়ে চিন্তা-ভাবনার লোক নেই। স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত এ প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষাকে যুগোপযোগী এবং মানসম্মত করার জন্য, বিশ্বমানের করে গড়ে তোলার জন্য এটির পরিপূর্ণ সংস্কারের কোনো বিকল্প নেই।
৫. মেডিকেল টেকনোলজি কাউন্সিল গঠনের মাধ্যমে পেশাদার লাইসেন্স প্রদান, ডিপ্লোমা মেডিকেল অ্যাডুকেশন বোর্ড গঠন এবং প্রাইভেট সার্ভিস নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের ৮টি অনুষদ থাকলেও শুধুমাত্র মেডিকেল টেকনোলজিস্ট ডেন্টাল ডিপ্লোমা ডিগ্রিধারীগণ দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যমান বিএমডিসি আইনে অন্তর্ভুক্তির জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন। যেহেতু সমশিক্ষাগত যোগ্যতায় মেডিকেল এসিস্ট্যান্টদেরকে বিএমডিসির ৬১ নং আইনের ১৫ ধারা ও পঞ্চম তফসিলের মাধ্যমে মেডিসিন, সার্জারি ও মিডওয়াইফারী পেশায় নিযুক্ত থাকার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। অন্যদের পেশাজীবীদের ন্যায় মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের জন্য একটি নির্দিষ্ট পেশাদার কাউন্সিল গঠন করে তার মাধ্যমে স্বাস্থ্যের এ পেশাদারদের নিবন্ধন এবং লাইসেন্স জরুরি।
৬. বি ফার্মসহ সকল অনুষদের বিএসসি ও এমএসসি কোর্স চালু করা এবং স্কলারশিপসহ প্রশিক্ষণ ভাতা চালু করতে হবে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রীয় চিকিৎসা অনুষদ থেকে ডিপ্লোমা ইন মেডিকেল টেকনোলজি (সকল অনুষদ) কোর্সসম্পন্ন করা প্রচুর সংখ্যক শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি এইচএসসি (বিজ্ঞান) থেকে পাস করা প্রচুর শিক্ষার্থী বিএসসি ইন হেলথ টেকনোলজি ভর্তি হতে আগ্রহী। বস্তত সংশ্লিষ্ট ডিপ্লোমা কোর্সের উচ্চশিক্ষার দ্বার উন্মোচিত হয় এসব উচ্চশিক্ষার মাধ্যমেই। অন্যদিকে ফার্মাসিস্টরা নিজেদের পেশাগত দক্ষতা দিয়ে সরকারি হাসপাতালের বহিঃবিভাগ ফার্মেসিতে সরবরাহকৃত ওষুধ চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী রোগীদের হাতে পৌঁছে দেয়। পাশাপাশি রোগীদের ডোজ, মাত্রা, কাউন্সিলিং, এন্টিবায়োটিক রেজিস্টান্ট প্রতিরোধ সম্পর্কে রোগীদের সঠিক ধারণা প্রদান করে। মেডিকেল টেকনোলজি ও ফার্মেসি শিক্ষা ও পেশার নানাবিধ বৈষম্য দূরীকরণের লক্ষ্যে গত ০৯/১০/২৪ থেকে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগের দৃষ্টি আকর্ষণ করে যাচ্ছি। আমাদের দাবি-দাওয়ার বিষয়গুলো লিখিতভাবে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকে জানানো হয়েছে।
ভোরের আকাশ/রন