logo
আপডেট : ২ ডিসেম্বর, ২০২৪ ১০:২৫
পাচার করা অর্থ ফেরানো সম্ভব?
শ্বেতপত্র ড. ইউনূসের হাতে
সাজেদা হক

পাচার করা অর্থ ফেরানো সম্ভব?

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরের শাসনামলে প্রতি বছর গড়ে ১৬ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে বলে দাবি করেছে ‘বাংলাদেশের বিদ্যমান অর্থনৈতিক অবস্থার শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি’। এ সংক্রান্ত শ্বেতপত্র গতকাল রোববার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের হাতে তুলে দিয়েছেন কমিটির প্রধান বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। এ হিসেবে ১৫ বছরে পাচার করা হয়েছে ২৪০ বিলিয়ন ডলার। এখন এই অর্থ ফেরত আনা সম্ভব কি না, তা নিয়ে চলছে আলোচনা। এদিকে, অর্থ পাচার রোধে কাজ করছে ৭টি দপ্তর। শতাধিক ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে। ৩৪৩ ব্যক্তির দুই শতাধিক প্রতিষ্ঠান পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, কয়েকটি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের এ সংক্রান্ত চুক্তি রয়েছে। ফলে পাচার করা অর্থ ফেরানো সম্ভব হতে পারে।

গত ২৮ আগস্ট দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক চিত্র জানতে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে ১২ সদস্যের শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি গঠন করা হয়। ৯০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছিল। সেই প্রতিবেদন গতকাল হস্তান্তর করা হয়; যা আজ আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হবে। শ্বেতপত্রে ছয়টি বিষয়ে আলোকপাত করার নির্দেশনা ছিল প্রধান উপদেষ্টার। সেগুলো হলো- সরকারি আর্থিক ব্যবস্থাপনা; মূল্যস্ফীতি ও খাদ্য ব্যবস্থাপনা; বাহ্যিক ভারসাম্য; জ্বালানি ও বিদ্যুৎ; বেসরকারি বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থান। তবে গত শুক্রবারই এই শ্বেতপত্রের কিছু তথ্য প্রকাশ করে বেশ কয়েকটি গণমাধ্যম। তাতে দাবি করা হয়, প্রতি বছর গড়ে ১৬ বিলিয়ন ডলার পাচার করেছে আওয়ামী লীগ সরকারের সুবিধাভোগী আমলা, রাজনীতিবিদ এবং ব্যবসায়ীরা। এই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে অর্থনীতিবিদরা প্রশ্ন তুলেছেন পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আসবে কী? মূলত, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দেশের আর্থিক খাতে লুটপাট হওয়া ১১০ বিশেষ ইস্যু নিয়ে তদন্ত করে দেশের আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা ও বাংলাদেশ ব্যাংক। ৫ আগস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত অনেকের ব্যাংক হিসাব জব্দ করে সার্বিক বিষয় নজরদারির আওতায় আনা হয়। তাদের এসব ব্যাংক হিসাবে ১৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা আটকাতে পেরেছে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। তবে আরও দ্রুত এসব ব্যাংক হিসাব জব্দ করা গেলে আরও বেশি অর্থ আটকানো যেত বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। বিএফআইইউ, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন বিভাগের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

সূত্র বলছে, সন্দেহজনক লেনদেন ও বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগে প্রতিদিনই শতাধিক ব্যাংক হিসাব জব্দ করছে বিএফআইইউ। একই সঙ্গে ৩৪৩ ব্যক্তির দুই শতাধিক প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমও পর্যালোচনা করা হচ্ছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে গবেষণা সংস্থা চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের রিসার্স ফেলো ও অর্থনীতিবিদ এম হেলাল আহমেদ জনি বলেন, সাধারণত কোনো হিসাব ব্লক করতে হলে তার বিপরীতে প্রাথমিক তদন্ত করতে হয়। বিএফআইইউ প্রাথমিক তদন্তের মাধ্যমে ব্যাংক হিসাবগুলো জব্দ করেছে। এ ক্ষেত্রে সন্দেহজনক ব্যক্তির লেনদেনে প্রথমেই নিষেধাজ্ঞা দিয়ে তারপর তদন্ত করা যেত। তা ছাড়া ৫ আগস্টের পর কী পরিমাণ অর্থ বের করে নেওয়া হয়েছে এবং এ ক্ষেত্রে ব্যাংকের কোনো কর্মকর্তা সহায়তা করেছেন কি না, সে বিষয়েও তদন্ত হওয়া দরকার বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।

বিএফআইইউ সূত্রে জানা যায়, এরই মধ্যে ২২৫টি তদন্ত রিপোর্ট সিআইডি এবং দুদকে পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে ২০টি ঘটনার অডিট সম্পন্ন হয়েছে। সবাই বিগত সরকারের আমলে অবৈধ সুবিধা নেওয়া ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। শিগগির বাকিগুলোর অডিট সম্পন্ন করে দুদক ও সিআইডিতে পাঠানো হবে বলে নিশ্চিত করেছেন বিএফআইইউর একজন কর্মকর্তা।

সূত্র জানায়, আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা জোট এগমন্টের সঙ্গে যুক্ত ১৭৭টি দেশ ছাড়াও একাধিক দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি রয়েছে বিএফআইইউর। বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া সম্ভাব্য সব দেশে চিঠি পাঠানো হয়েছে। আন্তর্জাতিক সহায়তায় পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতে সব রকম প্রচেষ্টা চালাচ্ছে সরকার।

সম্প্রতি এক সেমিনারে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দেশ থেকে প্রতি বছর ১২ থেকে ১৫ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে। এর অন্যতম মাধ্যম ছিল বাণিজ্য। পাচার হওয়া এসব অর্থ ফেরত আনা সম্ভব। তবে তা সময়সাপেক্ষ। অর্থ পাচার বন্ধে রাজনীতি, আমলাতন্ত্র ও ব্যবসাকে আরও দায়িত্বশীল হতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

দেশের প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা বেনামে প্রতিষ্ঠান খুলে দেশের বিভিন্ন ব্যাংক থেকে কয়েক লাখ কোটি টাকা বের করে নিয়েছেন বলে বিভিন্ন তদন্তে উঠে এসেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলোর ভুয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীও দেখানো হয়েছে। একই সঙ্গে ওইসব কোম্পানি সরকারের বিভিন্ন সুবিধা গ্রহণ করেছে।

গত ২৯ সেপ্টেম্বর বিদেশে পাচার হওয়া সম্পদ দেশে ফেরত আনা এবং ব্যবস্থাপনার জন্য আন্তঃসংস্থা টাস্কফোর্স পুনর্গঠন করে সরকার। এই টাস্কফোর্সের সভাপতি করা হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে। আর টাস্কফোর্সকে সাচিবিক সহায়তা দিচ্ছে বিএফআইইউ।

এ ছাড়া বিএফআইইউ বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে অর্থসম্পদ সম্পর্কে জানতে বিভিন্ন দেশে চিঠি দেওয়াও শুরু করে। অর্থপাচার প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে সিআইডি, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, এনবিআর, কাস্টমস, পরিবেশ অধিদপ্তর, বিএসইসি ও দুদকও।

এ বিষয়ে গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মানীয় ফেলো ড. মুস্তাফিজুর রহমান ভোরের আকাশকে বলেন, যেহেতু আমাদের দেশ থেকে পাচারের টাকা ফেরত নিয়ে যাওয়ার উদাহরণ আছে, সুতরাং আমরা পারব না কেন? যাদের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি আছে, নতুন চুক্তি সম্পাদন করে ও ইন্টারপোলের সাহায্যে এসব সম্পদ দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব।

বিএফআইইউর একজন কর্মকর্তা নাম না প্রকাশ করার শর্তে ভোরের আকাশকে জানান, রিসিভার নিয়োগ দেওয়ার আগে অন্তত পাঁচটি ধাপ অতিক্রম করতে হয়। এরপর রিসিভার নিয়োগ হয়। প্রথমত, অর্থ পাচারে জড়িত সন্দেহজনক অ্যাকাউন্ট চিহ্নিত করা; দ্বিতীয়ত, সন্দেহজনক অ্যাকাউন্ট তলব বা জব্দ করা; তৃতীয়ত, লেনদেনের পদচিহ্ন অনুসরণ করে অর্থ পাচার শনাক্ত করে দুদক বা সিআইডিকে পাঠানো; চতুর্থত, দুদক বা সিআইডির মাধ্যমে আদালতে অর্থ পাচারের মামলা। সব শেষে আদালতের নির্দেশে দেশীয় সম্পদ ক্রোক করার জন্য রিসিভার নিয়োগ এবং বিদেশ থেকে অর্থ ফেরাতে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা। এই প্রক্রিয়ায় অর্থ আদায় করতে হয়। এখন পর্যন্ত এস আলম ও সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান জাবেদ ছাড়া অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের অর্থ পাচার শনাক্তের কাজ শেষ হয়নি। তাই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না।

তবে বিএফআইইউর একাধিক কর্মকর্তা জানান, অর্থ পাচার রোধ ও পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনার বিষয়ে আপসহীন সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। প্রথমত, পাচারের সঠিক তথ্য উদ্ধার, পরিমাণ নির্ণয় ও পরে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার দিকে আগানো হবে। এক্ষেত্রে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। যদি কোনো প্রভাবশালী ব্যবসায়ী গ্রুপের বিরুদ্ধে পাচারের তথ্য প্রমাণিত হয়, তাহলে জড়িতদের বিরুদ্ধে নেওয়া হবে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা। কিন্তু তাদের ব্যবসায় ক্ষত সৃষ্টি হতে দেওয়া হবে না। অতীতে বাংলাদেশে অনেক ব্যবসার মালিকানা পরিবর্তন হয়েছে, ভবিষ্যতেও হতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন তারা।

 

ভোরের আকাশ/রন