বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ৫ আগস্ট সরকার পতন হয়। ছাত্র-জনতার আন্দোলন শুরু হওয়ার পর থেকে সরকার পতন হওয়া পর্যন্ত এবং তৎপরবর্তী সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছে অন্তত ৪৪ জন পুলিশ সদস্য। এ সময় থানাসহ পুলিশের প্রায় পাঁচ শতাধিক স্থাপনার পাশাপাশি ব্যক্তিগত অনেক সম্পত্তি ক্ষতিগ্রস্ত ও লুটপাট করা হয়। পুলিশ সদর দপ্তরের দেওয়া তথ্য অনুসারে, থানাসহ পুলিশের ৪৬০টি স্থাপনায় হামলা, অগ্নিকাণ্ড ও ভাঙচুর করা হয়েছে। এর মধ্যে ২২৪টি স্থাপনায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এছাড়া ৫৮টি থানা, ২৬টি ফাঁড়ি, ২টি তদন্তকেন্দ্র, ১০৬টি পুলিশ বক্স, ২৯টি অফিস ও তিনটি অন্যান্য স্থাপনা। এ ছাড়া ভাঙচুরের শিকার ২৩৬টি স্থাপনার মধ্যে ৫৬টি থানা, ২৪টি ফাঁড়ি, ১০টি তদন্তকেন্দ্র, ৩০টি পুলিশ বক্স, ২৮টি অফিস, পুলিশ লাইন্সের স্থাপনা ১৫টি এবং ৭৩টি অন্যান্য স্থাপনা ভাঙচুর করা হয়। এর মধ্যে ঢাকা মহানগর এলাকায় (ডিএমপি) ৩৩টির বেশি স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যার মধ্যে ২১টি থানা ভাঙচুর করা হয়েছে। ১০টি থানা অগ্নিকাণ্ডের শিকার হয়েছে। এসময় বেশিরভাগ স্থাপনায় লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে।
পুলিশ সদস্যরা বলছেন, ৫ আগস্ট পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় পরবর্তী সময়ে থানাভিত্তিক ক্ষয়ক্ষতির একটি তালিকা করা হয়েছে। সেই তালিকায় নেই পুলিশ সদস্যদের ব্যক্তিগত ক্ষয়ক্ষতির হিসাব। তারা বলছেন, পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ব্যক্তিগত ক্ষয়ক্ষতির কোনো তালিকাও চাওয়া হয়নি। নেওয়া হয়নি কোনো উদ্যোগও। ফলে আড়ালে পড়ে আছে বিষয়টি। আবার পুলিশের অনেক সদস্য বলছেন, পুলিশ সদর দপ্তর স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে দিতে না চাইলে তাদের নিজ থেকে ক্ষতিপূরণ চাওয়ার কোনো সুযোগও নেই। সরকার পতনের পর ঢাকাসহ সারা দেশেই পুলিশে রদবদল হয়েছে। বেশিরভাগ সদস্যকে এক জেলা থেকে আরেক জেলায় বদলি করা হয়েছে। এমন অবস্থায় ক্ষতিপূরণের আশায় কয়েকবার পুলিশ সদর দপ্তরে আসা-যাওয়াও সম্ভব নয়।
ঢাকাসহ দেশের বেশিরভাগ থানায় পুলিশের থাকার জন্য ব্যারাক রয়েছে। বেশিরভাগ পুলিশ সদস্য ব্যারাকে থেকে চাকরি করেন। ৫ আগস্ট পুলিশের ওপরে হামলা চলাকালে ব্যারাকেও ব্যাপক লুটপাট করা হয়। এতে পুলিশ সদস্যদের ব্যক্তিগত যানবাহনে অগ্নিসংযোগ ও লুট করা হয়েছে। এছাড়া ব্যারাকে থাকা পুলিশ সদস্যদের টাকা-পয়সা, মোবাইল, ল্যাপটপসহ মূল্যবান সামগ্রী লুটপাট করা হয়।
হামলার ঢাকার চিত্র নিয়ে কথা বলেছেন আদাবর থানায় সেই সময়ে চাকরিরত থাকা উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. রফিকুল ইসলাম। বর্তমানে তিনি শেরপুর সদর থানায় কর্মরত আছেন। তিনি বলেন, জুলাইয়ে ছাত্র আন্দোলন চলাকালীন ব্যাংকগুলোতে টাকা সংকট দেখা দিলো। আমার দুই মাসের বেতনের টাকা তুলে ব্যারাকে রেখেছিলাম। ভেবেছিলাম আন্দোলন শেষ হলে বাড়ি যাওয়ার সময় টাকাগুলো নিয়ে যাবো। পরে ৫ আগস্ট থানায় হামলা হলে ব্যারাকে ট্রাংকে থাকা টাকাসহ সব কিছুই লুট হয়ে যায়। একই থানায় চাকরিরত এসআই আনিসুর রহমান জানান, গ্রামের বাড়িতে ঘর তোলার জন্য ব্যাংক থেকে ২ আগস্ট ৫ লাখ টাকা লোন নিয়েছিলেন। আন্দোলনের সময় থানাকে নিরাপদ স্থান মনে করে সেখানে টাকাগুলো রেখেছিলেন। ৫ আগস্ট থানায় হামলার সময় তার টাকাও নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা।
এই দুই পুলিশ কর্মকর্তার মতো আদাবর থানার ব্যারাকে থাকা শতাধিক পুলিশ সদস্যের টাকা-পয়সাসহ মূল্যবান সম্পত্তির সব কিছুই লুট করে যায় দুর্বৃত্তরা। সরকার থেকে পুলিশ সদস্যদের ব্যক্তিগত সম্পত্তির কোনো ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে কিনা, জানতে চাইলে এসআই রফিকুল ইসলাম বলেন, ৫ আগস্ট থানার হামলার পর একটি ক্ষয়ক্ষতির তালিকা করা হয়েছিল। তবে পুলিশ সদস্যের ব্যক্তিগত মালামাল ক্ষয়ক্ষতির কোনো তালিকা করা হয়নি। আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে ক্ষতিগ্রস্তদের কাছে কোনো আবেদন চাননি। আর আমরাও কোনো আবেদন করিনি।
গত ৫ আগস্ট হাজারীবাগ থানায় হামলার সময় থানার একাধিক গাড়ি ও মালামাল ভাঙচুর, আগুন ধরিয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। ওই ঘটনায় থানায় দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদের ব্যক্তিগত অন্তত ১০টি মোটরসাইকেল ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। থানা ভবনে পুলিশের ব্যারাকে লুটপাট করা হয়। টাকা-পয়সাসহ পুলিশের জিনিসপত্র রাখার ট্রাংকও নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। এসআই মো. ওয়াহিদের একটি নতুন অ্যাপাচি ৪ভি মোটরসাইকেল আগুনে পুড়িয়ে দেয় বিক্ষুব্ধ জনতা। পুলিশ কর্মকর্তা ওয়াহিদ বলেন, সেদিন আসলে কী হবে, কেউ বলতে পারছিল না। আমরা সবাই নিজ নিজ প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করছিলাম। পরে থানায় হামলার সময় সবাই প্রাণভয়ে থানা এলাকা থেকে ডিসি অফিসের দিকে চলে যাই। আমাদের কয়েকজনের মোটরসাইকেলসহ সিংহভাগ পুলিশ সদস্যের টাকা, মোবাইল ফোনসহ জিনিসপত্র রাখার ট্রাংকও নিয়ে গেছে দুর্বৃত্তরা।
রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকায় পুলিশ সদস্যদের পরিবার নিয়ে থাকার জন্য দুটি বহুতল ভবন (কোয়ার্টার্স) রয়েছে। এই দুটি কোয়ার্টার্সের অন্তত শতাধিক পুলিশ সদস্য পরিবার নিয়ে বসবাস করেন। ৫ আগস্ট ও ৬ আগস্ট এই কোয়ার্টার্স দুটিতে লুটপাট করা হয়। সেসময় পুলিশ সদস্যদের পরিবার প্রাণভয়ে ভবন ছেড়ে অন্যত্রে চলে যায়। টানা দুদিন ধরে চলা লুটপাটে শতাধিক পুলিশের পরিবারের টাকা-পয়সা, স্বর্ণ-গয়না এমনকি ঘরের আসবাবপত্রও লুটপাট করা হয়। এ ঘটনায় কোনো তালিকা করেনি পুলিশ সদর দপ্তর। এ বিষয়টি নিয়ে ভবন দুটির কোনো পুলিশ সদস্য গণমাধ্যমের সঙ্গে কোনো কথা বলতে রাজি হননি।
আগস্টে পুলিশের ওপর হামলার ঘটনা শুধু ঢাকায় নয়। রাজধানীর বাইরে বেশিরভাগ জেলায় থানার পাশাপাশি পুলিশের বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। এমনকি অনেক এলাকায় পুলিশ সদস্যদের গ্রামের বাড়িতেও হামলা ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স) ইনামুল হক সাগর বলেন, এ বিষয়টি নিয়ে আমরা কাজ করছি। তালিকা করা হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে তাদের ক্ষতিপূরণের বিষয়টি দেখা হবে।
ভোরের আকাশ/রন