উদ্বেগজনক পর্যায়ে রয়েছে দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি। একই সঙ্গে শনাক্ত হচ্ছে জিকা ও চিকুনগুনিয়া রোগী। আবার শীতজনিত রোগের মৌসুমও চলছে। করোনা সংক্রমণও হচ্ছে। এই পাঁচটি রোগের মধ্যে অধিকাংশ উপসর্গের মিল থাকায় শঙ্কিত জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, একই সময়ে এই সব রোগের প্রাদুর্ভাব থাকায় বিপাকে পড়ছেন চিকিৎসক ও রোগীরা। উপসর্গে মিল থাকায় পরীক্ষা করানোর আগ পর্যন্ত বিড়ম্বনায় পড়ছেন আক্রান্তরা। বিড়ম্বনা ও সময়ক্ষেপণে রোগীর চিকিৎসা ব্যাহত হচ্ছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু, করোনা, জিকা, চিকুনগুনিয়া এবং শীতজনিত রোগের উপসর্গগুলোর মধ্যে সর্দি-কাশি, জ্বর, গলাব্যথা, শরীর ব্যথা, উচ্চ তাপমাত্রা ও শ্বাসকষ্ট রয়েছে।
একই সময়ে ডেঙ্গু, জিকা ও চিকুনগুনিয়া আতঙ্কে রাজধানীবাসী। এই তিন রোগের একই বাহক ‘এডিস মশা’। বর্তমানে চলছে ডেঙ্গুর দাপট। ডেঙ্গুর তথ্য থাকলেও জিকা ও চিকুনগুনিয়ার পরিস্থিতি কী, তা জানার স্বাস্থ্যবিভাগের কেন্দ্রীয় কোনো ব্যবস্থা নেই। এই তিন রোগ হয়ে উঠছে নীরব ঘাতক।
জিকা ও চিকুনগুনিয়া
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান-আইইডিসিআর চলতি বছর সারাদেশে ১১ জন জিকা ভাইরাস আক্রান্ত রোগী শনাক্ত করেছে। এছাড়া ৬৭ জনের চিকুনগুনিয়া ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। গত সোমবার মহাখালীতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য তুলে ধরেন মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. আবু জাফর।
মহাপরিচালক জানান, জিকা ও চিকুনগুনিয়া আক্রান্তের অধিকাংশই রাজধানীর ঢাকার বাসিন্দা। ডেঙ্গু ভাইরাস শনাক্ত করতে নিয়ে এই দুইটি ভাইরাসের রোগী মিলেছে। জিকা ও চিকুনগুনিয়ায় মৃত্যু হার কম। তাই আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।
এ বছর বেসরকারি হাসপাতালেও চিকুনগুনিয়া আক্রান্ত রোগী পাওয়া যাচ্ছে বলে জানিয়েছে হাসপাতালগুলো। নভেম্বরের প্রথম ২৭ দিনে বেসরকারি স্কয়ার হাসপাতালে ৩১৪ জন রোগী চিকুনগুনিয়ার চিকিৎসা নিয়েছেন। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরাও বলছেন, তাদের চেম্বারে চিকুনগুনিয়ার লক্ষণ-উপসর্গ নিয়ে রোগীরা আসছেন।
জিকার বিষয়ে আইইডিসিআরের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে রোগের কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। বাকি ২০ শতাংশ ক্ষেত্রে কিছু উপসর্গ দেখা দেয়। আক্রান্ত ব্যক্তির চামড়ায় লালচে দানার মতো ছোপ (র্যাশ) দেখা দেয়। সঙ্গে মাথাব্যথা, চোখ লালচে হওয়া, মাংসপেশি ও গিঁটে ব্যথা থাকে। আক্রান্ত হওয়ার ৩ থেকে ১২ দিনের মধ্যে উপসর্গ দেখা দেয়, থাকে ২ থেকে ৭ দিন।
আইইডিসিআর জানিয়েছে, জিকার কোনো সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। এর চিকিৎসা উপসর্গভিত্তিক। আক্রান্ত ব্যক্তিকে বিশ্রাম নিতে হবে, প্রচুর পানি ও তরল জাতীয় খাবার খেতে হবে, জ্বর ও ব্যথার জন্য চিকিৎসকের পরামর্শমতো ওষুধ খেতে হবে। রোগীর অবস্থার অবনতি হলে কাছের সরকারি হাসপাতালে যোগাযোগ করতে হবে বা রোগীকে ভর্তি করাতে হবে।
আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরীন জানিয়েছেন, এ বছর বেশ কয়েকজন চিকুনগুনিয়া রোগী শনাক্ত হয়েছে। অন্যদিকে আইসিডিডিআরবির পরীক্ষাগারে এক মাসে ২৭ জন চিকুনগুনিয়া রোগী শনাক্ত হয়েছে। রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. হালিমুর রশিদ কিছু দিন আগে দায়িত্ব নিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা এখন ডেঙ্গু নিয়ে ব্যস্ত। ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা যেন ঠিকমতো হয়, আমাদের মনোযোগ সেই দিকে।’
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানায়, সংক্রামক মশা কামড়ানোর চার থেকে সাত দিনের মধ্যে দেহে চিকুনগুনিয়ার উপসর্গ দেখা যায়। এটি হলে সাধারণত হঠাৎ করে তীব্র জ্বর শুরু হয়। সেই সঙ্গে শরীরের অস্থি সন্ধিতেও ব্যথা অনুভূত হয়। এছাড়া চিকুনগুনিয়ার আর যেসব লক্ষণ দেখা যায় তার মধ্যে রয়েছে, মাংস পেশি ও মাথাব্যথা, বমি বমি ভাব, ক্লান্তি ও চামড়ায় ফুসকুড়ি। অস্থি সন্ধির ব্যথা খুব তীব্র হতে পারে যা কয়েক দিন থেকে কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। চিকুনগুনিয়ার কোনো সুনির্দিষ্ট অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ নেই। সাধারণত উপসর্গ দেখে ব্যথা কমানোর জন্য চিকিৎসা দেওয়া হয়। বাণিজ্যিকভাবে চিকুনগুনিয়ার কোনো প্রতিষেধক টিকা পাওয়া যায় না বলে জানায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
ডেঙ্গুর ভয়াবহতা
গত কয়েক বছর ধরে দেশে বছরজুড়েই ডেঙ্গুর দাপট লক্ষ্য করা যাচ্ছে। চলতি বছরের ২ ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে ৯৩ হাজার ৫৫ জন এবং মারা গেছেন ৪৯৭ জন। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বলছেন, ডেঙ্গুর মৌসুম শেষ। কিন্তু ডেঙ্গুতে সংক্রমণ ও মৃত্যু কমছে না। চলতি বছরের নভেম্বর মাসেই ডেঙ্গুতে সবচেয়ে বেশি ১৭৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর ডিসেম্বরের দুদিনেই মারা গেছেন ৯ জন। পরিস্থিতির উন্নতি হবে কি-না তা নিয়ে নিশ্চিত করে কেউ কিছু বলতে পারছেন না। ঢাকা দক্ষিণ ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে মশা নিয়ন্ত্রণে কিছু কাজ চোখে পড়ে। দেশের অন্যান্য সিটি করপোরেশন, শহর ও গ্রামে মশা নিয়ন্ত্রণে তেমন কোনো কর্মকাণ্ড চোখে পড়ে না। মশা না কমলে ডেঙ্গুর সংক্রমণ ও ডেঙ্গুতে মৃত্যু কমে আসার সম্ভাবনা কম।
সরকারের রোগনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক মো. হালিমুর রহমান বলেন, নভেম্বরে ডেঙ্গু কমে আসে। এ বছর তা হতে দেখছি না। সিটি করপোরেশনের মশা মারার কাজটি ঠিকমতো হচ্ছে বলে মনে হয় না। মশা না কমলে ডেঙ্গু কমবে না। তবে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ডেঙ্গুর সংক্রমণ কমে আসবে বলে আশাপ্রকাশ করেন তিনি।
করোনা ভাইরাস: দেশে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ অব্যাহত রয়েছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বলছেন, দেশে সরকারি উদ্যোগে করোনা প্রতিরোধ কার্যক্রম বিশেষ করে করোনা শনাক্তের কাঠামো সংকুচিত হয়ে গেছে। দেশের সর্বত্র নমুনা সংগ্রহ ও শনাক্ত কার্যক্রম নেই বললেই চলে। শনাক্তের ব্যবস্থা অপ্রতুল হওয়ায় করোনা রোগীর সার্বিক পরিস্থিতি জানা যাচ্ছে না। তবে করোনা ভাইরাস ভয়ঙ্কর রূপ নিতে বেশি সময় লাগে না।
এদিকে গতকাল সোমবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের করোনাবিষয়ক দৈনিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গত ২৪ ঘণ্টায় মাত্র ২৫টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এর মধ্যে শনাক্ত হয়েছে ১ জন। অর্থাৎ নমুনার বিপরীতে এখনও করোনা শনাক্তের হার ৪ শতাংশ।
প্রতিবেদনে আরও জানানো হয়, গতকাল সোমবার পর্যন্ত দেশে ২০ লাখ ৫১ হাজার ৫১২ জনের দেহে করোনা শনাক্ত হয়েছে। আর এই সময়ে করোনায় মারা গেছেন ২৯ হাজার ৪৯৯ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) ডা. মো. রিজওয়ানুর রহমান জানান, বিশ্বের বেশ কিছু দেশে কোভিড-১৯ এর নতুন ভ্যারিয়েন্ট জেএন.১ এর সংক্রমণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এমতাবস্থায় উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে বিশেষ করে হাসপাতাল/চিকিৎসাকেন্দ্র এবং উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তি যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম তাদেরকে সতর্ক হিসেবে মাস্ক ব্যবহার করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
শীতজনিত রোগ: পহেলা নভেম্বর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত শীতজনিত রোগের মৌসুম ধরা হয় বলে জানিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। অধিদপ্তরের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালের ১ নভেম্বর থেকে ২০২৩ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি সারা দেশে শীতজনিত রোগগুলোর মধ্যে শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণে ৯৭ হাজার ৩১৫ এবং সর্দি-কাশি ও জ্বরে ২ লাখ ১৭ হাজার ৫৩৪ জন আক্রান্ত হয়। ওই মৌসুমে শীতজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্তের সংখ্যা ৪ লাখ ছাড়িয়ে যায়।
ভোরের আকাশ/রন