আমি ক্রিকেট বোদ্ধা নই, বড়জোর বলা যায় একজন অনুরাগী, মশগুল ভক্ত। ক্রিকেট নিয়ে কথা বলি চিন বা অর্বাচীনের মতো। বাংলাদেশে নিয়ম হয়ে গেছে, শুধু বিশেষজ্ঞরাই ক্রিকেট নিয়ে লিখবেন খেলার পাতায়, মতামত জানাবেন কলাম লিখে। সাধারণ মানুষ যারা ক্রিকেট নিয়ে এত সময় ব্যয় করেন, তাদেরও নিশ্চয় অধিকার আছে ক্রিকেট নিয়ে বলবার।
বাংলাদেশের ক্রিকেটের বয়স কম হয়নি। কতটুকু এগিয়েছে এবং কোথায় তার অবস্থান তা বোধহয় একবাক্যে বলা ঠিক হবে না। কারণ বাংলাদেশের ক্রিকেট এখনো নিজেই নিজের স্থিতি খুঁজে বেড়াচ্ছে। ভক্তরা হাল ছাড়ছেন না, এক খেলায় রিমোট ভেঙে, পরের খেলায় আবার নতুন রিমোট হাতে টিভির সামনে বসেন আশা নিয়ে। আমি সব ভালো ক্রিকেট দেখতে চেষ্টা করি, ভারত, পাকিস্তান, অস্ট্রেলিয়া এবং বাংলাদেশ তো বটেই। সব দলই হঠাৎ খুব খারাপ খেলে, বাংলাদেশ আবার হঠাৎ খুব ভালো খেলে। বাংলাদেশ হেরে গেলে আমি যখন চেঁচামেচি করে অস্থির হই, আমার স্ত্রী বিরক্ত হয়ে বলেন, তুমিতো জানো ওরা ভালো খেলে না, তা হলে দেখো কেন? আমি বলি, হঠাৎ যদি ভালো খেলে তা মিস করতে চাই না, তাই সব খেলা দেখতে হয়।
বৃত্তাবদ্ধ বাংলাদেশের ক্রিকেট: বাংলাদেশ ক্রিকেট নিয়ে ভাবতে গেলে আমার চোখের সামনে প্রথমেই রফিকুন নবীর (রনবী) সেই বিখ্যাত কার্টুনটা মনে পড়ে। সম্ভবত ১৯৮০-৮১ সালে, এম-সি-সি বা পাকিস্তান খেলতে আসছিল আনকোরা বাংলাদেশের সঙ্গে। ব্যাটারদের মনোবল তখন নিশ্চয় এখনকার চেয়ে ভালো ছিল না। রনবী বিচিত্রায় কার্টুন এঁকেছিলেন- একজন ব্যাটার আউট হওয়ার পর, বিসিবির দুজন লোক নতুন ব্যাটারকে বগলদাবা করে মাঠে নিয়ে যাচ্ছেন ব্যাটস হাতে, ব্যাটার যেতে চাচ্ছে না, ভয়ে হাত-পা ছুড়ছে।
আমাদের গত পঞ্চাশ বছরের ক্রিকেটের সময়কালকে এই কয় ভাগে ভাগ করা যায়, কখনো এক পা এগোচ্ছে, আবার দেড় পা পিছুচ্ছে, হয়তো আবার একটু এগিয়ে যাচ্ছে। এই আগানো-পেছানোর বৃত্ত চলছেই-
১. চারিদিকে শূন্য, ব্যাটাররা প্রায় রান ছাড়া ফিরছে, বোলারদের ঝুড়িতেও প্রায়ই শূন্য উইকেট।
২. ব্যাটারদের কিছু কিছু মাঝে-মধ্যে রান করছেন, কিন্তু বোলাররা একাধারে পিটুনি খাচ্ছেন।
৩. দুইপক্ষ মাঝে মাঝে কিছুটা সাফল্য পাচ্ছেন।
৪. ব্যাটাররা কিছু রান মাঝে-মাঝে করছেন, বোলাররা দুর্দান্ত।
৫. ব্যাটারদের ব্যর্থতা দিন দিন বাড়ছে, যা বোলারদের উৎসাহ ও উদ্যমকে পিছু টানছে।
৬. ক্রিকেটের এই পর্যায়গুলোকে সিরিজ, ফরমাট ও বছর-তারিখ দিয়ে বিশ্লেষণ করার ভার আমি ক্রিকেট বিশেষজ্ঞদের ওপর ছেড়ে দিচ্ছি।
ফুরিয়ে গেলেন কত প্রতিশ্রুতিশীল: মোহাম্মদ আশরাফুল ছিলেন দারুণ চৌকষ খেলোয়াড়। তাকে অনভিপ্রেতভাবে হারিয়ে আমাদের ক্রিকেটের বড় ক্ষতি হয়েছে। তারপর আছেন এনামুল হক, ইমরুল কায়েস, আকবর আলী, মাহমাদুল হাসান জয়, সৌম্য সরকার, নাসির হোসাইন, সাব্বির রহমান, মিঠুন, মুমিনুল হক এবং আরো কেউ কেউ- যারা দারুণ প্রতিশ্রুতি দিয়ে শুরু করেছিলেন, কিন্তু রাখতে পারলেন না সেই প্রতিশ্রুতি। তার কারণও খুব অজানা নয়। কারো কারো তারকা খ্যাতি, কারো বা মেজাজের ঝটকা, কেউ বা মনোনিবেশ করেছেন অন্যদিকে, হয়তো কেউ কিছুটা দুর্ভাগা- ভাগ্য সহায়তা করেনি। কারণ যাই হোক, তাদের চেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বেশি বাংলাদেশের ক্রিকেট। এদের কেউ কেউ এখনো ‘চেষ্টার লিস্টে’ থেকে মাঝে মাঝে সুযোগ পান, কিন্তু ঘুরে দাঁড়াতে পারছেন না। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে মুমিনুল হকের ১৮১ রানের প্রথম সেঞ্চুরি দেখে বাংলাদেশের অনেকেই তাকে ডন ব্র্যাডম্যানের দলে ভিড়িয়ে দিলেন। সেখানেই কি তার পতন?
খেয়াল করে দেখুন, এই লিস্টের সবাই ব্যাটার। আমি একটা মন্তব্যই শুধু করব, তারা আদর্শ উত্তর সূরির সঙ্গে খেলার সুযোগ পাননি, যাদেরকে দেখে তারা নিজেদেরকে গড়তে পারতেন। সাকিব আল হাসানের কথা না বলাই ভালো, তিনি নিজের গৌরবের ভারে ক্রিকেটের আদর্শ সবসময় ধরে রাখতে পারেননি। তামিম ইকবালের সুযোগ ছিল নুতুনদেরকে পথ দেখাবার। তিনিও বিভিন্ন বাহানা দেখায়ে নিজেকে গুটিয়ে নিলেন। ভারতের দিকে তাকালে দেখবেন, শচীন টেন্ডুলকার হতে কতজনে এগিয়ে এলেন তার সংস্পর্শ পেয়ে, বিরাট কোহলি কত ভারতীয় ব্যাটারদেরকে পথ দেখিয়েছেন- পান্থ, রাহুল, জয়সাল, গিল- এরা এখন তার প্রতিদ্বন্দ্বী।
মুশফিকুর রহিম ও মাহমুদউল্লাহ বাংলাদেশের ক্রিকেটকে অনেক দিয়েছেন। আশা করি তারা ফুরাবেন না, যখন সময় হয় তারা সম্মানের সঙ্গে অবসর নিবেন।
নির্ভীক খেলোয়াড়রা: মুস্তাফিজুর রহমান আমাদের ক্রিকেটের বিরল গৌরব। তার মেধার কথা নিয়ে শুধু বলছি না, তার বিনয় ও ক্রিকেটীয় আদব-কায়দা বাংলাদেশের অন্য ক্রিকেটারদের জন্য অনুকরণীয়। তার সমসাময়িক বা তার পরে যেসব বোলার এসেছেন- দ্রুতগতির বা স্পিনার, তারা সবাই মুস্তাফিজকে সম্মান করেছেন বা মুস্তাফিজ হতে চেয়েছেন। তারা এখনো ভালোভাবে ক্রিকেটকে ধরে রাখছেন। তাসকিন, হাসান মাহমুদ, শফিকুল, এবাদত, নাহিদ রানা, তাজুল তারা অনেকদিন খেলবেন। এককালে সবাই বোলারদেরকে দায়ী করতেন বাংলাদেশের ক্রিকেটের দৈন্যদশার জন্য। এখন আমাদের ফাস্ট বোলাররা ডেনিস লিলির গতিতে বল করছে। এখন আমরা গর্ব করে বলতে পারি, আমাদের এত এত ভালো বোলার যে সবাইকে খেলাতে পারছি না। এদেরকে ভালোভাবে লালন করতে হবে যেন নিরাশায় ডুবে না যায়।
ব্যাটে-বলে সমান পারদর্শী মেহেদী হাসান মিরাজের কথা আলাদাভাবে না বললেই নয়। তিনিই এখন বাংলাদেশের নির্ভরযোগ্য অল রাউন্ডার, বিপদে বাংলাদেশকে না জিতাতে পারলেও, সম্মান রাখতে চেষ্টা করে। ওর খেলা দেখলে আমার মনে হয়, ও নিজের জন্য খেলে না, ও খেলে দলের ও দেশের জন্য। আমাদের অনেক খেলোয়াড় খেলতে গিয়ে গ্লোরি খোঁজেন, দলের প্রয়োজনটা অগ্রাহ্য করে।
মিরাজ মুস্তাফিজের ভালো বন্ধু। মুস্তাফিজ যখন খ্যাতির তুঙ্গে, আইপিএল-এ ফিজ নাম নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল, তখনকার বোলার মিরাজের যাচ্ছিল দুঃসময়, হারিয়ে যাচ্ছিল বোলিংয়ের ধার। নিজের অধ্যবসা, সংকল্প ও অব্যাহত চেষ্টায় সে ক্রিকেটে ছড়ালো নতুন দ্যুতি- ফিরে এল একজন দুর্দান্ত অল রাউন্ডার হয়ে।
যখন ক্যাপ্টেনসি নিয়ে বাংলাদেশের সংকট ও বিভ্রাট তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছিল, তখন এগিয়ে এলেন নাজমুল হাসান শান্ত। শান্ত বাংলাদেশ ক্রিকেটের ইদানীংকালের বড় পাওনা। তিনি নির্ভীকভাবে প্রতিটা খেলায় নেতৃত্ব দিয়েছে কোনো রকম বিতর্কে না জড়িয়ে। দলের যারা সিনিয়র খেলোয়াড় তাদেরকে সন্মান দিয়েছে, সতীর্থদেরকে নিয়ে চেষ্টা করেছে দলকে এগিয়ে নিতে। কিন্তু অনেক ব্যাপারে ভাগ্য তাকে সহায়তা করেনি, ব্যাটিংয়ে বাংলাদেশ দল ইদানীং বারবার হোঁচট খাচ্ছে। ক্রিকেট ভক্তদের কেউই বলতে পারেনি যে এটা শান্তর নেতৃত্বের জন্য, তবুও দলের এই নিম্নমানে তিনি সম্ভবত খুশি নন এবং যদিও ব্যাটিংয়ে তিনি নিজে বেশ ভালোই করছেন, হয়তো তা-ও তার মনমতো নয়। সম্প্রতি শান্ত বলেছেন, তিনি সবাইকে নিয়েই খুশি, খুশি নন শুধু নিজেকে নিয়ে। আমাদের বড় বড় ক্রিকেটারেরা কেউই এভাবে কখনও বলেননি।
তবে ইদানীং তাকে বেশ অশান্ত দেখা যাচ্ছে। শান্ত বলেছেন, তিনি সব ফরম্যাটে নেতৃত্ব ছেড়ে দিবেন। ব্যাপারটা জরুরিভাবে সুরাহা করা দরকার। তাকে অশান্ত রেখে বাংলাদেশ ক্রিকেট এগুতে পারবে না।
ক্রিকেটারদের রাজনীতি: যখন মাশরাফি বিপিএলে খেলেন ও সাকিব নিয়মিত ক্রিকেট খেলোয়াড়, তাদের প্রয়োজন ছিল না রাজনীতিতে নামার। বাংলাদেশ ক্রিকেট তাদেরকে নাম, যশ, বিত্ত সবই দিয়েছে। ভারতীয় ক্রিকেটেও দেখিনি কাউকে রাজনীতির মাঠে নামতে, এমনকি অবসরের পরেও সিধু বা আজহার উদ্দিন ছাড়া কাউকে দেখিনি রাজনীতিতে। রাজ্য ক্রিকেটে ছিলেন পশ্চিম বাংলার মনোজ তেওয়ারি, মমতাদির কথা ফেলতে পারেননি। মমতার কথায় পশ্চিম বাংলার অনেক শিল্পী রাজনীতিতে নেমে অনেক বিড়ম্বনায় পড়েছেন। আমাদের দেশেও এখন তাই দেখছি। রাজনীতির প্রাপ্তি সাময়িক, খেলা ও শিল্প থেকে প্রাপ্তি চিরন্তন।
রাজনীতিবিদদের ক্রিকেট: আমাদের দুর্ভাগ্য, সবসময় রাজনীতির লোকেরাই বাংলাদেশ ক্রিকেটের নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। মোস্তফা কামাল ছিলেন পাপনের আগে ক্রিকেট বোর্ডের প্রেসিডেন্ট। তিনি একজন চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট, ব্যস্ত থাকতেন দেশের চেয়েও নিজের হিসেব গোছাতে। সময় ছিল না তার ক্রিকেট নিয়ে সময় কাটাবার। অর্থমন্ত্রী থাকাকালেও তাকে এক বছর অফিসে যেতে দেখা যায়নি।
পাপনের সময় ক্রিকেটে খামখেলিপনা ছিল তুঙ্গে, নিজেদের লোক বসিয়ে চালানো হতো ক্রিকেট। পাপন একদিন খেলা দেখতে গিয়ে বললেন, মুশফিকুর রাহিম যে চার বা ছয় মারতে পারেন তা তো তিনি জানতেন না। ওই সময়টাতে মুশফিকুর রহিমের নামের পাশে ছিল ১৪টা সেঞ্চুরি। বর্তমান প্রেসিডেন্ট ফারুক আহমেদ একজন ক্রিকেটার। তিনি এসেই যেভাবে তাড়াহুড়ো করে হাথুরুসিংহেকে তাড়ালেন তা-ও ভালো উদহারণ নয়। তখন বাংলাদেশ টিম ছিল খেলার মাঠে, বিদেশের মাটিতে। আসলে বোধ হয় চেয়ারটারই দোষ! প্রেসিডেন্টের চেয়ারটা একটু ঘষে-মেজে পরিষ্কার করে আরেকটু নমনীয় করা যায় কিনা তা দেখা উচিত।
আমার কথা, আমাদেরও কথা: যারা এতক্ষণ ধরে এই লেখাটা পড়েছেন, মনে রাখবেন এই কথাগুলো কোনো বিশেষজ্ঞের নয়, তবে শুধু আমার কথাও নয়, আমাদের কথা। আমার অনুমান এটা বাংলাদেশের হাজারো মানুষের কথা। বাংলাদেশের মানুষ ক্রিকেটকে দারুণ ভালোবাসে। বাংলাদেশ হয়তো আরো অনেক খেলায় হারবে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ ক্রিকেটকে হারাতে চায় না। যারা বাংলাদেশের ক্রিকেটার তারা ক্রিকেটের ভদ্রতায় ও কঠিন অনুশীলনে ফিরে যাবেন, যারা ক্রিকেটের প্রশাসক তাদেরকে ক্রিকেটকে ধারণ করতে হবে এবং লালন করতে হবে। তাহলেই বাংলাদেশে ক্রিকেটের জয় হবে এবং বাংলাদেশ ক্রিকেট দল অনেক খেলায় জিতবে।
লেখক: রাজনীতিক বিশ্লেষক
ভোরের আকাশ/রন