ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে হামলা, জাতীয় পতাকার অবমাননা এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টির অপচেষ্টার প্রতিবাদে ভারতীয় হাইকমিশনে স্মারকলিপি দিয়েছে বিএনপির ৩ অঙ্গ-সংগঠন। গতকাল রোববার দুপুর সোয়া ১টায় ভারতীয় হাইকমিশনে যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের ৬ জন প্রতিনিধি ওই স্মারকলিপি জমা দেন। এতে বলা হয়, সহকারী হাইকমিশনে হামলা কূটনৈতিক নিয়ম এবং আন্তর্জাতিক আইনের একটি গুরুতর লঙ্ঘন।
স্মারকলিপি প্রদান শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন বিএনপির তিন অঙ্গ-সংগঠনের শীর্ষ নেতারা। যুবদলের সভাপতি আব্দুল মোনায়েম মুন্না বলেন, আমরা ভারতীয় হাইকমিশনে স্মারকলিপি দিয়েছি। আমরা কোনো প্রকার অশান্তিতে বিশ্বাসী না। বাংলাদেশের মুসলমানরা শান্তিপ্রিয়। তারা অত্যন্ত ধৈর্যশীল। আমাদের কোনো প্রভু নেই। আমাদের বন্ধু আছে। আমরা আগ্রাসীতে বিশ্বাসী নই। যুবদলের সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম নয়ন বলেন, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যে কোনো ষড়যন্ত্র আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে রুখে দেবো। ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দিন নাছির বলেন, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর শান্তিরক্ষা মিশন বিষয়ে জ্ঞান না থাকলেও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়েছেন, যা বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি ও বরখেলাপ বলে আমরা মনে করি। বাংলাদেশের জনগণের কথা যুবদলের, ছাত্রদল, স্বেচ্ছাসেবক দলের কথা আমাদের শান্তিপূর্ণ অবস্থানের কথা আমরা জানিয়ে দিয়েছি। বাংলাদেশের মানুষের প্রতিবাদ দিয়ে আমরা এই পদযাত্রা ও স্মারকলিপি প্রদান শেষ করেছি।
এর আগে বেলা সাড়ে ১১টায় নয়াপল্টন বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে ভারতীয় দূতাবাস অভিমুখে পদযাত্রা শুরু করে বিএনপির তিন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন। বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী এই পদযাত্রা কর্মসূচির উদ্বোধন করেন। পরে পদযাত্রাটি রামপুরা ব্রিজের কাছে পৌঁছালে পুলিশ সেখানে ব্যারিকেড দেয়। পরে বিএনপির তিন সংগঠনের ছয় শীর্ষ নেতা ভারতীয় দূতাবাসে গিয়ে স্মারকলিপি প্রদান করেন।
ভারতের শাসকগোষ্ঠীকে ‘বিদ্বেষ পরায়ণ ও বাংলাদেশ বিরোধী’ বর্ণনা করে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন আশপাশের কোনো দেশই তাদের সঙ্গে ‘বন্ধুত্ব’ করতে পারে না। তিনি বলেন, তারা বাংলাদেশের মানুষকে পছন্দ করে না। ভুটান তাদের (ভারত) সাথে নেই, নেপাল নেই, পাকিস্তান তাদের সাথে নেই, শ্রীলঙ্কা নেই, ছোট্ট একটি দ্বীপ রাষ্ট্র মালদ্বীপও তাদের সাথে নেই। কেউ তাদের সাথে বন্ধুত্ব করতে পারে না।
প্রতিবেশী দেশটির সমালোচনা করে রিজভী বলেন, তারা (ভারত) মুখে যাই বলুক, ধর্ম নিরপেক্ষ বলুক আর সেকুল্যার বলুক, তাদের মনের ভেতরে কট্টর হিন্দুত্ববাদী হিংসা ছাড়া কিছু নেই। চট্টগ্রামে আইনজীবী হত্যার ঘটনা নিয়ে তিনি বলেন, আমি ভারতের শাসকগোষ্ঠীকে বলি, আপনারা বাংলাদেশ নিয়ে বলছেন যে এখানে সংখ্যালঘু নির্যাতন চলে। তো সংখ্যালঘু নির্যাতনের ফলাফল কী আমি তো দেখলাম এখানে ইসকন দ্বারা একজন আইনজীবী মারা গেলেন, তাকে কুপিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে মারা হলো। কই এই ব্যাপারে একটা কথাও বললেন না, একটা আওয়াজ পর্যন্ত তুললেন না। ভারতের ত্রিপুরার রাজ্যের রাজধানী আগরতলায় বাংলাদেশ সহকারী হাই কমিশনে হামলার পর সেখানে ভিসা ও কনস্যুলার সেবা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এ বিষয়ে রিজভী বলেন, আপনারা তো বাংলাদেশের মানুষের উপকার করেছেন... বাংলাদেশের মানুষ সেখানে গেলে ডলার খরচ হতো, বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার পাচারও হতো, আর আমাদের ডলারগুলো এখন সেখানে (ভারতে) যাবে না।
যেসমস্ত খাদ্যপণ্য আমদানি করা হতো চাল, পেঁয়াজ, আদা, এখন আমাদের মানুষ আরো শ্রম দিয়ে এসব পণ্য আরো বেশি করে উৎপাদন করবে।
রিজভীর কথায়, ভারত ‘বাংলাদেশবিরোধী’ হয়েও কেন এই দেশের ইলিশ পেতে ‘কাতর হয়ে থাকে’? আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে হামলা, জাতীয় পতাকা অবমননার প্রতিবাদে ঢাকার ভারতীয় হাইকমিশন অভিমুখে পদযাত্রাকে ‘দ্রোহের আগুন’ বলে বর্ণনা করেছেন রিজভী। তিনি বলেন, ভারতের ঔদ্ধত্য এমন পর্যায় গেছে তারা চট্টগ্রামকে ভারতের অংশ বলে দাবি করবে বলেছে।
যুবদলের সভাপতি আবদুল মোনায়েম মুন্নার সভাপতিত্বে ও ছাত্র দলের সাধারণ নাছির উদ্দীন নাছিরের সঞ্চালনায় সংক্ষিপ্ত সমাবেশে স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি এস এম জিলানি, সাধারণ সম্পাদক রাজীব আহসান, যুবদলের সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম নয়ন, ছাত্রদলের সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব বক্তব্য রাখেন।
সমাবেশে যুবদলের সভাপতি এম মোনায়েম মুন্না বলেন, আমাদের এই কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ। আমাদের দেশের বিরুদ্ধে ভারতের উগ্রবাদী শাসকগোষ্ঠী যে আগ্রাসী কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনাকে নিয়ে, আমরা তার প্রতিবাদ জানাতেই এই কর্মসূচি নিয়েছি। আমরা স্পষ্টভাবে বলে দিতে চাই, এসব করে কোনো লাভ হবে না। এদেশের মানুষ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করে এই দেশ স্বাধীন করেছে। এতে রক্ষার জন্য আমরাও সর্বাত্মকভাবে প্রস্তুত। পদযাত্রায় তিন সংগঠনের শীর্ষ নেতারা ছাড়াও বিভিন্ন স্তরের কেন্দ্রীয় নেতারাও অংশ নেন।
এই কর্মসূচিতে যোগ দিতে সকাল থেকে নয়াপল্টনের মিছিল নিয়ে জড়ো হন নেতাকর্মীরা। কাকরাইলের নাইটেঙ্গেল রেস্তোরাঁ মোড় থেকে ফকিরেরপুল মোড় পর্যন্ত জনস্রোত তৈরি হয়। নেতাকর্মীরা ‘দিল্লি না ঢাকা, ঢাকা, ঢাকা’, ‘রুশ-ভারতের দালালেরা হুঁশিয়ার সাবধান’, ‘স্বাধীনতা এনেছি, স্বাধীনতা আনব’, ‘রক্তে কেনা স্বাধীনতা, ভারতের আধিপত্য মানি না, মানব না’, ‘প্রতিবেশী বন্ধু চাই, প্রতিবেশী প্রভু নয়’, ‘ভুটান নয়, সিকিম নয়, এদেশ বাংলাদেশ বাংলাদেশ’ ইত্যাদি স্লোগান দেন।
স্মারকলিপিতে যা আছ : আমরা, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন জাতীয়তাবাদী যুবদল, জাতীয়তাবাদী স্বোচ্ছাসেবক দল ও জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের পক্ষ থেকে এই মর্মে গভীর উদ্বেগ ও বিস্ময় প্রকাশ করছি যে, দুনিয়া কাঁপানো ছাত্র-জনতার অভাবনীয় তুমুল আন্দোলনে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা আপনার দেশে পালিয়ে যাওয়ার পর আপনারা তাকে আশ্রয় দিয়েছেন। অতঃপর আপনার দেশের অতি উগ্রবাদী নেতারা এবং বিশেষ করে কতিপয় সংবাদ মাধ্যম ও মিডিয়া বাংলাদেশের এই গণশত্রু হাসিনা ওয়াজেদকে পুনরায় পুনর্বাসন এবং বাংলাদেশের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ অস্থিতিশীল করবার নিমিত্তে একের পর এক অজ্ঞ-অর্বাচীনের ন্যায় কাজ করে যাচ্ছে। যাতে স্পষ্টত প্রতীয়মান হয়, আমাদের বন্ধু রাষ্ট্র ভারতের বন্ধুত্ব ছিল হাসিনার সাথে, বাংলাদেশের জনগণের সাথে নয়। হাসিনা এখন বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার বিরুদ্ধে হুমকি হয়ে উঠেছে। একদিকে তিনি বাংলাদেশের ভিন্ন দলমতের মানুষদের ঘরবাড়ি সম্পত্তি জ্বালিয়ে দেওয়ার হুকুম দিচ্ছেন। অপরদিকে, যারা তার বিরুদ্ধে মামলা করেছে তাদেরকে হত্যা করার হুমকি দিচ্ছেন। ভারতের নিরাপদে আশ্রয়ে থেকে বাংলাদেশের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করার এই অপচেষ্টা বাংলাদেশের জনগণ ইতিবাচকভাবে নিচ্ছে না।
এক্সিলেন্সি : আপনি সম্যক অবগত আছেন যে, গত ২ ডিসেম্বর ২০২৪-এ আগরতলায় বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশনে ন্যক্কারজনক হামলা চালানো হয়েছে। নৈতিক পদস্খলনের কারণে ইসকন থেকে বহিষ্কৃত সাবেক ইসকন নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে উগ্র হিন্দুত্ববাদী হাজার হাজার মানুষ যখন রাষ্ট্রীয় মদদ ও প্রশ্রয়ে বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশনে হামলা করছিল তখন নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে আপনার দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
প্রাপ্ত বিবরণগুলো চূড়ান্তভাবে প্রমাণ করে যে, পূর্বপরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশনের প্রধান ফটক ভেঙে বিক্ষোভকারীদের প্রাঙ্গণে আক্রমণ করার সম্মতি দেওয়া হয়েছিল। এই প্রক্রিয়ায়, স্থানীয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের উপস্থিতিতে তারা জাতীয় পতাকা ভাঙচুর করে, বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা অবমাননা করে এবং সহকারী হাইকমিশনের অভ্যন্তরে সম্পত্তিরও ক্ষতি করে। দুঃখজনকভাবে, প্রাঙ্গণ রক্ষার দায়িত্বে থাকা স্থানীয় পুলিশ সদস্যদের শুরু থেকেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সক্রিয় না থাকতে দেখা গেছে। এটি কূটনৈতিক নিয়ম এবং আন্তর্জাতিক আইনের একটি গুরুতর লঙ্ঘন। একই সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কের ভিয়েনা কনভেনশন, ১৯৬১ এর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এহেন ন্যক্কারজনক বিস্ময়কর ঘটনাসমূহের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলেও আপনার সরকারের নীরবতায় বাংলাদেশের জনগণ হতাশ। আমরা পরস্পরের স্বাধীনতা ও স্বার্বভৌমত্বের প্রতি গভীরভাবে শ্রদ্ধাশীল। আমাদের দুই দেশের সম্পর্কের ভিত্তি হবে সমতা, পরস্পরের প্রতি আস্থা, বিশ্বাস এবং সম্মান প্রদর্শনের ওপর।
‘স্বার্বভৌম কোনো রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘনের সামিল। ভারতের সাম্প্রতিক ঘটনা প্রবাহ বাংলাদেশের জনগণের প্রতি অবজ্ঞা স্বরূপ বলে আমরা চাই ভারত সরকার ভারতীয় মিডিয়া আউটলেটগুলোকে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে এবং বস্তুনিষ্ঠ সংবাদের মাধ্যমে ভারতীয় সংবিধানের ৫৫ অনুচ্ছেদে বর্ণিত আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার আদর্শ প্রচার করতে পরামর্শ দেবে। আমরা আশা করি, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার, অপতথ্য বন্ধ করতে ভারতীয় সরকার কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য দেশগুলোর মধ্যে একটি স্থিতিশীল, পারস্পরিক শ্রদ্ধাপূর্ণ অংশীদারত্ব অপরিহার্য। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল জাতিসংঘের সনদের নীতির উপর ভিত্তি করে সকল সদস্যের সার্বভৌম সমতার ভিত্তিতে আমাদের দুই দেশের মধ্যে শক্তিশালী ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
আমাদের পক্ষ থেকে এই স্মারকলিপির মাধ্যমে আপনাকে অবগত করছি এবং অনুরোধ জানাচ্ছি যে, জাতীয়তাবাদী যুবদল, জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দল ও জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের অবস্থান ও মতামত ভারতীয় সরকারের নিকট পৌঁছে দেওয়ার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
ভোরের আকাশ/রন