logo
আপডেট : ১১ ডিসেম্বর, ২০২৪ ১০:৫৭
কিছুতেই নামছে না উত্তেজনার পারদ
নিখিল মানখিন

কিছুতেই নামছে না উত্তেজনার পারদ

সুসম্পর্কের বার্তার মধ্য দিয়ে পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠকের পরও বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার উত্তেজনার পারদ নামছে না। গতকাল মঙ্গলবারও দুই দেশেই সম্পর্ক অবনতির বেশ কিছু বিদ্বেষমূলক ঘটনা ঘটেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, বিষয়টি এখন দুই দেশের সরকারের সীমানা ছাড়িয়ে রাজনৈতিক দল ও জনগণের মাঝে ছড়িয়ে পড়েছে। কূটনৈতিক স্বার্থের পাশাপাশি অব্যাহত পরস্পরবিরোধী হুমকিমূলক বক্তব্য ও কর্মসূচি সম্পর্ক উন্নয়নে বড় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে।

গতকাল দিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনের অভিমুখে লংমার্চ করেছে হিন্দুত্ববাদী সংগঠন আরএসএস। এদিকে বাংলাদেশে ভারতীয় বিছানার চাদর পুড়িয়েছে বিএনপি। একই সঙ্গে তারা আখাউড়া অভিমুখে লংমার্চ করেছেন। ৭৯ নাবিকসহ দুটি বাংলাদেশি নৌযান ধরে নিয়ে গেছে ভারতীয় বাহিনী। বাংলাদেশের ভোমরা স্থলবন্দরে বন্ধ রয়েছে আমদানি-রপ্তানি।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, গত ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের মুখে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর থেকেই ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্কে ফাটল ধরতে শুরু করে। শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য ভারতের প্রতি অসন্তুষ্ট ও ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে বাংলাদেশের আমজনতা, বিশেষ করে গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছাত্র-জনতা। বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র ও চট্টগ্রামের হাটহাজারীর পুণ্ডরীক ধামের সাবেক অধ্যক্ষ চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেপ্তার এবং জামিন না পাওয়ার ঘটনায় ভারত ও বাংলাদেশের সনাতনী সম্প্রদায়ের লোকজন বিক্ষুব্ধ হয়ে পড়েন। দ্রুত অবনতি ঘটে চিন্ময় দাসকেন্দ্রিক ঘটনাপ্রবাহের। বাংলাদেশের আদালতপাড়ায় হত্যাকাণ্ডের শিকার হন একজন আইনজীবী। অত্যাচার-নির্যাতনের অভিযোগ তুলে সনাতনী সম্প্রদায়ের পক্ষে শক্ত অবস্থান নেয় ভারত সরকার, রাজনৈতিক দল ও জনগণ। ভারতের এমন আচরণে বাংলাদেশ সরকার, রাজনৈতিক দল ও জনগণও তীব্র প্রতিবাদ ও অসন্তোষ প্রকাশ করে চলেছে। এভাবে প্রতিদিনই দুই দেশের সরকার ও জনগণের মধ্যে চলছে পাল্টাপাল্টি বিবৃতি ও বক্তব্য।

এমন পরিস্থিতির ধারাবাহিকতায় গতকাল মঙ্গলবারও দুই দেশেই পরস্পরবিরোধী নানা ঘটনা ঘটেছে। হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) সমর্থনে সিভিল সোসাইটি অব দিল্লির ব্যানারে ভারতের দিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনের অভিমুখে বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে। বাংলাদেশি ৭৯ নাবিকসহ দুই নৌযান ভারতে ধরে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ উঠেছে। স্ত্রীর শাড়ির পর এবার ভারতীয় বিছানার চাদর পুড়িয়ে দেশটির পণ্য বর্জনের ডাক দিয়েছেন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। ভারতের ঘোজাডাঙ্গা স্থলবন্দরের প্রধান সড়ক অবরোধ করায় সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দরে আমদানি-রপ্তানি এবং ইমিগ্রেশনের কার্যক্রম বন্ধ থাকে। বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য বন্ধের দাবিতে এ অবরোধের ডাক দেয় পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার বিরোধীদলীয় নেতা ও বিজেপির বিধায়ক শুভেন্দু অধিকারী। আর অব্যাহত থাকে হুমকিমূলক বক্তব্য ও কর্মসূচি।

পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠকের দিন গত সোমবারও দুই দেশেই বিরাজ করে উত্তেজনা। এদিন আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে হামলা, জাতীয় পতাকা অবমাননার প্রতিবাদে ঢাকার ভারতীয় হাইকমিশনের অভিমুখে পদযাত্রা করেছে বিএনপি সমর্থক তিন সংগঠন যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদল। পথে পুলিশ দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়ে তারা হাইকমিশনের কাছে একটি স্মারকলিপি দেয়।

অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গ দখলের মন্তব্য নিয়ে রিজভীকে কটাক্ষ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এদিকে, আজ বুধবার ভারতের আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে হামলা এবং দেশটির সংবাদমাধ্যমে বাংলাদেশ নিয়ে মিথ্যা তথ্য প্রচারের প্রতিবাদে ঢাকা থেকে আখাউড়া সীমান্ত পর্যন্ত লংমার্চ করার ঘোষণা দিয়েছে বিএনপির অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদল। সকাল ৮টায় নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে কর্মসূচি শুরু করবেন তারা।

দিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশন অভিমুখে আরএসএস সমর্থিত মিছিল: হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) সমর্থনে সিভিল সোসাইটি অব দিল্লির ব্যানারে ভারতের দিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনের অভিমুখে বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার বেলা ১২টার পর দিল্লির চাণক্যপুরী থানার তিন মূর্তি চক থেকে মিছিলটি শুরু হয়।

বিবিসি বাংলার সাংবাদিক শুভজ্যোতি ঘোষ জানিয়েছেন, মিছিলে তিন থেকে চার হাজার মানুষ অংশগ্রহণ করেছে। সেখানে বিভিন্ন বয়সী পুরুষদের পাশাপাশি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ নারীও যোগ দিয়েছেন। তবে তাদেরকে শেষ পর্যন্ত দূতাবাস অবধি যেতে দেওয়া হয়নি।

পশ্চিমবঙ্গ দখলের মন্তব্য নিয়ে রিজভীকে মমতার কটাক্ষ: কেবল কলকাতা নয়, পশ্চিমবঙ্গ-বিহার-ওড়িশা দখলের ডাক দিয়েছেন বাংলাদেশের বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী। তা নিয়ে শোরগোল। পশ্চিমবঙ্গে সেই হুঁশিয়ারির আঁচ পড়লো বিধানসভাতেও। বিএনপি নেতাকে চরম কটাক্ষ করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রুহুল কবীর রিজভীর এক সাম্প্রতিক মন্তব্য প্রসঙ্গে মমতা বলেন, “আপনারা পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ও ওড়িশা দখল করবেন? আর আমরা ললিপপ খাবো? এই ভাবনা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলুন। আপনার সেই ক্ষমতা নেই। আমরা যথেষ্ট সক্রিয়, কিন্তু ধৈর্যের পরীক্ষা দিই। অতিরিক্ত কথা বলে প্ররোচনা সৃষ্টি করবেন না।”

এবার বিছানার চাদর পুড়িয়ে ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক রিজভীর: রাজশাহীতে এবার ভারতীয় বিছানার চাদর পুড়িয়ে দেশটির পণ্য বর্জনের ডাক দিয়েছেন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। গতকাল মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে রাজশাহী নগরের ভুবন মোহন পার্কে এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত হয়ে তিনি বিছানার চাদর পোড়ান। এর আগে গত বৃহস্পতিবার বিএনপির এই নেতা স্ত্রীর শাড়ি পুড়িয়ে দেন। তারও আগে নিজের গায়ের শাল পুড়িয়ে আলোচনায় আসেন তিনি। রুহুল কবির রিজভী বলেন, “ভারত আমাদের মনে করে গিনিপিগ, মনে করে তাদের অধীনস্থ দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। আমরা ৩০ লাখ জীবনের বিনিময়ে, এত নারীর সম্ভ্রমহানির মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা পেয়েছি। কিন্তু তাদের কথা শুনে মনে হয়, বাংলাদেশের মানুষ, স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব তাদের কাছে বিবেচ্য নয়।”

ভারতের সঙ্গে আগের মতো অসমতার সম্পর্ক নয়: ভারতের সঙ্গে আগের মতো আর অসমতার সম্পর্ক রাখা হবে না বলে জানিয়েছেন জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক সারজিস আলম। গতকাল ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নিপীড়িতদের গণজমায়েতে অংশ নিয়ে তিনি এ তথ্য জানান।

সারজিস আলম বলেন, “জনগণের সঙ্গে না থাকলে হাসিনার মতো অবস্থা হবে। ভারতের সঙ্গে এখন আগের মতো আর অসমতার সম্পর্ক নয়। কোনো ধর্ম বা জাতির নামে কেউ উগ্রবাদী কিছু করার চেষ্টা করলে সেটি আমরা সফল হতে দেব না। সবাই মিলে রুখে দেব। আমরা কাউকে আবার ফ্যাসিবাদ কায়েম করার সুযোগ দেব না।”

৭৯ নাবিকসহ দুই নৌযান ভারতে ধরে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ: বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা থেকে ৭৯ নাবিকসহ দুটি নৌযান ভারতীয় কোস্ট গার্ড ধরে নিয়ে গেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। গত সোমবার দুপুরে খুলনার হিরণ পয়েন্ট এলাকার ভারতের জলসীমার কাছ থেকে এফভি মেঘনা-৫ ও এফভি লায়লা-২ নামে মাছ ধরার নৌযান দুটিকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় বলে মালিক এবং নৌপরিবহন অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে।

সিঅ্যান্ডএ অ্যাগ্রো লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক সুমন সেন গণমাধ্যমকে জানান, জাহাজ দুটি খুলনা বেল্টের হিরণ পয়েন্ট এলাকায় গভীর সমুদ্রে মাছ ধরছিল। গত সোমবার দুপুরের দিকে ভারতের কোস্ট গার্ড নাবিকসহ আটক করে নিয়ে গেছে বলে জানতে পারি। এ সংবাদ পাওয়ার পর কোস্ট গার্ড, প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোতে যোগাযোগ করেছেন বলেও জানান তিনি।

নৌ-পরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কমোডোর মাকসুদ আলম জানান, তিনি বিষয়টি জেনেছেন। খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। আমরা এ বিষয়ে খোঁজ নিচ্ছি।

ভারত সীমান্তে অবরোধ, ভোমরা বন্দরে আমদানি-রপ্তানি বন্ধ: ভারতের ঘোজাডাঙ্গা স্থলবন্দরের প্রধান সড়ক অবরোধ করায় গতকাল মঙ্গলবার সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দরে আমদানি-রপ্তানি বন্ধ থাকে। এ ছাড়া বন্ধ থাকে ইমিগ্রেশনের কার্যক্রম। এতে পণ্য পরিবহনে স্থবিরতাসহ যাত্রী পারাপারও বন্ধ হয়ে যায়।

বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য বন্ধের দাবিতে এ অবরোধের ডাক দেয় পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার বিরোধীদলীয় নেতা ও বিজেপির বিধায়ক শুভেন্দু অধিকারী। ভোমরা স্থলবন্দরের ব্যবসায়ী দীপঙ্কর ঘোষ জানান, বাংলাদেশের সঙ্গে আমদানি-রপ্তানি বন্ধের দাবিতে মঙ্গলবার ঘোজাডাঙ্গা অবরোধের ডাক দিয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার বিরোধীদলীয় নেতা। এর অংশ হিসেবে ঘোজাডাঙ্গায় প্রধান সড়কে মঞ্চ তৈরি করে সমাবেশ হয়। এতে ভোমরা স্থলবন্দরের আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়।

ভারতের সঙ্গে কথা হবে চোখে চোখ রেখে: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেছেন, “ভারতের সাথে আর কোনো নতজানু সম্পর্ক নয়। এখন থেকে কথা হবে চোখে চোখ রেখে। ভারত চেয়েছে সংখ্যালঘুদের উসকে দিয়ে দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করতে। কিন্তু আমরা ভারতের ফাঁদে পা দেইনি। গতকাল আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গুম হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে গঠন করা সংগঠন ‘মায়ের ডাক’-এর আয়োজনে গণজমায়েতে যোগ দিয়ে তিনি এ কথা বলেন।

 

ভোরের আকাশ/রন