ময়মনসিংহ-১ আসনের (হালুয়াঘাট-ধোবাউড়া) সংসদ সদস্য হওয়ার পরও একই সময়ে হালুয়াঘাট উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং জেলা আওয়ামী লীগের পদে ছিলেন সাবেক এমপি জুয়েল আরেং। শুধু তিনি নন, আওয়ামী লীগের দুই-তৃতীয়াংশ এমপি ও মন্ত্রী নিজেদের জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের সর্বোচ্চ দলীয় পদসমূহ দখলে রাখতেন। তাদের ইশারায় চলত সবকিছু। প্রকট রূপ ধারণ করে স্বেচ্ছাচারিতা। একাকার হয়ে গিয়েছিল দল ও সরকার। রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল বিকল্প যোগ্য নেতৃত্ব তৈরি হওয়ার সকল পথ। এমন নেতাদের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন তৃণমূলের বঞ্চিত নেতাকর্মীরা। তাই ৫ আগস্টের পর নানাভাবে আহ্বান করেও দলীয় তৃণমূল নেতাকর্মীদের সাড়া পাচ্ছেন না আওয়ামী লীগের পলাতক কেন্দ্রীয় নেতারা।
ময়মনসিংহ-১ আসনের ধোবাউড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক প্রিয়তোষ বিশ্বাস বাবুল ভোরের আকাশকে বলেন, সংসদ সদস্য হওয়ার পরও দলীয় পদ-পদবি দখলে নিয়েছিলেন সাবেক এমপি জুয়েল আরেং। আসনটির দুটি উপজেলার মধ্যে একটিতে তিনি নিজে সভাপতি ছিলেন। আর ধোবাউড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি পদে বসিয়েছিলেন নিজের হাতে গড়া বিএনপি পরিবারের কর্তা ব্যক্তি মুক্তিযোদ্ধা মোজাম্মেল হোসেনকে। জুয়েল আরেং এর নির্দেশনার বাইরে তিনি কারো কথা শুনতেন না। তৃণমূল নেতাকর্মীরা জুয়েল আরেং এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। ফলে গত ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনে নৌকা প্রতীক পেয়েও জুয়েল আরেং এর শোচনীয় পরাজয় ঘটে।
সংসদ সদস্য হওয়ার পরও ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন সাবেক এমপি ফাহমী গোলন্দাজ বাবেল। ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগেও ভাগিয়ে নেন দলীয় পদ। এলাকাবাসীর অভিযোগ, সাবেক এমপি ফাহমীর দুঃশাসন থেকে রক্ষা পাননি বিরোধী দলসহ নিজ দলের কর্মীরাও। সন্ত্রাসী স্টাইলে গোলন্দাজ বাহিনীর হাতে খুন হন অসংখ্য নেতাকর্মী। মতের অমিল হলেই কেটে দিয়েছেন হাত-পা, চালিয়েছেন নির্মম নির্যাতন। ভয়ংকর এই গোলন্দাজ বাহিনীর হাতে গুরুতর আহত ও পঙ্গু হয়েছেন নিজ দলের অসংখ্য নেতা কর্মী। কয়েক হাজার নেতাকর্মী ও সমর্থকের বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। দখল করে নিয়েছেন এবং জোরপূর্বক লিখে নিয়েছেন অসংখ্য মানুষের জমি, বাড়ি-ঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর।
একই অবস্থা ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের। দুই উপজেলা নিয়ে গঠিত এই নির্বাচনী এলাকায় নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টি হতে দেননি সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ। প্রতিমন্ত্রী ও এমপি হওয়ার সময়ই তিনি ফুলপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক ও জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টার পদ ভাগিয়ে নেন। সর্বশেষ ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে সংসদ সদস্য হওয়ার পরও তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটির পদ ধরে রাখেন। এলাকাবাসী ও দলীয় তৃণমূল নেতাকর্মীদের অভিযোগ, শরীফ আহমেদ ছিলেন একজন স্বেচ্ছাচারী নেতা। ক্ষমতার সবকিছু তিনি নিজের হাতে রাখতেন। দলীয় নেতাকর্মীরা তাকে ভয়ে ভক্তি করতেন। মতবিরোধে যাওয়া দলীয় নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে তিনি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতেন।
নাঈমুজ্জামান ভুঁইয়া মুক্তা একই সময়ে পঞ্চগড়-১ আসনের এমপি এবং জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ছিলেন। খালিদ মাহমুদ চৌধুরী দিনাজপুর-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এবং আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক এবং শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল মৌলভীবাজার-২ আসনের সংসদ সদস্যের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করতেন। ময়মনসিংহ সদর আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মোহিত-উর রহমান(শান্ত) একই সময়ে মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। এভাবে আওয়ামী লীগের দুই তৃতীয়াংশ সংসদ সদস্য, এমপি-মন্ত্রী কেন্দ্রীয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে দলীয় পদ দখলে রেখে নিজেদের আলাদা রাজত্ব কায়েম করেন।
তৃণমূল নেতাকর্মীদের অভিযোগ : নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের অনেক তৃণমূল নেতাকর্মী ভোরের আকাশকে জানান, ক্ষমতায় থাকার সময়েই বহুধাবিভক্ত হয়ে পড়ে তৃণমূল আওয়ামী লীগ। ত্যাগী দলীয় কর্মীরা গত সাড়ে ১৫ বছর ধরে অবহেলিত হয়ে আসছে। তীব্র দলীয় কোন্দলে জর্জরিত দলটি। কোন্দলের ধরন খুবই অস্বাভাবিক ও স্থায়ী রূপ নিয়েছে। দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে বিভাগীয়, মহানগর, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের কাউন্সিল ও কমিটি গঠনের সময় থেকেই তীব্র হতে থাকে কোন্দলের মাত্রা। আর গত ৭ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনে এসে কোন্দল বড় দুটি গ্রুপে ভাগ হয়-দলীয় মনোনয়প্রাপ্ত প্রার্থী ও দলের স্বতন্ত্র প্রার্থী। উপজেলা নির্বাচনে এসে সেই দুটি গ্রুপ হয়ে গেছে বহুধাবিভক্ত। কেউ কাউকে মানছে নাÑ এমন পরিস্থিতি বিরাজ করছে। ঘটছে অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা। এমন পরিস্থিতি সামাল দিতে দলীয় নেতৃবৃন্দের উদ্দেশে একাধিকবার সতর্কবার্তা ছিলেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। কিন্তু ফলাফল শূন্য। সরকার পতনের পর নেতাকর্মীদের ছন্নছাড়া হওয়ার পেছনে তীব্র দলীয় কোন্দলও অন্যতম বড় কারণ। সর্বশেষ ৭ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের তৃণমূল সমস্যা নিরসন করতে গিয়ে দলীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা পদে পদে সম্মুখীন ছিলেন নানা প্রতিকূল পরিস্থিতির।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষক মহল মনে করছেন, ক্ষমতায় থাকার সময়েই উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে আওয়ামী লীগের চেইন অব কমান্ড দুর্বল হয়ে পড়েছিল। সরকার ও দল একাকার হওয়ায় বেড়ে যায় জটিলতা। কোন্দলের শিকড় অনেক গভীরে বিস্তার লাভ করে। আর এসব দ্বন্দ্বে অনেক কেন্দ্রীয় নেতা, স্থানীয় সংসদ সদস্য, জেলা-উপজেলার শীর্ষ নেতা ও মনোনয়নপ্রত্যাশীরা মদদ দিয়ের্ছিলেন বলে মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীরা অভিযোগ করেছেন।
আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতারা অভিযোগ করেন, আওয়ামী লীগের বেশির ভাগ সাংগঠনিক জেলার সম্মেলন ও কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হলেও গঠিত হয়নি পূর্ণাঙ্গ কমিটি। সিংহভাগ উপজেলা, পৌরসভা ও অন্যান্য ইউনিট কমিটিও মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে পড়েছিল দীর্ঘদিন ধরে। আর দীর্ঘদিন ধরে সম্মেলন না হওয়ায় প্রায় সব জায়গাতেই একচ্ছত্র ক্ষমতার বলয় তৈরি হয়েছে। বেড়েছে দ্বন্দ্ব-কোন্দল এবং মন্থর হয়ে পড়েছে সাংগঠনিক কার্যক্রম। ত্যাগী, দক্ষ ও স্বচ্ছ-পরিচ্ছন্ন ইমেজের নেতারা দলে জায়গা না পেয়ে হতাশ হয়ে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন। কেউ কেউ স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে পৃথক পৃথক দলীয় গ্রুপিংয়ে জড়িয়ে পড়েছিলেন।
অভিযোগ রয়েছে, অধিকাংশ এলাকায় আওয়ামী লীগের উপজেলা ও ইউনিয়ন কমিটি গঠনে একচ্ছত্র ক্ষমতা ব্যবহার করে আসছিলেন স্থানীয় সংসদ সদস্যরা। তাদের আশীর্বাদপুষ্ট লোকজন ছাড়া কমিটিতে স্থান পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে যোগ্যতার বিষয়টি বিচার-বিবেচনায় আনা হয়নি না। আওয়ামী লীগের বিভাগীয় টিম এবং জেলা নেতারাও অনেক সময় অসহায় হয়ে পড়েন। আর পদবঞ্চিত যোগ্য নেতারা তৈরি করেন পৃথক দলীয় বলয়। এটি শুধু আওয়ামী লীগ নয়, তার সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সব সংগঠনের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
নেতাদের ডাকে সাড়া দিচ্ছেন না কর্মীরা : গণ-অভ্যুত্থানের মুখে দেশত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে গেছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা। কেন্দ্রীয় থেকে উপজেলা পর্যায়ের অসংখ্য নেতাও চলে গেছেন আত্মগোপনে। কেন্দ্রীয় ও জেলা পর্যায়ের বেশ কিছু নেতা ইতোমধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে আত্মগোপনে থাকা কিছু সংখ্যক নেতা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন বিবৃতি ও নির্দেশনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন।
এবিষয়ে জানতে চাওয়া হলে দলটির অনেক তৃণমূল নেতাকর্মী ভোরের আকাশকে জানায়, প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে বড় বড় নেতারা স্বার্থপরের মত কাজ করেছেন। ক্ষমতায় থাকার সময়ও তারা বঞ্চিত ও ত্যাগী নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন করেননি। ৫ আগস্টের পরও ওই বঞ্চিত নেতাকর্মীরাই বিরোধীদের অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। বিদেশে বসে বড় বড় কথা বললে হবে না। নেতাদের প্রতি ক্ষুদ্ধ তৃণমূল নেতাকর্মীরা। ডাক দিলেই সাড়া দেয়ার মত মানসিক আর নেই বলে জানান আওয়ামী লীগের অনেক তৃণমূল নেতাকর্মী।
ভোরের আকাশ/রন