সিরিয়ার পলাতক প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ ও তার পরিবার সন্দেহাতীতভাবেই পৃথিবীর জঘন্য স্বৈরাচারী শাসকদের অন্তর্গত। আসাদের আমলে প্রায় ৪ লাখ মানুষকে হত্যা ও ১ কোটি ৪০ লাখ মানুষকে ভিটে থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। শুরুটা বাশার আল-আসাদের বাবা হাফিজ আল-আসাদ থেকে। এই ৮ ডিসেম্বর বাপ-ছেলে মিলে চুয়ান্ন বছর ধরে যে বন্দিদশা কায়েম করে রেখেছিলেন তা থেকে মুক্তি লাভ করেছে সিরিয়ার জনগণ। ওই আনন্দ বন্যার ঢলের মতো উপচে পড়ছে সিরিয়াজুড়ে। আসাদের নির্যাতন থেকে রক্ষা পেতে যে লাখ লাখ মানুষ বছরের পর বছর ধরে পালিয়ে গিয়ে লেবানন, মিসর, জর্ডান, তুরস্কসহ ইউরোপিয়ান দেশগুলোতে জীবনযাপন করছেন, তারা দলে দলে ফিরে আসছেন মাতৃভূমিতে।
হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) দলটির নেতৃত্বে অভিযানের মাত্র দশ-বারো দিনের মাথায় আসাদের পতন অনেককেই বিস্মিত করেছে। ফ্যাসিস্ট সরকারের এমন সহজ ও দ্রুত পতনে এমনকি বিদ্রোহীরাও আশ্চর্য- জেটিওতে এক সাক্ষাৎকারে মেহেদি হাসানকে সঠিকভাবেই কথাটি বলেছেন সিরিয়ান-আমেরিকান সাংবাদিক হাসান হাসান। এর মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে আসাদের রক্ষক রাশিয়া ও ইরানের নিজস্ব সংকট। ইউক্রেইনের সঙ্গে রাশিয়ার যুদ্ধে জড়িয়ে থাকায়, ইসরায়েলের সঙ্গে আক্রমণ-প্রতিআক্রমণে ইরানের শক্তি ক্ষয় হওয়ায় এবং ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর আক্রমণে লেবাননের হিজবুল্লাহ বাহিনীর দুর্বল হয়ে পড়ায় আসাদকে রক্ষায় এবার কেউ ছিল না পাশে। সবচেয়ে বড় দুর্বলতা ছিল আসাদের নিজ বাহিনীর নৈতিক ও আর্থিক শক্তি হারিয়ে ভেঙে পড়ার দশা।
আসলে আসাদের এই পালিয়ে যাওয়ার কথা ছিল ২০১১ সালেই। ওই বছর আরব বসন্তের হাওয়ায় জাগ্রত গণঅভ্যুত্থান বর্বর উপায়ে দমনের পর এবার তারই ফল পাওয়া গেল আশ্চর্যরকম দ্রুত সময়ে। প্রেক্ষাপটটি জানতে আমরা জ্যাকোবিন সাময়িকীতে প্রকাশিত (সিরিয়া : হোয়াট কামস আফটার দ্য ডেসপট?, ১১ ডিসেম্বর ২০২৪) আন্তর্জাতিক পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক-সাংবাদিক আনন্দ গোপালের সাক্ষাৎকারটিতে চোখ বুলাতে পারি। জ্যাকোবিনের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ভাস্কর সুঙ্করার প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘১৯৬০-এর দশকে বাথ পার্টি কর্তৃক ক্যু করে ক্ষমতা দখলের মাধ্যমে এই রাজত্বের শুরু। সেই সরকার ভূমি সংস্কারের উদ্যোগ নেয় ও কৃষকসমাজের মাঝে সমর্থনের ভিত্তি গড়ে। ১৯৭০ সালে ক্যু করে ক্ষমতা দখলের পর হাফিজ আল-আসাদ তার পূর্ববর্তীদের সম্পদ পুনর্বণ্টনের কর্মসূচিগুলো স্থগিত করেন এবং আলাওয়াইত সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা বাহিনী ও সুন্নি বুর্জোয়াদের ঐক্যের ভিত্তিতে এমন একটি রাষ্ট্র গঠন করেন।’
তবে তিনি দরিদ্র ও শ্রমজীবী মানুষকে রক্ষার জন্য কল্যাণকর মৌলিক সামাজিক সেবাসমূহ নিশ্চিত করেন। বিনিময়ে দাবি করেন তাদের রাজনৈতিক আত্মসমর্পণ ও তার প্রতি প্রশ্নাতীত সমর্থন। আনন্দ বলেছেন, ‘বাশার আল-আসাদ ২০০০ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর এই মডেলে ভাঙন ধরে। তিনি অনেকগুলো নয়া উদারনৈতিক সংস্কার চালু করেন, যে কারণে রাষ্ট্রের জনকল্যাণমূলক ব্যবস্থা ধসে পড়ে সমতুল কোনো রাজনৈতিক সংস্কারের অভাবে। ফলে জনগণের কাছে তার শাসনকে সমর্থনের জন্য আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না- না অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, না রাজনৈতিক অধিকার। এটাই ২০১১-এর গণঅভ্যুত্থানে পরিণতি পায় যা ছিল শ্রমজীবী ও মধ্যবিত্ত জনগণ মিলে সংগঠিত একটি শান্তিপূর্ণ আন্দোলন।’
নৃশংসতম উপায়ে সে অভ্যুত্থানকে দমন করেন আসাদ। ওই সাক্ষাৎকারে আনন্দ গোপাল আরও বলেছেন যে, পূর্বে আরও দুইবার আসাদ পড়তে পড়তে বেঁচে যান। ২০১৩ সালে বিদ্রোহীরা যখন দামেস্কের মুখে পৌঁছে যায়, চরম নৃশংসতার মাধ্যমে তাকে বাঁচায় লেবাননের হিজবুল্লাহ বাহিনী। আবার ২০১৫ সালে বিদ্রোহীরা যখন ইদলিব পর্যন্ত দখলে নেয়, রাশিয়ার বোমাবর্ষণ রক্ষা করে তাকে। এরপর থেকে অভ্যন্তরীণভাবে আসাদের ক্ষমতায় ক্রমাগত ধস নামতে থাকে। ছিল শুধু আসাদের পালিয়ে যাবার অপেক্ষা।
তবে আসাদের রাজত্বের সঙ্গে মিলিতভাবে সিরিয়া রাষ্ট্রও ইতোমধ্যে ভেঙে পড়ার পর্যায়ে। এই ভেঙে পড়ায় কেবল আসাদ পরিবার একা দায়ী নয়, দায়ী বহিঃশক্তিসমূহও। দীর্ঘকাল ধরে ভূরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক খেলায় দেশটি বিভিন্ন রাষ্ট্রশক্তির কাছে স্বার্থ উদ্ধারের ঘুঁটি। তুরস্ক, ইরান, লেবানন, রাশিয়া, ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন পার্শ্ববর্তী ও দূরবর্তী দেশ নানাভাবে খেলছে দেশটিকে নিয়ে, আবার খেলার শিকারও হচ্ছে। এসব কারণে সিরিয়া তার জনগণের দেশ হতে পারেনি। আসাদের পতন ও পলায়ন এবার জনগণের জন্য ওই সুযোগ করে দিয়েছে। স্বৈরশাসন থেকে মুক্ত মানুষ এখন ওই স্বপ্নই দেখছে- সিরিয়া হবে সিরিয়ার জনগণের। দেশ পরিচালনার নীতিমালা, ভালোমন্দ, সিদ্ধান্ত সব তারাই নির্ধারণ করবে। এখনকার বড় প্রশ্ন হচ্ছে, ওই সুযোগ তারা আদৌ পাবে কি? ফ্যাসিস্ট শাসন থেকে মুক্ত মানুষ কবে পাবে বৃহৎ মুক্তির স্বাদ?
বৃহৎ মুক্তির স্বাদ লাভও সহজ হবে না। বিজয়ী বিদ্রোহীরা নানারকম গোষ্ঠীতে বিভক্ত। এইচটিএস ও তুরস্ক সমর্থিত এসএনএ (সিরিয়ান ন্যাশনাল আর্মি), এদের কেউই গণতান্ত্রিক আদর্শের অনুসারী নয়। অন্যদিকে কুর্দি নেতৃত্বাধীন এসডিএফ (সিরিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ফোর্স) তুরস্ক-সমর্থিত বাহিনীর কাছ থেকে আক্রমণের শিকার হবে। খ্রিস্টানসহ অন্য সংখ্যালঘুরাও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবে।
এসএনএর বিরুদ্ধে হত্যা ও নির্যাতনসহ নানারকম অভিযোগ আছে। এইচটিএস তো আল কায়েদা থেকে উদ্ভূত একটি গোষ্ঠী আর যুক্তরাষ্ট্র ২০১৭ সালে এর প্রধান আবু মোহাম্মদ আল-জোলানির মাথার দাম ঠিক করেছিল ১ কোটি ডলার। কিন্তু লক্ষ্যণীয় যে, সিরিয়ার জনগণের এই বিজয়ের জন্য জো বাইডেন ও বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু উভয়েই কৃতিত্ব ও বাহবা নেওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। ভাবখানা এমন যে, তারাই এমন অসাধ্য সাধন করেছেন! মনে হচ্ছে তাদের কাছে এখন আর এইচটিএস বা জোলানি কিছুই সমস্যা না। সত্যটা মোটেও তা নয়।
সিরিয়ার বিজয়ের পরপরই ইসরায়েলি সৈন্যরা গোলান মালভূমি দখল করে নিয়েছে ও সিরিয়ার আরও ভেতরে ঢুকে বৃহত্তর ইসরায়েল গঠনের স্বপ্নে মাতোয়ারা হয়েছে। ইসরায়েলি বিমান থেকে বোমা ফেলে ধ্বংস করা হচ্ছে সিরিয়ার সকল অস্ত্রকারখানা ও সামরিক স্থাপনা। ফ্যাসিস্ট আসাদের পতনের পর থেকে মুক্ত সিরিয়ার ওপর ইসরায়েল চব্বিশ ঘণ্টায় চারশোর বেশি হামলা করেছে আর যুক্তরাষ্ট্র হামলা চালিয়েছে পঁচাত্তরটি। এই হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সিরীয় বিজয় উদযাপনের ভাষা। এভাবেই গুলি ও বোমা দিয়ে তারা সিরিয়ার মুক্ত জনগণের সঙ্গে তাদের একাত্মতা জানাচ্ছে। স্পষ্টতই উদ্দেশ্য হচ্ছে সিরিয়ার সকল সামরিক ক্ষমতা নস্যাৎ করে দিয়ে তার জনগণকে দুর্বল ও বশংবদ করা। কারণ, তাদের মূল আতঙ্ক মুক্ত সিরিয়ার মুক্ত জনগণকে নিয়ে। অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা গ্রহণকারী রাজনৈতিক শক্তিটি ফিলিস্তিন প্রশ্নে কোনদিকে যাবে তা নিয়ে তাদের ভয়। আর সেজন্য সিরিয়ায় রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিয়ে রয়েছে অনিশ্চয়তা। ফিলিস্তিনের পক্ষে সিরিয়ার জনগণের ও সরকারের নৈতিক ও আদর্শিক অবস্থান যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলকে উৎসাহিত করবে দেশটিতে স্থিতিশীলতা বাধাগ্রস্ত করতে এবং সবসময় অশান্তি, হানাহানি ও যুদ্ধাবস্থা তৈরি করে রাখতে। সিরিয়ার মুক্ত জনগণের মুক্তির স্বাদ অর্জনে তাই নামতে হবে নতুন লড়াইয়ে- ফ্যাসিস্ট আসাদের চেয়েও অনেক বড় শক্তির বিরুদ্ধে। আনন্দ গোপালের সাক্ষাৎকারের কথা দিয়েই শেষ করি, ‘অতএব সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ আছে। কিন্তু এটা মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে, আসাদের সিরিয়ায় রাজনীতি করা ও রাজনৈতিক হওয়া ছিল কার্যত অসম্ভব। ওই শাসনের পতনের ফলেই কেবল এখন সম্ভব হবে গণতন্ত্রের জন্য গণসংগ্রাম সত্যিকারভাবে শুরু করা।’
লেখক : সম্পাদক, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি
ভোরের আকাশ/রন