ব্রিটিশ মুসলিমদের পত্রিকা '5 Pillars'-এর অন্যতম সংগঠক ডিলি হোসেনের ইউটিউব চ্যানেল ‘Blood Brothers’-এ প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সেক্রেটারি শফিকুল আলম ১ নভেম্বর ২০২৪-এ দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেছিলেন, ‘গত ১৫ বছরে বিদেশি সাংবাদিকদের বাংলাদেশে ঢুকতে বাধা দেওয়া হতো’। এ বিষয়ে আমি ফেসবুকে পোস্ট দিয়েও জানতে চাই। গুগলেও খুঁজে এমন কোনো খবর পাইনি। সাধারণত কোনো সাংবাদিক এরকম বাধার সম্মুখীন হলে ব্লগে লেখেন। এ সম্পর্কিত কিছু পেলাম না। আমার সেই পোস্টে কয়েকজন জানিয়েছিলেন যে ব্রিটিশ সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী ডেভিড বার্গম্যানকে দেশছাড়া করা হয়েছে, আদালত ও অন্যান্য জায়গায় হেনস্তা করা হয়েছিল এবং তাকে অনেক বছর বাংলাদেশে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। এটা খুবই সত্য কথা এবং আমি জানতাম তার ঘটনা।
বাংলাদেশি দুই সংবাদপত্রের সম্পাদকের (শফিক রেহমান ও মাহমুদুর রহমান) বিরুদ্ধে মামলা করে তাদের দেশে ঢুকতে দেয়নি আওয়ামী লীগ সরকার। ২৫ এপ্রিল ২০২৪ বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেয় এবং সাংবাদিকরা এ নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদ জানান।
যাহোক, আমার জানতে চাওয়া ছিল বিদেশি সাংবাদিকদের বাংলাদেশে ঢুকতে পারার ব্যাপারে। এক কূটনৈতিক ব্যক্তিত্ব মারফত জানতে পারলাম, শফিকুল আলমের অভিযোগ আসলেই সত্য। আওয়ামী লীগ সরকার, বিশেষ করে গত ১০ বছরে, এমন এক নিয়ম করে রেখেছিল যে বিদেশ থেকে কোনো সাংবাদিক বাংলাদেশে যেতে চাইলে বিভিন্ন নিরাপত্তা পদক্ষেপ পার হয়ে যেতে হতো এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তারা ভিসা পেতে ব্যর্থ হতো। ধরা যাক, ব্রিটিশ কোনো সাংবাদিক বাংলাদেশে যাওয়ার জন্য ভিসার আবেদন করলো বাংলাদেশ হাইকমিশনে। আগে নিয়ম ছিল হাইকমিশন থেকে আবেদন যাচাই-বাছাই করে তারাই ভিসা ইস্যু করতে পারতো। কিন্তু স্বৈরাচার হয়ে যাওয়া আওয়ামী লীগ সরকার এই নিয়ম পরিবর্তন করে। হাইকমিশনে নির্দেশনা দিয়েছিল যে বিদেশ থেকে কোনো সাংবাদিক ভিসার আবেদন জমা দিলে সেটি যেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে রিভিউ করতে পাঠায়। সেই আবেদন এবং তথ্য যাচাইয়ের জন্য ডিজিএফআইর কাছে পাঠাতো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এই প্রসেসের ভিতর দিয়ে যেতে বিদেশি সাংবাদিকদের মাসের পর মাস অপেক্ষা করতে হতো।
আমার কূটনৈতিক সোর্স জানিয়েছেন যে সর্বসাকুল্যে ১০ শতাংশ বিদেশি সাংবাদিক ভিসা পেতো বাংলাদেশে সাংবাদিকতা করতে বা রিপোর্ট করতে। শফিকুল আলম আরও বলছিলেন, বর্তমান সরকার আওয়ামী লীগ সরকারের বিদেশি সাংবাদিকদের ভিসা রেস্ট্রিকশন তুলে নিয়েছে। সেই কূটনীতিক শফিকুল আলমের দাবির সত্যতাও জানালেন। সরকার থেকে তাদের কাছে মৌখিক নির্দেশনা এসেছে যেকোনো বিদেশি সাংবাদিক আবেদন করলে যেন দ্রুত ভিসা দিয়ে দেওয়া হয়। ভিসা অ্যাপ্রুভাল হওয়ার পর পররাষ্ট্র দফতরের মাধ্যমে সরকারকে অবহিত করলেই হবে। এটি একটা দারুণ উদ্যোগ, সে জন্য সরকারকে সাধুবাদ। একটা রাষ্ট্রকে তথ্য সংগ্রহের ব্যাপারে এরকম লিবারেল হতে হবে।
১৯৭১ সালের মার্চ মাসের ২৫ তারিখ মধ্যরাত থেকে অপারেশন সার্চ লাইট দিয়ে পাকিস্তানি আর্মি ঘুমন্ত মানুষের ওপর যে ম্যাসাকার চালালো, তারপর শুরু হলো মুক্তির জন্য, স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধ। এই যুদ্ধ চললো প্রায় ৯ মাস। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ বাংলাদেশকে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অর্জন করতে দেশের মানুষকে চরম মূল্য দিতে হয়েছে। পুরো নয় মাসজুড়ে চলে ভয়ঙ্কর গণহত্যা। ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করে এদেশীয় রাজাকারদের সহায়তায়। আড়াই লাখ নারী ও শিশুকে যৌন নির্যাতন করে। প্রাণভয়ে মানুষ শহর থেকে গ্রামে দিগ্বিদিক ছুটতে থাকে। এক কোটির মতো বাংলাদেশি জীবন রক্ষার্থে আশ্রয় নেয় ভারতে।
মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে এই বাংলাদেশে যে গণহত্যা হচ্ছিল, এটি পৃথিবীর মানুষকে প্রথমে জানিয়েছিলেন পাকিস্তানি সরকার থেকে নিয়োগকৃত সাংবাদিক এন্থনি মাস্ক্যারানহাস। তার সঙ্গে আরও ৭ জন সাংবাদিক ১০ দিনের ট্যুরে এসেছিলেন বিদেশি মিডিয়ায় রিপোর্ট করতে যে পূর্ব পাকিস্তানে একটা সিভিল আনরেস্ট হচ্ছে এবং সরকার সেটা ঠিক করে ফেলেছে। কিন্তু এন্থনি গণহত্যার ভয়াবহতা দেখে নিজেকে ধরে রাখতে পারেননি। সত্যটা জানিয়ে দিয়েছিলেন আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় (সানডে টাইমস, ১৩ জুন ১৯৭১)। এরপর বিদেশি সাংবাদিকরা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আসতে থাকেন। তারা যুদ্ধ এবং গণহত্যা কাভার করতে থাকেন। একপর্যায়ে পাকিস্তানি সরকার বিদেশি সাংবাদিক প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দেয়। (আমেরিকার ফটোসাংবাদিক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা লিয়ার লেভিনসহ মুক্তির গানের ভিডিও সংগ্রহকারী। পরে তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদ মুক্তির গান নামে একটা ডকুমেন্টারি বানিয়েছিলেন) কয়েকজন লুকিয়ে কাজ করে গেছেন। তাদের বিশাল ভূমিকা ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে। তাদের কাউকে কাউকে ‘ফ্রেন্ডস অব বাংলাদেশ’ উপাধিতে ভূষিত করেছিল বাংলাদেশ সরকার।
বাংলাদেশের সাংবাদিকরা বিদেশি সাংবাদিকদের সঙ্গে তেমন কোনো যোগাযোগ রক্ষা করে না বলে জানা যায়। এতে কোনো রিজিওনাল ও আন্তর্জাতিক সাংবাদিক ফোরাম বা সমিতিতে তাদের কোনো ভয়েস থাকে না। হাতে গোনা কয়েকজনকে দেখা যায় আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে যোগ দিতে। বাংলাদেশের বেশির ভাগ সাংবাদিক রুটি-রুজির জন্য কাজ করেন। এটি অন্য যেকোনো পেশার মতো একটা পেশা বা চাকরি হিসেবেই তারা নেয়। ফলে ইথিক্স মানা বা না মানা নিয়ে বেশির ভাগেরই মাথাব্যথা নেই। দেশে এত এত নিউজ টেলিভিশন চ্যানেল, অথচ একটা ইংরেজি ভাষার টেলিভিশন চ্যানেল নেই দেখে অবাক হয়ে যাই। আমরা সারা দিন যদি টিভি চ্যানেলে বাংলায় আলাপ করি সেসবের গ্লোবাল কীভাবে হবে?
আমাদের ইংরেজি দৈনিক মাত্র কয়েকটি। ভারতের কথা না হয় বাদই দিলাম, পাকিস্তানের টিভি চ্যানেলগুলোতে নিয়মিত ইংরেজিতে টকশো হয়। ক্রিকেট নিয়ে ওদের প্রাক্তন খেলোয়াড়দের আলোচনা শুনুন, আর আমাদের টিভিতে আলোচনা শুনুন, খুব ছোট লাগে নিজেদের। সরকারের এখনই উদ্যোগ নেওয়া দরকার, যাতে দেশে আন্তর্জাতিক মানের ইংরেজি চ্যানেল চালু করা যায়।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার (অথবা মিডিয়াগুলো নিজে থেকে) এখন পর্যন্ত সংবাদমাধ্যমকে এমন অবস্থায় নিয়ে গেছে, অ্যাকাডেমিক কোনো কাজে বাংলাদেশের পত্রিকা বা মিডিয়াকে ব্যবহার করা যাচ্ছে না। একটি সাধারণ উদাহরণ দিই। আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে আগস্টের শেষদিকে গাজী টায়ার্সে লুটপাটের একপর্যায়ে আগুন লেগে যায়। দাউ দাউ করে জ¦লতে থাকা ভিডিও দেখলাম আমরা। বাংলাদেশের সব মিডিয়া নিউজ করল শুরুতে। আমরা জানলাম ভিতরে আটকা পড়া ১৮৭ জন, মতান্তরে ১৭৫ জন মানুষ নিখোঁজ। এই খবরের পর সেই ঘটনা নিয়ে আর কোনো খবর প্রকাশ হলো না।
একদিকে বাংলাদেশের মিডিয়াগুলো এরকম অনেক কিছু কি গোপন করছেÑ এমন প্রশ্নও তৈরি হচ্ছে। অন্যদিকে ভারতের মিডিয়াগুলো বাংলাদেশের বিভিন্ন ব্যাপার নিয়ে অতি বাড়াবাড়ি করছে। তাদের নামিদামি পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলকেও দেখা যাচ্ছে গুজবে শামিল হয়েছে। এই যে তথ্য গোপন, গুজবের ডালপালা ছড়ানো, এসবের জন্য দায়ী কারা? বাংলাদেশের ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার সম্পাদকদের এই বিষয় নিয়ে অনেক বেশি এগিয়ে আসতে হবে।
এক সাংবাদিকের সঙ্গে কথা হচ্ছিল সংবাদপত্রের ও টেলিভিশনের এরকম তথ্য গোপনের বিষয় নিয়ে। তার কাছ থেকে জানতে পেরেছিলাম যে দুই নামি-দামি সম্পাদক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এই সরকার বেকায়দায় পড়ে এমন সংবাদ পরিবেশন থেকে তারা বিরত থাকবেন। আমি এরকম অলিখিত সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করে বলেছিলাম, তথ্য কখনও গোপন করা যাবে না। যা ঘটছে সেসব প্রচার করতে হবে। সম্পাদকরা চাইলে তাদের মতামতে লাগাম টানতে পারে। সেটা তাদের সিদ্ধান্ত। কিন্তু দেশের ভিতর কোনো ঘটনা ঘটলে, সরকার কোনো সিদ্ধান্ত নিলে সত্য তথ্য জানার অধিকার বাংলাদেশের প্রত্যেক নাগরিকের আছে। সেই নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করার দায় তাদের। তথ্যের আদান-প্রদান উন্মুক্ত হতে দিতে হবে।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, কার্লটন ইউনিভার্সিটি, কানাডা।
ভোরের আকাশ/রন