ভারতের ভুল তথ্য ছড়ানোর একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে ইন্ডিয়া টুডেতে গত ৩ ডিসেম্বর প্রচারিত একটি সাক্ষাৎকার। যেখানে ইন্ডিয়া টুডের গৌরব সাওয়ান্তের সঙ্গে কথা বলেছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। প্রসঙ্গ, ইস্কনের প্রাক্তন নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাস এবং বাংলাদেশের তথাকথিত ‘হিন্দু বিদ্বেষ’। সাক্ষাৎকার শুরু করার আগেই শুরু হয়ে যায় অপতথ্যের প্রচার।
উপস্থাপক শফিকুল আলমকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলা হয়, ‘...এখন শুনুন কীভাবে ইউনুস সরকারের এই কর্মকর্তা বিদ্যমান হিন্দু বিদ্বেষ অস্বীকার করছেন।’ অর্থাৎ এই বিদ্বেষ যেন প্রতিষ্ঠিত এবং প্রমাণিত সত্য।
গৌরব সাওয়ান্ত সাক্ষাৎকারের শুরুতেই বলেন, বাংলাদেশ থেকে আসা প্রতিবেদনগুলো বলছে বাংলাদেশে হিন্দু ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের জন্য পরিস্থিতি বেশ ‘শঙ্কাজনক’। শফিকুল আলমকে প্রশ্ন করেন, ‘হিন্দু ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ ও হামলা অনেক বেড়ে গেছে, এমতাবস্থায় তাদের নিরাপত্তার জন্যে সরকার কী করছে?’
আবারও তার এই ধরনের প্রশ্নের ঢং-এ মনে হয় ‘শঙ্কাজনক’ পরিস্থিতি বা সংখ্যালঘুদের ওপর বেড়ে যাওয়া আক্রমণ যেন প্রতিষ্ঠিত একটি বিষয়। এ নিয়ে আবার আলোচনা কী! সাক্ষাৎকারের শুরুতেই শফিকুল আলম স্পষ্ট করে বলেন, ভারতের দিক থেকে পাইকারি হারে অপতথ্যের প্রচারণা চলছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে হিন্দু কিংবা অন্য সংখ্যালঘুদের পরিস্থিতি যেরকম করে তুলে ধরা হচ্ছে, বাস্তবে মোটেও সেরকম নয়।
গৌরব সাওয়ান্ত দ্বিতীয় প্রশ্ন করতে করতেই স্ক্রিনে রমেন রায় এবং ইসকনের সাবেক নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের দুটি ছবি দেখানো হয়, যেখানে লেখা ভেসে উঠতে থাকে : ‘রমেন রায়, চিন্ময় প্রভুর আইনজীবী ইসলামি চরমপন্থীদের হামলার শিকার, ...তার জন্যে প্রার্থনা করুন।’ ছবিতে দেখা যায় অচেতন রমেন রায় হাসপাতালের আইসিইউতে শুয়ে আছেন। এটি ছিল অপতথ্যের আর একটি প্রলেপ।
রমেন রায় সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী। তিনি গত ২৫ নভেম্বর শাহবাগে ইসকন সমর্থকদের প্রতিবাদ চলার সময় হামলার শিকার হন। যথাযথ চিকিৎসার অভাবে তিনি কোমায় চলে যান এবং বর্তমানে সঙ্কটজনক অবস্থায় আছেন। ঘটনাটি নিঃসন্দেহে দুঃখজনক ও অত্যন্ত নিন্দনীয়। তবে রমেন কোনোভাবেই চিন্ময়ের আইনজীবী ছিলেন না। খুব সম্ভবত, তিনি দুই পক্ষের সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে আহত হন। এই নিরীহ মানুষটির ওপর বর্বরতার জন্যে দোষীদের খুঁজে বের করে পুলিশকে অবশ্যই আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে।
অন্যদিকে চিন্ময়, যাকে ইসকন ভিক্ষু হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তিনি এখন আর ইসকনে নেই। বলতে গেলে তার বিরুদ্ধে অত্যন্ত গুরুতর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে চিন্ময়কে ইসকন থেকে সরে দাঁড়াতে হয়েছে। কিন্তু স্ক্রিনের ছবি দেখে তা বোঝার কোনো উপায় নেই।
গৌরব সাওয়ান্ত বলেন ‘যেভাবে হিন্দু মন্দিরগুলো পোড়ানো হচ্ছে, শিক্ষকদের চাকরিচ্যুত করা হচ্ছে, পুলিশ কর্মীদের বরখাস্ত করা হচ্ছে...আপনার অ্যাটর্নি জেনারেল ইসকনকে মৌলবাদী বলছেন, কিন্তু হেফাজতে ইসলাম আর জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশে রাজার হালে আছে... বাংলাদেশের মতো একটি দেশের জন্য এমন পরিস্থিতি অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে... যেখানে কিনা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। সেই বাংলাদেশই এখন যেন আরেকটি পাকিস্তানে পরিণত হচ্ছে।’
এর জবাবে শফিকুল আলম পুনরায় বলেন, ভারত থেকে ইন্ডাস্ট্রিয়াল স্কেলে (ব্যাপকভাবে) ভুয়া তথ্যের অবাধ প্রচারণা চলছে এবং গৌরবকে অনুরোধ করেন যেন তিনি তার টিম পাঠিয়ে বাংলাদেশের সরেজমিন পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিবেদন করেন।
এই ধরনের প্রশ্নের মধ্যে (প্রশ্ন না বলে মন্তব্য বলা উচিত) এমন একেকটি বিষয় নিয়ে আসেন গৌরব যে তার প্রতিটির আলাদা করে জবাব না দিলে শফিকুল আলমের পক্ষে সাক্ষাৎকার এগিয়ে নেওয়া সম্ভব ছিল না। যেমন- জামায়াতে ইসলামীর কথা বলে বাংলাদেশকে চরমপন্থি তকমা দেওয়ার চেষ্টা। উত্তরে তখন ব্যাখ্যা করতেই হয় বাংলাদেশ মোটেও কট্টরপন্থি ইসলামী রাষ্ট্র নয়। তবে বাংলাদেশের কেউ কিন্তু ভারতের কাছে প্রশ্ন করে না কেন আরএসএস সেখানে প্রভাবশালী?- কারণ এটি ভারতীয়দের অভ্যন্তরীণ বিষয়, বাইরের নয়।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলোর প্রতিবেদন এবং মন্তব্যে মনে হয় তারা স্বীকারই করতে চায় না যে, গত ১০ বছর তাদের দেশের ক্ষমতাসীন দলটির লক্ষ্য হচ্ছে একটি হিন্দু রাষ্ট্র। যেমনটা বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামীর আদর্শ একটি ইসলামি রাষ্ট্র। এ দুটোর তফাত কিন্তু খুব বেশি নয়। ভারতীয় গণমাধ্যমের বক্তব্য এমন যে তারা কট্টর হিন্দু হলেও অসুবিধা নেই। কিন্তু বাংলাদেশের মুসলমান কোনোভাবেই মুসলমান হতে পারবে না। আরও একটি বিষয়, ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতায় সাহায্য করেছিল ঠিকই। কিন্তু তাই বলে ভারতের অঙ্গুলিহেলনে বাংলাদেশের চলতে হবে এমন কোনো দাসখত তো কেউ লিখে দেয়নি।
উপস্থাপকের কথায় মনে হয় যেন বাংলাদেশের কোনায় কোনায় শত শত মন্দির জ¦লে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে, উন্মত্ত মৌলবাদী মোল্লারা হিন্দু শিক্ষকদের এবং পুলিশ কর্মকর্তাদের পদত্যাগে বাধ্য করছে। হ্যাঁ, অস্বীকার করা যাবে না যে এমন কিছু ঘটনা ঘটেনি। আক্রমণ হয়েছে, সংঘাত হয়েছে। আমরা তা নিয়ে প্রতিবেদন লিখেছি। সে বিষয়ে ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে এবং সম্প্রতি পরিস্থিতি একেবারে স্বাভাবিক ছিল। উত্তপ্ত হতে শুরু করে চিন্ময় গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকে। তবে ভারতের দিকে তাকালে মনে হবে, হামলা আক্রমণ সেই যে আগস্ট মাসে শুরু হয়েছিল তা বুঝি এখনো চলছে।
এটা ঠিক, পুলিশ কর্মকর্তা এবং শিক্ষকদের পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। কিন্তু সেটা তাদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার কারণে, তাদের ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে নয়। এর মধ্যে মুসলমানরাও ছিলেন। প্রকৃতপক্ষে, যদি আসলে সংখ্যা গোনা হয় তো দেখা যাবে মুসলমানদের সংখ্যা হয়তো হিন্দুদের তুলনায় চারগুণ বেশি হবে। এর পেছনে ধর্মীয় ঘৃণার কোনো বিষয় ছিল না। এটি রাজনৈতিক প্রতিহিংসা থেকে হয়েছে।
গৌরব বলেন, মুন্নি সাহা- যিনি একজন সাংবাদিক, তাকেও ঢাকার রাস্তায় হেনস্থা হতে হয়েছে, তাহলে ইন্ডিয়া টুডের সাংবাদিকদের নিরাপত্তা কীভাবে দেবে সরকার? কিন্তু মুন্নি সাহার ঘটনাও একই রকম রাজনৈতিক প্রতিহিংসার ফল। শফিকুল আলম ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন যে এটা ধর্মীয় নিপীড়নের ঘটনা নয়। আগস্ট মাসে কিছু মন্দির ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছিল ঠিকই কিন্তু সেটা এখন আর চলছে না। সম্প্রতি চট্টগ্রামে একটি মন্দিরে পাথর ছোড়ার ফলে ঠাকুরের সামনের কাচের দরজা ভেঙে যায়। কিন্তু ভারতীয় গণমাধ্যমের প্রচারণায় মনে হয় যেন বেশ কয়েক ডজন মন্দিরে উন্মত্ত মোল্লারা ঢুকে সব ভেঙেচুরে ইট-কাঠ লুটে নিয়ে গেছে।
তবে শফিক এসবের বিশদ ব্যাখ্যা করার সুযোগ পান না। ততক্ষণে গৌরব এবং শফিকুল একরকম বাকযুদ্ধে লিপ্ত এবং দুজন একই সঙ্গে কথা বলতে থাকেন। তাতে কেউই কারও কথা শোনে না। শফিক কয়েকবার অনুরোধ করেন তাকে যেন পুরো কথাটা শেষ করতে দেওয়া হয়; কিন্তু উপস্থাপক তা করতে দেন না। বাধ্য হয়ে শফিকুল আলমেরও গলা চড়াতে হয়। এদিকে চিন্ময় প্রভুর আইনজীবি মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন, তার জন্যে প্রার্থনা করুন ঘুরে ঘুরে আসছে স্ক্রিনে। সব মিলিয়ে শফিককে মনে হবে যেন তিনি একজন ধরা পড়ে যাওয়া সরকারি কর্মকর্তা যে টেলিভিশনে মেজাজ দেখাচ্ছেন।
৪ ডিসেম্বর সম্প্রচারিত এনডিটিভির সাক্ষাৎকারে (এটাও শফিকুল আলমের সঙ্গে) উপস্থাপক বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংসতা নিয়ে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, ‘আমাদের হাতে কিছু ভিডিও, ছবি এবং মন্তব্য এসেছে, যেখানে দেখা যায় যে মূলত সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ চলছে।’ আবারো একই অপতথ্যের সরব বয়ান। এই ছবি বা ভিডিও বা মন্তব্য কাদের এবং এনডিটিভি তা কীভাবে পেল তারও কোনো ব্যাখ্যা নেই। আর চলমান আক্রমণের কোনো প্রমাণ তো নেইই। তবে প্রশ্নটা এমনভাবে করা যে সহিংসতা এবং হানাহানি যেন একেবারে সর্বজন স্বীকৃত।
শফিকুল বলেন, কিছু সহিংসতা ঘটেছিল, তবে তা বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এই উপস্থাপক তার প্রশ্ন চালিয়ে যান মোটামুটি শান্তভাবেই। তবে স্ক্রিনে তখন সহিংসতার ফুটেজ চলছে। যাতে দেখা যায়, একাধিক স্থানে তাণ্ডব চলছে, সন্ত্রাসীরা রাস্তার ওপর নারীদের ওপর চড়াও হয়েছে, উন্মত্ত জনতা পুলিশকে তাড়া করছে এবং কেউ আবার পুলিশ ভ্যান ভাঙছে। দেখে যে কেউ মনে করবেন যে এগুলো হিন্দুদের ওপর আক্রমণের ঘটনা এবং বাংলাদেশ পরিস্থিতি একেবারে বেসামাল হয়ে গেছে। কিন্তু এসব ফুটেজের অধিকাংশই আসলে জুলাই-আগস্ট মাসের, যখন ছাত্রলীগ ক্যাডাররা আন্দোলনরত সাধারণ ছাত্রদের ওপর হামলা চালিয়েছিল এবং এক পর্যায়ে যখন ছাত্রজনতার রোষের মুখে পুলিশ পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়- সেই ফুটেজ। কিন্তু এরকম দাঙ্গা হাঙ্গামার ফুটেজের পাশে শফিকুল আলম যখন বারবার বলতে থাকেন পরিস্থিতি আসলে তেমন খারাপ না, নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই, তার কথা তখন হাস্যকর মনে হয়। সরকারি কর্মচারীরা যেমন করে সত্য ঢাকার চেষ্টা করে, শফিককে ঠিক সেই দলেরই মনে হয়।
দুঃখজনকভাবে কতগুলো অর্ধসত্য তুলে এনে তা অতিরঞ্জন করে ভারতীয় সামাজিক মাধ্যম এবং টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে প্রচার করা যেন দস্তুর হয়ে গেছে। সাংবাদিকতার ন্যূনতম মানও আর বজায় থাকছে না। অধিকাংশ ভারতীয় গণমাধ্যমের একই দশা। তবে এখনো কিছু বিশ্বাসযোগ্য গণমাধ্যম আছে যেমন ‘দ্য হিন্দু’। করন থাপাড়ের মতো তুখোর ইন্টারভিউয়ারও আছেন, যার সামনে পড়লে একেবারে নাজেহাল করে ছেড়ে দেবেন, কিন্তু এক মুহূর্তের জন্যও পেশাদারত্বের এতটুকু নড়চড় হবে না। তার সঙ্গে রাজদীপ সারদেসাইয়ের সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারেই সারদেসাই ভারতীয় গণমাধ্যমের অবনতি নিয়ে চরম হতাশা প্রকাশ করেছেন।
তবে সবচেয়ে উদ্বেগজনক ব্যাপার হলো, সীমান্তের ওপারের ভুয়া তথ্য প্রচারণা পরিস্থিতিকে শান্ত না করে বরং উস্কে দিচ্ছে। এতে ভারতের সংখ্যালঘুদের পাশাপাশি বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের জন্যও পরিস্থিতি উদ্বেগজনক হয়ে উঠছে। এবং তা এতটাই খারাপ হচ্ছে যে সেটা সামাল দেওয়ার জন্যে সরকারি পর্যায়ে হস্তক্ষেপ দরকার হচ্ছে যেন পরিস্থিতি একেবারে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে না যায়।
লেখক : বিশ্লেষক
ভোরের আকাশ/রন