বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির ইতিহাস গৌরবের। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা আন্দোলন- সবখানে তাদের অবদান ছিল ঈর্ষণীয়। স্বাধীন দেশেও বিভিন্ন ইস্যুতে তারা মাঠে নেমেছেন। যেখানে অনিয়ম, অধিকার খর্ব হয়েছে; সেখানেই তারা প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন। স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে উঠেছিল তাদেরই কারণে। সবশেষ এ বছর শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটাতেও তারাই ছিল সবার আগে। তবে তারা যতটা না জাতীয় ইস্যুতে মাঠে নেমেছেন, ততটা নিজেদের স্বার্থের জন্য তাদের মাঠে দেখা যায়নি। আবার লেজুড়ভিত্তির কারণে তাদের সমালোচনাও কিন্তু কম হচ্ছে না। ফলে তাদের রাজনীতির চেয়ে পড়ার টেবিলে থাকা জরুরি।
গত বৃহস্পতিবার বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বোপার্জিত স্বাধীনতা চত্বরে ‘ডায়ালগ ফর ডেমোক্র্যাসির আয়োজনে নীতি সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেখানে ছাত্রনেতারা বলছেন, যে ছাত্ররাজনীতি ছাত্রদের পড়ার টেবিল থেকে বের করে মধুর ক্যানটিনে নিয়ে আসে নেতাদের প্রটোকল দিতে, সেই ছাত্ররাজনীতি চাই না। ছাত্ররাজনীতি হতে হবে শিক্ষার্থীদের স্বার্থে। লেজুড়বৃত্তিক নয়, বরং এটি হতে হবে ডাকসুকেন্দ্রিক। সংলাপে অংশ নেন বৈষমবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ, জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্যসচিব আখতার হোসেন, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের সেক্রেটারি জেনারেল জাহিদুল ইসলাম, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি মেঘমল্লার বসু, সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী রাফিয়া রেহনুমা হৃদি। সংলাপে ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন অংশ নেওয়ার কথা থাকলেও তিনি আসেননি। অনুষ্ঠানে সূচনা বক্তব্য দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ও শামসুন নাহার হল ছাত্র সংসদের সাবেক সহ-সভাপতি রাফিয়া রেহনুমা হৃদি। তিনি বলেন, আমরা পূর্বের ছাত্ররাজনীতির ভয়ঙ্কর রূপ দেখেছি। এই রাজনীতির শিকার হয়ে শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত হয়েছে। ছাত্ররাজনীতিকে সব ক্ষেত্রে উন্মুক্ত রাখার কথা বলেন ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি মেঘমল্লার বসু। তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সিআর (শ্রেণি প্রতিনিধি) নির্বাচন করে পরবর্তী সময়ে সিআর কাউন্সিল গঠন করা যেতে পারে। তবে ডাকসুর গঠনতন্ত্র অবশ্যই সংস্কার করতে হবে।
ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি থাকতে হবে, তবে তা লেজুড়বৃত্তিক হবে না- এ কথা বলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ। তিনি বলেন, ‘যেই ছাত্ররাজনীতি আমাদের পড়ার টেবিল থেকে বের করে মধুর ক্যানটিনে নেতাদের প্রটোকল দিতে বাধ্য করে, সেই ছাত্ররাজনীতি আমরা চাই না। বিদ্যমান দলীয় ছাত্ররাজনীতি ছাত্রদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। ছাত্ররাজনীতি যেখানে শিক্ষার্থীদের হলের আবাসনসংকট, খাবার মানসহ বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে কথা বলার কথা ছিল, সেখানে তারা গণরুম জিইয়ে রেখে আসন নিয়ে রাজনীতি করেছে। হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, দলীয় ছাত্ররাজনীতি শিক্ষার্থীদের পুঁজি করে তাদের যে ‘মাদার পার্টি’, সেটাকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করেছে। ছাত্ররাজনীতি হতে হবে ডাকসুকেন্দ্রিক। ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল তার বক্তব্যে সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদীর বক্তব্য উল্লেখ করেন। জাহিদুল বলেন, ‘মওদুদী বলেছেন, ছাত্ররাজনীতি একটি ইবাদত। অর্থাৎ অন্যান্য ইবাদত যেভাবে করি, ছাত্ররাজনীতিও সেভাবে আন্তরিকতার সঙ্গে করতে হবে বলে আমরা মনে করি। বিভিন্ন দেশে ছাত্ররাজনীতিকে আমরা যদি একটু স্টাডি করি, আমরা দেখব, তারা গঠনমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে। কিন্তু আমাদের দেশে সেটা হয় না। জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক আখতার হোসেন ছাত্ররাজনীতির নামে ছাত্রলীগের নিপীড়নের কথা তুলে ধরেন। নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে তিনি বলেন, ফোন চেক করে আমাকে মারধর করা হয়েছে। আমরা আর সেই রাজনীতি চাই না। ছাত্ররাজনীতি হতে হবে শিক্ষার্থীদের জন্য। ছাত্ররাজনীতি হতে হবে শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের জন্য।
এই ছাত্র নেতাদের সঙ্গে সুর মেলাতে চাই আমরা। ছাত্ররা থাকুক পড়ার টেবিলে। তারা রাজপথে নামুক নিজেদের স্বার্থে। অবশ্যই তারা লেজুড়ভিত্তির রাজনীতি থেকে দূরে থাকুক।
ভোরের আকাশ/রন