আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে গত ১১ থেকে ২২ নভেম্বর হয়ে গেল জলবায়ু সম্মেলন-২৪ (কপ২৯)। জাতিসংঘের এবারের জলবায়ু সম্মেলনে ২০৩৫ সাল পর্যন্ত দরিদ্র দেশগুলোকে বছরে অন্তত ৩০০ বিলিয়ন ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ধনী দেশগুলো। সম্মেলনে অতিরিক্ত ৩৩ ঘণ্টা লেগেছে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছতে। এই চুক্তি কতটা বাস্তবায়ন হবে তা নিয়ে রয়েছে সংশয়। আবার বাংলাদেশের মতো দেশগুলো কীভাবে অর্থ পাবে তাতেও রয়েছে একধরনের জটিলতা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে না পারলে ভেস্তে যাবে এই সম্মেলনের উদ্দেশ্যও। জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এবারের গঠিত তহবিল নিয়ে সমালোচনা করেন। বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলো তহবিল থেকে ন্যায্য পাওনা কতটা পাবে, তা নিয়ে সন্দিহান তারা। ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলো নতুন ও অতিরিক্ত তহবিল, ঋণের বদলে অনুদান এবং সুস্পষ্ট তহবিলের দাবি করলেও সেগুলো উপেক্ষিত রয়ে গেছে এবারের সম্মেলনে। এবারের কপকে ‘ক্লাইমেট ফাইন্যান্স কপ’ নামে অভিহিত করা হলেও উন্নত দেশগুলো ট্রিলিয়ন ডলারের তহবিল নিয়ে একমত হতে পারেননি।
আজারবাইজানে জাতিসংঘের বার্ষিক জলবায়ু সম্মেলন আয়োজনের বিরোধিতা করেন সুইডিশ পরিবেশকর্মী গ্রেটা থুনবার্গ। তিনি জর্জিয়ার রাজধানী তিবিলিসিতে প্রতিবাদ মিছিলেও অংশ নেন। ২১ বছর বয়সী গ্রেটা থুনবার্গ এবং মিছিলে অংশ নেওয়া অন্য পরিবেশকর্মীরা বলেন, নিপীড়নমূলক নীতির কারণে জলবায়ু সম্মেলনের আয়োজক হওয়ার যোগ্য নয় দেশটি। তার কারণ হলো বিশ্বের অন্যতম জ্বালানি তেল উত্তোলনকারী দেশ আজারবাইজান। থুনবার্গের অভিযোগ, আজারবাইজান একটি নিপীড়ক ও দখলদার রাষ্ট্র। দেশটি জাতিগত নিধন অভিযান চালিয়েছে। নাগরিক সমাজের ওপর ক্রমাগত দমনপীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে। থুনবার্গ এক্সে (সাবেক টুইটার) লেখেন, জলবায়ু সংকটের কারণে বিপুল সংখ্যক জীবন ধ্বংস হয়ে গেছে বা হবে, যারা ক্ষমতায় আছেন তাদের কারণে অগণিত মানুষ মৃত্যুমুখে পতিত হতে চলেছে। জলবায়ু সংকটে যেমন মানুষের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে, তখনও সারা বিশ্বে নিপীড়ন, অসমতা, যুদ্ধ এবং গণহত্যা তীব্রতর হচ্ছে। যারা ক্ষমতায় আছে তারা আমাদের জীবন সহায়ক ইকোসিস্টেম আরও অস্থিতিশীলতা ও ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বিশ্বব্যাপী গ্রিন হাউস গ্যাস গত বছরও সর্বকালের সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছেছে। এটা স্পষ্ট যে বর্তমান সিস্টেমগুলো আমাদের পক্ষে কাজ করছে না। কপের প্রক্রিয়াগুলো কেবল আমাদের ব্যর্থ করছে না, এর কারণে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে খেসারত দিতে হবে।
২০১৫ সালে ফ্রান্সের প্যারিসে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে একটি চুক্তি হয়। জাতিসংঘের ১৯৬টি দেশ এতে সম্মতি দেয়। ইউনাইটেড নেশনস ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (ইউএনএফসিসিসি) গঠনের ২৩ বছর পর এই সম্মতিতে আসতে পেরেছিল জাতিসংঘভুক্ত দেশগুলো। এটি অনেকটা আশার সঞ্চার করেছিল বিশ্ববাসীর কাছে। প্যারিস চুক্তিতে ঠিক হয়, বৈশ্বিক তাপমান দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসে ধরে রাখা। সেজন্য ২০৩০ সালের মধ্যে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে কার্বন ও গ্রিন হাউজ গ্যাস নিঃসরণ ৫০ শতাংশ কমানোর সিদ্ধান্ত হয়। উন্নয়নশীল দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য লড়াই করতে উন্নত দেশগুলোর বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলার সহায়তা দেওয়ার বিষয়টিও নির্দিষ্ট করা হয়েছিল এই চুক্তিতে। কিন্তু তা আলোর মুখ দেখেনি।
সদ্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পুনরায় জয়ী হয়েছেন রিপাবলিকান দলের প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলার লড়াইয়ে বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি ও গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণে দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততা সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কেবল অভিঘাতের প্রথম সারিতে থাকা উন্নয়নশীল দেশগুলোকে আর্থিক সহায়তার দিক থেকে নয়, কার্বন নিঃসরণ হ্রাসে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমাতে বৈশ্বিক প্রতিশ্রুতির প্রশ্নেও তারা এগিয়ে ছিল। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৬ সালে তার প্রথম মেয়াদে প্যারিস চুক্তি থেকে বের হয়ে গিয়েছিলেন। ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রথম দফার ক্ষমতায়নের মতো ফের ভেস্তে যেতে পারে বাকুর প্রতিশ্রুতি।
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাকু জলবায়ু সম্মেলনে ‘থ্রি জিরো বা তিন শূন্য’ তত্ত্বকেই তুলে ধরেছেন এবার। সম্মেলনে নিজের ভাষণে এই তত্ত্বের উপস্থাপনা করে তিনি বলেন, এটাই এক নতুন সভ্যতার জন্ম দেবে। গড়ে তুলবে এক নতুন পৃথিবী, যা সবার জন্য বাসযোগ্য হবে। কপ-২৯ এর ওয়ার্ল্ড লিডার্স ক্লাইমেট অ্যাকশন সামিটের উদ্বোধন অধিবেশনে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, এই পৃথিবী গড়ে তোলা সম্ভব। আমাদের সবাইকে শুধু এমন এক জীবনশৈলী গ্রহণ করতে হবে, যা এই পৃথিবীকে সবার জন্য নিরাপদ করে তুলবে।
পৃথিবীর যেসব দেশ সবচেয়ে বেশি জলবায়ু ঝুঁকিতে আছে, তার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষ দশে। চরম উষ্ণতা, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, নদ-নদীর বন্যা, খরা, নদীভাঙন আকস্মিক বন্যা, শহরাঞ্চলের বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, তীব্র তাপপ্রবাহ, তীব্র শীত, বজ্রপাত, ভূমিধস, সমুদ্রপৃষ্ঠের উষ্ণতা বৃদ্ধি ও অম্লতা। এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতি বছর বাংলাদেশকে ক্ষতির সম্মুখীন করছে।
সেন্টার ফর পার্টিসেপটরি রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (সিপিআরডির) প্রধান নির্বাহী মো. শামসুদ্দোহা বলেন, কপ-২৯ এ নির্দিষ্ট কোনো দেশের জন্য আলাদা বরাদ্দ নেই। যে ৩০০ বিলিয়ন ডলার ক্ষতিগ্রস্ত দেশের জন্য বরাদ্দ হয়েছে সেটা ২০৩৫ সাল পর্যন্ত দেওয়া হবে। বাংলাদেশকে এখান থেকে প্রস্তাব জমা দিয়ে তহবিল নিতে হবে। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো যেসব টাকা বরাদ্দ হয়, বিভিন্ন মাধ্যম থেকে এসব টাকা আনতে একটি বৃহৎ প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। টাকা কারা ব্যয় করবে কীভাবে ব্যয় করবে? যথাযথ ব্যবহার হবে কি না, টাকার হিসাব রাখবে কে? এসব বিষয় নিশ্চিত করে প্রস্তাব দিতে পারলে তহবিল পাওয়া সম্ভব। বরাদ্দ করা অর্থের কিছু অংশ যায় সরাসরি সবুজ জলবায়ু তহবিলে (গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড-জিএফসি)। এছাড়া কিছু অর্থ আসে বহুপাক্ষিকভাবে যেমন- বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের মাধ্যমে। তবে এসব ব্যাংক আমাদের অনুদান না দিয়ে ঋণ দেয়। আমরা যদি জলবায়ু অভিযোজনের কথা বলি, সেটা হলো অনুদান আদায় করা, কোনোভাবেই ঋণ নয়। এসব জায়গা থেকে টাকা আনতে হলে আমাদের নিজেদের প্রস্তুতি দরকার।
শামসুদ্দোহা বলেন, ভালো অর্থ পেতে হলে ভালো মানের প্রজেক্ট তৈরি করতে হবে। আমাদের একটা সমস্যা হলো, আমরা নিজেদের জলবায়ু পরিবর্তনে ঝুঁকিপূর্ণ দেশ ও ক্ষয়ক্ষতি প্রমাণ করতে ব্যস্ত হয়ে যাই, কিন্তু ঝুঁকি মোকাবিলায় অর্থ কীভাবে কাজে লাগাবো, সেটা ইফেকটিভ হবে কি না? অর্থের যথাযথ ব্যবহার ও সঠিকভাবে প্রজেক্ট বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রস্তাব দিতে পারি না। এসব কারণে তহবিল থেকে বঞ্চিত হতে হয়। তিনি বলেন, আমরা প্রজেক্ট যেভাবে বাস্তবায়ন করবো তার একটা প্রস্তাবনা তৈরি করতে হবে। এতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। ইনোভেটিভ প্রজেক্ট করতে হবে, কিন্তু বাংলাদেশের ইনোভেটিভ প্রজেক্ট নেই। আমরা অভিযোজন বলতে বুঝি সাইক্লোন শেল্টার তৈরি করতে হবে, দুর্যোগের ওয়ার্নিং দেওয়া এসব। আমাদের দেখাতে হবে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এই সমস্যাগুলো হচ্ছে।
স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ গবেষণা অধ্যয়ন কেন্দ্রের চেয়ারম্যান আহমেদ কামরুজ্জামান বলেন, কপ-২৯ এ জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর পক্ষ থেকে তাদের ক্ষয়ক্ষতির জন্য দুই ট্রিলিয়ন ডলার দাবি করা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ৩০০ বিলিয়ন ডলারে এসে আলোচনা শেষ হয়। এই ৩০০ বিলিয়ন ডলার থেকে অনুন্নত দেশগুলো ক্ষতিপূরণ পাবে। কিন্তু আমাদের এবার আলাদা করে ক্ষতিপূরণের দাবি ছিল। যেহেতু বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনে অধিক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। একইভাবে উপকূলীয় রাষ্ট্র, দ্বীপ রাষ্ট্র, অধিক ক্ষতিগ্রস্ত রাষ্ট্র দাবি জানিয়েছে, কিন্তু দাবি আদায় হয়নি। বেশি ক্ষতিগ্রস্ত রাষ্ট্র বেশি ক্ষতিপূরণ পাবে, এরকম একটা বিষয় ছিল। শেষ পর্যন্ত এসব দাবি আমলে নেওয়া হয়নি। এটা বাংলাদেশের অপ্রাপ্তি। তবে যতটুকু তহবিল রয়েছে, এই তহবিল পাওয়ার পদ্ধতিটা কঠিন হয়ে পড়ছে। এছাড়া তহবিল পেতেও অনেক সময় লেগে যাচ্ছে। মাঝেমধ্যে প্রস্তাব জমা থেকে অনুদান পাওয়া পর্যন্ত ছয়-সাত বছর লেগে যায়। তহবিল ছাড় হতেও দু-তিন বছর সময় লেগে যায়। এই সাত-আট বছরে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরও বেড়ে যায়। ফলে ওই তহবিল দিয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় (ক্লাইমেট রেসিলিয়েন্স) ফেরা সম্ভব হয় না। এজন্য সময়টুকু কমিয়ে আনতে হবে। কপ-২৯ এর মাধ্যমে যেসব অর্থ জমা হয়, সেটার মেরিটের ওপর ভিত্তি করে টাকা দেওয়া হয়। তাই অর্থ পেতে হলে আমাদের ভালো প্রজেক্ট প্ল্যান দিতে হবে।
জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচির (ইউএনইপির) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উন্নয়নশীল দেশগুলোর বর্তমান জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় দৈনিক এক বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন। কিন্তু তারা পাচ্ছে মাত্র ৭৫ মিলিয়ন ডলার। বিশ্লেষকরা বলছেন, এবার আগের চেয়ে অর্থের পরিমাণ কিছুটা বেড়েছে। কিন্তু এ তহবিল পাওয়ার প্রক্রিয়ায় বেগ পোহাতে হবে বাংলাদেশকে। এছাড়া অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এক্ষেত্রে হয়তো কিছুটা উপকার হতে পারে।
কপ সম্মেলনের শুরুতেই ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছিলেন, আমাদের প্রধান প্রচেষ্টা হবে উদ্বেগ ও দাবিগুলো কপ-২৯-এর চূড়ান্ত ঘোষণায় অন্তর্ভুক্ত করা। জলবায়ু সমস্যার সমাধানে পানির সর্বোত্তম ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব দেওয়া। নেপাল ও ভুটানের জলবিদ্যুৎ ব্যবহার করে একটি দক্ষিণ এশিয়া গ্রিড তৈরির আহ্বানও জানান ড. ইউনূস।
পরিবেশ অধিদপ্তরের জলবায়ু পরিবর্তন ও আন্তর্জাতিক কনভেনশন শাখার পরিচালক মির্জা শওকত আলী বলেন, এবারের সম্মেলনে আমাদের উপদেষ্টা জাপান ও জার্মানির সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন। জার্মানির ভাইস চ্যান্সেলর বলেন, আমাদের নদী পরিষ্কারে সাহায্য করবেন। তবে অ্যামাউন্ট আগের চেয়ে বাড়ছে। সে জন্য কিছু সুবিধা পাওয়া যাবে। আমরা কিছু কার্বন শেডিংয়ের প্রকল্প নিতে পারবো। তবে টাকা ব্যয়ের একটা রোড ম্যাপ লাগবে। তিনি বলেন, আমাদের পানি উন্নয়ন বোর্ড, কৃষি মন্ত্রণালয়ের ভালো ক্যাপাসিটি আছে। তারা যদি ভালো প্রস্তাব জমা দেয়, তাহলে বড় অনুদানের প্রজেক্ট পাবে। আমাদের প্রস্তুতি বেশি থাকতে হবে, যেন তহবিল বেশি আনতে পারি।
ওয়াটার কিপার্স বাংলাদেশের সমন্বয়ক ও পরিবেশবিদ শরিফ জামিল বলেন, এবারের কপ সম্মেলনে বাংলাদেশ জোরালো পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে উন্নত দেশগুলো জলবায়ু সম্মেলনে ন্যায্য আচরণ করেনি। অভিযোজন ও প্রশমনের যে দায় উন্নত বিশ্বের রয়েছে, এটা তারা অস্বীকার করেছে। এতে প্যারিস জলবায়ু চুক্তির যে যৌথ অঙ্গীকার ছিল, তার সঙ্গে সাংঘর্ষিক অবস্থান রয়েছে। এটা শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতির সম্মুখীন যে কোনো দেশের জন্য হতাশাজনক।
কপ-২৯ সম্মেলনে যাওয়া এই পরিবেশবিদ বলেন, উন্নত দেশগুলোর আগে তহবিল দেওয়া ছিল বাধ্যতামূলক। এখন সেটা করেছে মোবিলাইজ; ফলে প্রাইভেট সেক্টর বাণিজ্যের একটা বিষয় থাকে। সুতরাং জলবায়ু পরিবর্তনে দুর্গত দেশগুলোর পাশে দাঁড়ানোর যে দায় রয়েছে, সে জিনিসটা সম্পূর্ণ অস্বীকার করা হয়েছে। দ্বিপাক্ষিক চুক্তির মাধ্যমে উন্নত বিশ্বের সঙ্গে আলোচনা করে তহবিল নেওয়াও ঠিক হবে না। বাংলাদেশ হয়তো অনেক দেশের সঙ্গে বৈঠক করেছে। কেননা উন্নত দেশ সহযোগিতা করলে সেটা তাদের স্বার্থে করবে। এসব অর্থের বেশির ভাগ থাকবে ঋণ। আমার মতে, দ্বিপাক্ষিকভাবে সম্প্রসারণ করে তহবিল আনা কৌশলগতভাবে ভালো হয় না। কারণ তখন যে কোনো দেশ তাদের অর্থনৈতিক সহযোগিতার ওপর নির্ভরশীল হয়ে যাবে। শরিফ জামিল বলেন, যে জায়গায় উন্নত দেশগুলো অধিক কার্বন নিঃসরণ করে তারা অর্থনৈতিকভাবে বরাদ্দ ও ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য দায়বদ্ধ ছিল। সেখানে তারা চলে যাচ্ছে বিনিয়োগকারীর কাতারে। ফলে দরিদ্র দেশগুলোর আইনত যে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার কথা সেটা পাচ্ছে না।
ভারত, সুইজারল্যান্ড, মালদ্বীপ, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশ প্রতিবাদ জানিয়ে বলছে, জীবাশ্ম জ্বালানির বৈশ্বিক ব্যবহার কমানোর বিষয়ে যে ভাষা চুক্তিতে ব্যবহার করা হয়েছে, তা খুবই দুর্বল। চুক্তির সমালোচনা করে গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার শিফট আফ্রিকার পরিচালক মোহামেদ আদৌ বলেন, উন্নয়নশীল বিশ্বের জন্য কপ-২৯ একটি বিপর্যয়। ধনী দেশগুলো, যারা জলবায়ু পরিবর্তনকে গুরুত্ব দেওয়ার দাবি করে, তারাই ধরিত্রীর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।
সিপিআরডির প্রধান নির্বাহী শামসুদ্দোহা বলেন, জলবায়ু তহবিলের অর্থ পেতে বাংলাদেশের স্ব স্ব মন্ত্রণালয়কে তাদের ক্ষয়ক্ষতি অনুযায়ী প্রকল্প পরিকল্পনা করতে হবে। বিশেষ করে পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কৃষি মন্ত্রণালয়, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার, স্বাস্থ্য, দুর্যোগ ও ত্রাণ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়গুলোকে প্রকল্প পরিকল্পনা নিতে হবে। পরিবেশ অধিদপ্তর এসব মন্ত্রণালয়কে কারিগরি সহায়তা ও পরামর্শ দেবে। শামসুদ্দোহা বলেন, সবুজ জলবায়ু তহবিলের জন্য বাংলাদেশে ন্যাশনাল ডেজিগনেটেড অথরিটি (এনডিএ) রয়েছে। বাংলাদেশে টাকা অ্যাকসেস করতে হয় পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএস) ও ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেডের (ইডকল) মাধ্যমে। এদের দায়িত্ব হচ্ছে, টাকার যথাযথ ব্যয় নিশ্চিত করা। এছাড়া সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবিলার জন্য কী ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে আইডিয়া নিয়ে এনডিএ একটা পাইপলাইন তৈরি করবে। এই পাইপলাইন অনুযায়ী প্রকল্প প্রস্তাবনা তৈরি হবে। এরপর তা জমা দেওয়া হবে সবুজ জলবায়ু তহবিলে। সমস্যা হলো, বাংলাদেশের এ প্রকল্প পরিকল্পনাগুলো খুব বেশি জোরালো হয় না। ফলে বাংলাদেশ চরম ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া সত্ত্বেও পর্যাপ্ত তহবিল পেতে ব্যর্থ হয়। বাংলাদেশের উচিত পর্যাপ্ত গ্রাউন্ড ওয়ার্ক করে প্রস্তাব তৈরি করা। তাহলে আমরা ভালো অনুদান পাবো এবং ঝুঁকিও মোকাবিলা করা সম্ভব হবে।
ভোরের আকাশ/রন