কবি হেলাল হাফিজ, এক নাম, যা যুগ যুগ ধরে বাংলা সাহিত্যের বৈচিত্র্যময় ক্যানভাসে অম্লান থাকবে। সাহিত্যের গভীরতা ও জীবনবোধে যিনি হয়ে উঠেছিলেন এক আলোকবর্তিকা, তাঁকে হারিয়ে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি হারালো এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তিনি ছিলেন ব্যতিক্রমী, ছিলেন নিঃসঙ্গ এবং ছিলেন অতিক্রমী। তার জীবন যেন এক চলমান কবিতা, যেখানে বৈরাগ্য, প্রেম, অভিমান, এবং ত্যাগ মিশে ছিল এক অপূর্ব ছন্দে।
হেলাল হাফিজ বলেছিলেন, “যে জলে আগুন জ্বলে” কবিতাটি রচনা করে তিনি নিজের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিলেন, এমন গভীর অনুভূতির আরেকটি কবিতা তিনি কখনোই লিখতে পারবেন না। তাঁর কবিতা যেমন পাঠকের হৃদয় ছুঁয়ে যায়, তেমনি তাঁর জীবনের গল্প আমাদেরকে করে শিহরিত। সেই গল্পের মাঝে যেমন আছে ১৯৭১ সালের যুদ্ধকালীন ভয়াবহতা, তেমনই আছে এক গভীর প্রেমের আঘাতে চিরতরে সংসারবিমুখ হয়ে ওঠার বেদনা।
বৈরাগ্যের পথে প্রথম ধাক্কা: ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের রাত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলে থাকাকালীন যে দুঃস্বপ্নের শুরু, তা ছিল তাঁর জীবনের প্রথম বড়ো ধাক্কা। সেদিনের সেই বিভীষিকাময় রাতের বেঁচে থাকা একটি বিস্ময়। হেলাল হাফিজ নিজেই বলেছিলেন, সেই রাতে যদি ফজলুল হক হলে বন্ধু হাবিবুল্লাহর সাথে দেখা করতে না যেতেন, তাহলে হয়তো শহীদ হওয়া নিশ্চিত ছিল। ভোরে ইকবাল হলে ফিরে গিয়ে তিনি দেখেন লাশের স্তূপ। এই ভয়াবহ অভিজ্ঞতা তাঁর হৃদয়ে যে ক্ষত তৈরি করেছিল, তা তাঁকে জীবনের প্রতি বৈরাগ্যের দিকে ঠেলে দিয়েছিল।
এই উপলব্ধি থেকে তাঁর মনে হয়েছিল, তিনি যেন এক বোনাস জীবন বেঁচে আছেন। যুদ্ধ, মৃত্যু, এবং ধ্বংসের সাক্ষী হওয়া একজন তরুণের মনে যে স্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারে, তা তাঁকে আধ্যাত্মিকতার পথে নিয়ে গিয়েছিল।
দ্বিতীয় আঘাত: পিতার মৃত্যু
১৯৭৩ সালের ১৯ জুন। মাত্র ২৫ বছর বয়সে পিতার মৃত্যু হেলাল হাফিজকে জীবনের একাকীত্বের আরেকটি মাত্রায় পৌঁছে দেয়। ছোটবেলায় মাতৃহারা এই কবি তাঁর বাবাকেই জীবনের আশ্রয়স্থল হিসেবে পেয়েছিলেন। বাবার মৃত্যু তাঁকে শুধু শোকগ্রস্তই করেনি, বরং জীবনের অর্থহীনতা ও জগতের ক্ষণস্থায়িত্বের বিষয়ে তাঁর ভাবনাকে আরও গভীর করেছে। একে তিনি নিজেই উল্লেখ করেছেন তাঁর জীবনের অন্যতম দিক পরিবর্তনকারী ঘটনা হিসেবে।
প্রেমের পরাজয় ও সংসারবিমুখতা
বাবার মৃত্যুর কয়েক মাস পরই ঘটে তৃতীয় এবং সবচেয়ে গভীরতর আঘাত। তাঁর প্রেমিকা হেলেন তাঁকে জানালেন, পরিবারের পছন্দে অন্যত্র তাঁর বিয়ে ঠিক হয়েছে। হেলাল হাফিজ এই আঘাতকে মুখে প্রকাশ না করলেও তাঁর জীবনের অভিমানের ভার আরও বেড়ে যায়। প্রেমিকার শেষ বিদায়ের পর তিনি চিরতরে সংসার, অর্থ, প্রতিষ্ঠার মোহ ত্যাগ করেন। কবির ভাষায়:
“যাঁরা আমাকে ভালোবাসেননি, তাঁদের প্রতি আরও বেশি কৃতজ্ঞতা। কারণ তাঁদের অবহেলা, অনাদর, প্রত্যাখ্যান আর ঘৃণাই আমাকে কবি বানিয়েছে।”
এই বেদনা ও অভিমানের সংমিশ্রণই তাঁকে এক অনন্য কবিতার জগতে পৌঁছে দিয়েছিল।
"যে জলে আগুন জ্বলে" ও কবির অমরত্ব
হেলাল হাফিজের “যে জলে আগুন জ্বলে” এক বিপ্লবী সৃষ্টি। এটি শুধু একটি কবিতা নয়, এটি একটি আন্দোলন, যা পাঠককে চমকে দেয়, জাগিয়ে তোলে। ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত এই কবিতা-সংকলন তাকে এনে দেয় অবিস্মরণীয় খ্যাতি। এই কবিতার পঙক্তিগুলি এক অনন্ত জীবনবোধের প্রতিফলন:
"এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়
এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।"
এই কবিতা তরুণ প্রজন্মের জন্য এক নতুন সাহসিকতার প্রতীক। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী প্রজন্মের মাঝে এটি আশার সঞ্চার করেছিল। হেলাল হাফিজ জানতেন, সাহিত্য কেবল রূপ-তুলনার খেলা নয়; এটি মানুষের মননে পরিবর্তনের জন্য এক শক্তিশালী হাতিয়ার।
জীবনের একাকীত্ব ও সাহিত্যিক ভাবনা
জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত হেলাল হাফিজ ছিলেন একা। শাহবাগ সুপার হোস্টেলের ছোট একটি কক্ষে তাঁর একাকী জীবন যেন তাঁর কবিতার প্রতিচ্ছবি। তাঁর সম্পর্কে বলতে গেলে মনে পড়ে জীবনানন্দ দাশের কথা, যিনি বলেছিলেন:
“মানুষের একাকীত্ব কেবল তার নিজের নয়, সমগ্র মানবজাতির।”
হেলাল হাফিজের বৈরাগ্যময় জীবনও যেন সেই একাকীত্বেরই বহিঃপ্রকাশ। কবি বিশ্বাস করতেন, জীবনকে খুব গভীরভাবে অনুভব করাই শিল্পের প্রকৃত উৎস। তিনি জীবনকে ভালোবেসেছেন নিজের শর্তে, নিজের বিশ্বাসে।
মৃত্যুর প্রহরে
১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, শুক্রবার। জুমার নামাজের পর খবর এলো, কবি হেলাল হাফিজ আর নেই। শাহবাগের সুপার হোস্টেলের ওয়াশরুমে পড়ে গিয়ে তাঁর রক্তাক্ত শরীরের শেষ নিঃশ্বাস নিয়েছে। হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই তিনি চলে গেছেন না ফেরার দেশে। জীবনকে ত্যাগ করে সত্যকে আপন করেছিলেন, আর মৃত্যুতেও রয়ে গেলেন তেমনই নিঃসঙ্গ।
কবির প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি
হেলাল হাফিজ এক জীবনদর্শনের নাম। তিনি বৈরাগ্য, প্রেম, অভিমান, এবং সৃষ্টিশীলতার যে মিশ্রণ আমাদের দিয়ে গেছেন, তা চিরকাল স্মরণীয়। তাঁর মতো বিশুদ্ধ কবি আমাদের সাহিত্য জগতে বিরল। কবি শামসুর রাহমান একবার বলেছিলেন:
“হেলাল হাফিজের কবিতা হৃদয়ের গভীরতম অনুভূতিকে ছুঁতে পারে। তার কবিতায় যে আবেগ ও গভীরতা আছে, তা তাকে একজন অনন্য কবি হিসেবে চিহ্নিত করে।”
হেলাল হাফিজের সাহিত্য ও জীবন ছিল বিপরীতমুখী, কিন্তু একে অপরের সঙ্গে গভীরভাবে সংযুক্ত। তাঁর কাব্য জীবনকে ছুঁয়েছে, মানুষের প্রেম, যুদ্ধ, বিরহ, এবং আত্মত্যাগের গল্প বলেছে।
আজ আমরা তাঁকে বিদায় জানাই। কিন্তু তাঁর কবিতার প্রতিটি শব্দে, তাঁর গভীর জীবনদর্শনের প্রতিটি স্তবকে, তিনি আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন চিরকাল। প্রিয় কবি, শান্তিতে ঘুমান। আপনার লেখা যেমন বলেছে:
“একটি মানুষ, আপনাকে ভুলতে পারেনি এই জনমে।
আপনারা অন্তত একবার দেখা করুন, জীবনের ওইপারে।”
একজন ব্যতিক্রমধর্মী কবি এবং একজন মানুষ হেলাল হাফিজ। জীবনের চাহিদা রুচি আচার-আচরণে যিনি স্বতন্ত্রবোধ সৃষ্টি করেছেন। কবির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।
লেখক: বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক।