প্রতিটি দেশের সরকার উৎখাতের ঘটনায় থাকে ভিন্নতা। তারপরও সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদ ও বাংলাদেশে শেখ হাসিনাকে উৎখাতের ঘটনায় রয়েছে বিস্ময়কর কিছু মিল। দুজনকেই বিকল্পহীন ভাবা হলেও তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়েছে তাদের শাসন। নিজেদের জনপ্রিয় দাবি করলেও জনগণ তাদের কতটা অপছন্দ করে, সে ব্যাপারে তারা কোনো ধারণাই রাখতেন না। ভাবতেন শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে আছেন। কিন্তু সেটা যে ভেতর থেকে ঘুনে ধরা, তা তারা বুঝতে পারেননি। সব ন্যারেটিভ তারা নিয়ন্ত্রণ করছেন বলে ভাবতেন। কিন্তু কেউ যে তাদের বিশ্বাস করে না, সেটাই তারা জানতেন না। নিজেদের ইতিহাসের অপরিহার্য চরিত্র মনে করতেন। অথচ পতনের কয়েক দিনের মধ্যেই তাদের জায়গায় অন্যরা চলে এসেছেন। দুজনেই মনে করতেন, জনগণকে শাসন করা তাদের স্রষ্টাপ্রদত্ত অধিকার এবং এর জন্য জনগণের মতামত জানার প্রয়োজন নেই। তাদের শাসন এতটাই নিষ্ঠুর ও অমানবিক ছিল যে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর দুজনকেই পালিয়ে অন্য দেশে আশ্রয় নিতে হয়েছে। যে দেশকে তারা নিজেদের সম্পত্তি বলে মনে করতেন, সেই দেশেই তাদের কোনো জায়গা হয়নি।
পরিবর্তনশীল বিশ্বের সর্বশেষ অধ্যায় সিরিয়ার বিপ্লব। এগিয়ে চলার পথে বৈশ্বিক পরিবর্তনশীল পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে বালাদেশকেও। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, এর জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা কি আমাদের আছে?
বাংলাদেশে সবচেয়ে কম আলোচিত বিষয়গুলোর একটি হচ্ছে পররাষ্ট্রনীতি। এটি সবসময় আমলাতান্ত্রিক জটিলতার আবরণে ঢাকা থাকে। দ্য ডেইলি স্টারে ৩৩ বছরের অভিজ্ঞতায় আমি এমন একটি উদাহরণও মনে করতে পারছি না, যেখানে সরকার পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে জনসমক্ষে আলোচনা করেছে। আমাদের সংসদও এ বিষয়ে ব্যর্থ হয়েছে এবং ভোটারদের হতাশ করেছে। কারণ, পররাষ্ট্রনীতি কখনোই সংসদে আলোচনার জন্য উত্থাপিত হয়নি। সীমিত পরিসরে আলোচনা হয়েছে কেবল বেসরকারি থিংক ট্যাঙ্ক বা গণমাধ্যমেই।
বেশ কয়েকটি সংস্কার কমিশন গঠন করা হলেও পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে কোনো কমিশন গঠন করা হয়নি। এর থেকেই বোঝা যাচ্ছে যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়টিকে আমরা কতটা প্রাধান্য দেই বা এটা নিয়ে আমাদের মনোভাব কেমন। কমিশন না হলেও অন্তত আমাদের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব, জ্যেষ্ঠ আমলা, সাবেক রাষ্ট্রদূত, শিক্ষাবিদ ও নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের আনুষ্ঠানিকভাবে একত্রিত করে আলোচনা করতে পারতাম যে কীভাবে এই পরিবর্তনশীল ভূরাজনৈতিক বাস্তবতার মধ্যে এগিয়ে যাওয়া যায়।
উদাহরণ হিসেবে ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটিকেই ধরুন। মানচিত্রের দিকে তাকালেই বোঝা যায় আমাদের ভৌগোলিক অবস্থান কতটা গুরুত্বপূর্ণ, জটিল, বহুমুখী ও সূক্ষ্ম এবং নিজেদের সর্বোচ্চ সুবিধা নিশ্চিত করতে ঠিক কতটা মানসম্পন্ন ও বহুমুখী দক্ষতার প্রয়োজন। আমি প্রায়ই ভাবি, কেন আমাদের বৈদেশিক সম্পর্ক নিয়ে গবেষণার জন্য বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান নেই, বিশেষ করে বৃহৎ প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে? আমাদের অপর নিকটতম প্রতিবেশী (মিয়ানমার) সম্পর্কে কি আমরা সত্যিই ভালোভাবে জানি? রোহিঙ্গা সংকট অনেক আগেই সমাধান করা উচিত ছিল এবং এটা বোঝা উচিত ছিল, এ ধরনের সমস্যা সমাধানে ভূরাজনৈতিক সহযোগিতার বিকল্প নেই।
প্রতিটি মানসম্পন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উচিত এমন কিছু কোর্স চালু করা, যেখানে এসব বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করে বিশেষজ্ঞ তৈরি করা যাবে। আরাকান আর্মির আকস্মিক উত্থান ও মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ায় আমাদের সামনে এক নতুন বাস্তবতা। এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করার মতো দক্ষতা কি আমাদের আছে? এমনকি, এগুলো বোঝার মতো যথাযথ দক্ষতা কি আছে?
দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদক হিসেবে দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় দেখেছি, যখন আমরা ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের কথা বলি, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শুধু নয়াদিল্লি ও কলকাতার কথা ভাবি। খুব বেশি হলে মুম্বাই পর্যন্ত চিন্তা করি। কিন্তু দক্ষিণ ভারতের বিষয়ে আমাদের ধারণা খুবই সীমিত। অথচ, সেখানে ভারতের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের ভিত্তিমূল, যেখান থেকে আমাদের স্টার্টআপ ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উদ্যোক্তারা অনেক কিছু শিখতে পারেন। আমরা ভারতের সঙ্গে কীভাবে একটি নতুন সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারি, যেখানে উভয়ই লাভবান হবে এবং একইসঙ্গে কোনো আধিপত্যবাদ থাকবে না, থাকবে মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান? এই প্রশ্নের জবাব নিশ্চিতভাবেই জ্ঞান, দক্ষতা ও নিজের প্রতি বিশ্বাসে। আমাদের আত্মবিশ্বাসের অভাব নেই। কিন্তু বাকি দুইটি অর্জনে কঠোর পরিশ্রম প্রয়োজন। আমাদের প্রয়োজন ঠান্ডা মাথার বিশেষজ্ঞ, যারা একসঙ্গে বসে সব হিসাব-নিকাশ করবে, তথ্য প্রকাশ করবে এবং একটি স্থিতিশীল ও পারস্পরিক সহযোগিতাপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করবে; যা দুদেশের জন্যই মঙ্গলজনক। যেকোনো ধরনের একতরফা সমঝোতা নিশ্চিতভাবেই ব্যর্থ হবে।
ভারতীয় পররাষ্ট্রসচিবের সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সফরের পর আমরা আন্তরিকভাবে আশা করছি, দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উন্নতি হবে। কেননা সাম্প্রতিক সময়ে এমন কিছু ইঙ্গিত দেখেছি; যা এই সম্পর্কের জন্য উদ্বেগজনক। সত্যি বলতে, ভারতীয় গণমাধ্যম যেভাবে বাংলাদেশকে উপস্থাপন করছে, তাতে আমরা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ ও হতাশ।
সিরিয়ায় সরকার পরিবর্তনের বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া যাক। রাশিয়ার দীর্ঘদিনের মিত্র বাশার আল-আসাদের পতনে ক্রেমলিনের ভূমিকা কী ছিল-যাকে ক্ষমতায় রাখতে পুতিন হাজারো বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছিলেন? সহজভাবে চিন্তা করলে বলা যায়, ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়া এত বেশি অর্থ ব্যয় করতে বাধ্য হয়েছে এবং হচ্ছে যে, তাকে অর্থায়নের বিষয়ে সতর্ক হতে হয়েছে। এক্ষেত্রে তিনি ইউক্রেন যুদ্ধকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। তাহলে রাশিয়ার নতুন কৌশল কী হবে? তারা কি সিরিয়াকে ছেড়ে যাবে?
ইরানের ভূমিকাই-বা কী? তারা বাশার আল-আসাদকে সব ধরনের সমর্থন দিয়ে বিজয়ী পক্ষের সঙ্গে থাকার ক্ষণস্থায়ী স্বস্তি উপভোগ করেছে। গাজা থেকে হামাস নির্মূলের সর্বাত্মক চেষ্টা ও পরবর্তীতে লেবাননে হিজবুল্লাহর ক্ষমতা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে যাওয়ায় সিরিয়ার বিদ্রোহীরা ক্ষমতা দখলের নতুন সুযোগ পায়। কার্যত এই দুই সংগঠন (হামাস-হিজবুল্লাহ) বাশার আল-আসাদের ক্ষমতায় টিকে থাকার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ইরানের ওপর এসব ঘটনার কেমন প্রভাব পড়েছে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে নিঃসন্দেহে তেহরানের অবস্থান আগের তুলনায় দুর্বল হয়ে পড়েছে।
৪৮ ঘণ্টার ব্যবধানে সিরিয়ার সামরিক স্থাপনায় ৪৮০ বারেরও বেশি বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। এ থেকে স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে কীভাবে এই যুদ্ধবাজ দেশটি পরিস্থিতির সুযোগ নিচ্ছে। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে গাজাবাসীর ওপর নিষ্ঠুরতম ও সর্বোচ্চ ধ্বংসাত্মক বোমা হামলা ও হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে ইসরায়েল।
এরপর তারা লেবাননে হামলা চালিয়ে হিজবুল্লাহকে নির্মূলের নামে হাজারো সাধারণ মানুষকে হত্যা করেছে। ইসরায়েলি সৈন্যদের সিরিয়ার ভূখণ্ডে, বিশেষ করে গোলান মালভূমির আশপাশে প্রবেশ করতে দেখা গেছে, যে এলাকা দখলে নিজের প্রথম মেয়াদে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইসরায়েলকে অনুমতি দিয়েছিলেন। ইসরায়েল বিনাবাধায় কয়েকটি প্রতিবেশী দেশের ওপর নির্বিচার হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। এগুলো আন্তর্জাতিক আইনের সরাসরি লঙ্ঘন হলেও জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে এ বিষয়ে কোনো নিন্দার প্রস্তাব আনা হয়নি। ফলে, ইসরায়েল পুরোপুরি দায়মুক্তি উপভোগ করছে।
ইরানের মুখোমুখি হওয়ার ক্ষেত্রে ইসরায়েলের নীতি কী হবে, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন। যখন একটি দেশ অন্য দেশের অভ্যন্তরে বাধাহীন হস্তক্ষেপ করতে পারে এবং তাদেরকে উল্টো উৎসাহও দেওয়া হয়, তখন তাদের আগ্রাসন কতদূর যেতে পারে তার কোনো সীমা নেই। ইতিহাসের এই অধ্যায়টি অত্যন্ত বিপজ্জনক।
তুরস্ক এখন আগের তুলনায় আরও সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। ভূরাজনীতির খেলায় দেশটির প্রেসিডেন্টের হাতে আগের চেয়ে এখন অনেক বেশি তুরুপের তাস আছে। অপরদিকে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আমলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক অবশ্যই একটি বড় চ্যালেঞ্জের বিষয় হবে। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী ও অযৌক্তিক মন্তব্য মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্মকর্তাদের মধ্যে তিক্ততা সৃষ্টি করেছে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের তথাকথিত দুর্দশা নিয়ে এক্সে (সাবেক টুইটার) ট্রাম্পের বার্তা আমাদের ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছে।
এক্ষেত্রে আমাদের জন্য ভারসাম্য আসার একমাত্র বিষয় হলো যুক্তরাষ্ট্রে ড. ইউনূসের প্রতি থাকা সম্মান। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে অন্যতম ব্যক্তি, যিনি দুটি সর্বোচ্চ পদক পেয়েছেন-২০০৯ সালে প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম এবং ২০১০ সালে কংগ্রেশনাল গোল্ড মেডেল। দুটি পদকই তিনি পেয়েছেন রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাটিক পার্টির যৌথ সম্মতিতেই।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিকে এই অনিশ্চিত বিশ্বেই পথ খুঁজে নিতে হবে। প্রথম ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি আমাদের বুঝতে হবে তা হলো, অভ্যন্তরীণ বিষয়ে আবেগ ও অনুভূতি কাজ করলেও পররাষ্ট্রনীতিতে আমাদের চালিকাশক্তি হতে হবে বাস্তববাদ। অবশ্যই আমাদের নিজস্ব আদর্শ ও বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। কিন্তু এগিয়ে যাওয়ার একমাত্র পথ হলো বাস্তবতাকে গ্রহণ করা। ক্ষমতাধর দেশগুলোর জন্য নিজেদের শক্তি দেখানো একটি উপায় হতে পারে। কিন্তু আমাদের জন্য যৌক্তিক, তথ্যভিত্তিক ও বিশ্বাসযোগ্য উপায়ে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরা এবং বৈশ্বিক সমর্থন জোগাড় করাই একমাত্র সমাধান।
নতুন বাংলাদেশকে বিশ্বের কাছে বিশ্বাসযোগ্যভাবে নিজেদের কথা তুলে ধরতে হবে। অন্যদেরকে এটা বোঝাতে হবে যে, আমরা দেশের অভ্যন্তরে একটি মুক্ত, ন্যায়সঙ্গত, অন্তর্ভুক্তিমূলক, সহনশীল ও গণতান্ত্রিক সমাজ গড়তে চাই এবং বৈশ্বিকভাবে একটি শান্তিপূর্ণ ও ন্যায়সঙ্গত আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে চাই। এর জন্য শুধুমাত্র কথা ও বক্তৃতা যথেষ্ট নয়। আমাদের এমন কাজ করতে হবে যেখান থেকে সবাইকে শক্তিশালী বার্তা দেওয়া যায় এবং এর জন্য প্রয়োজন সর্বস্তরে দক্ষতা।
লেখক : সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার
ভোরের আকাশ/রন