logo
আপডেট : ১৯ ডিসেম্বর, ২০২৪ ১১:৫৯
মুক্তিযুদ্ধে বাংলার শিল্পী সমাজ
দীপংকর গৌতম

মুক্তিযুদ্ধে বাংলার শিল্পী সমাজ

মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির আত্মপরিচয়ের স্মারক কিংবা জন্ম-জরুল বলা যায়। মুক্তিযুদ্ধ কখনও একটি ঘটনার মধ্য দিয়ে শুরু হয় না। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের আগে আমরা একই বিষয় দেখে এসেছি। সিপাহি বিদ্রোহ বা সিরাজউদ্দৌল্লার আম্রকাননের যুদ্ধ - কোনোটাই মুক্তি সংগ্রাম থেকে আলাদা নয়। আন্দোলন-সংগ্রামের এক একটি সোপান অতিক্রম করে স্বাধীনতা সংগ্রামের দিকে অগ্রসর হয়। বাঙালির স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা ছিল বহু পুরনো। কৈবর্ত বিদ্রোহ থেকে তেভাগা, টংক, নানকার, ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহসহ বিভিন্ন কৃষক সংগ্রাম - সব গণসংগ্রামই ছিল স্বাধীনতার এক একটি সোপান।

স্বাধীনতা যুদ্ধ কখনও একবারে বা একদিনে শুরু হয়েছে - বিশ্বের বিভিন্ন দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস তা বলে না। বাঙালির গণসংগ্রামের এই ধারাবাহিকতায় ৫২, ৬২, ৬৯-এর রক্তাক্ত পথ পেরিয়ে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অজস্র মানুষের আত্মদানের মধ্য দিয়ে আসে মুক্তির সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। আমাদের মহান স্বাধীনতা ত্রিশ লাখ মানুষের রক্ত ও ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে ঘুমন্ত নিরীহ বাঙালির ওপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে। ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নামক পরিকল্পনার নামে নারকীয় গণহত্যা শুরু করে। এক রাতেই তারা হত্যা করে ৩০ হাজার মানুষকে। এত কম সময়ে এত বড় গণহত্যা বিশ্বের ইতিহাসে নজিরবিহীন। প্রথমে কেউ বুঝে উঠতে পারেনি কী করবে। তারপর পথ সব খুলে যায়। মা, মাটি ও মানুষ রক্ষায় তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে বাংলার দামাল ছেলেরা।

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ শুরু হয় স্বাধীনতা যুদ্ধ। দেশকে হানাদারমুক্ত করতে মরণপণ লড়াইয়ে অংশ নেয় রাজনৈতিক কর্মী, ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, পেশাজীবী, শিল্পীসহ সব শ্রেণির মানুষ। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণ ও গণহত্যা মোকাবিলায় গড়ে তোলে প্রতিরোধ। সশস্ত্র যুদ্ধের পাশাপাশি মননশীলতার মধ্য দিয়েও যুদ্ধকে গতিশীল করা হয়। গঠিত হয় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। একইভাবে চিত্রশিল্পীরাও শামিল হয় জনযুদ্ধে। শিল্পীর দায়বদ্ধতার প্রশ্ন কত বড় তা বুঝেই সময়ের দাবি পূরণ করতে শিল্পীরা মানুষের চেতনায় প্রতিবাদের ভাষা জুড়ে দিতে মুক্তিসেনাদের মতোই নেমে পড়েন মাঠে।

বিশ্বখ্যাত লেখক মিলান কুন্ডেরা বলেছেন, ক্ষমতার বিরুদ্ধে মানুষের সংগ্রাম হচ্ছে বিস্মৃতির বিরুদ্ধে স্মৃতির সংগ্রাম। আত্মদানের প্রতিজ্ঞায় দীপ্ত দীর্ঘ ধারাবাহিক অভিযাত্রা ছিল আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম। দেশভাগের পর কৃষকের তেভাগা আন্দোলনে শিল্পী সোমনাথ হোড় কীভাবে কৃষকের সংগ্রামের সাথী হয়ে ছবি এঁকেছেন, তার তেভাগার ডায়েরি সে পরিচয় বহন করছে আজও। একইভাবে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন আবির্ভূত হয়েছিল মুক্তিসংগ্রামের মূল বাতিঘর হিসেবে।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ছিল ঢাকা আর্ট কলেজের বার্ষিক প্রদর্শনীর উদ্বোধনের দিন। কিন্তু সেদিন তারা প্রদর্শনী বন্ধ করে, ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মিছিলে যোগ দিয়েছিল। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন ইমদাদ হোসেন, মুর্তজা বশীর, আমিনুল ইসলাম, কাইয়ুম চৌধুরী, রশীদ চৌধুরী প্রমুখ। এছাড়া একুশের পোস্টার, ফেস্টুন এঁকে আন্দোলনে প্রাণসঞ্চার করেছিলেন শিল্পীরা। ১৯৬৮ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি থেকে শিল্পীরা রাজপথসহ বিভিন্ন স্থানে আলপনা আঁকার রীতি প্রবর্তন করেন চারুশিল্পীরাই।

শহীদ মিনার থেকে আজিমপুর কবরস্থান পর্যন্ত রাস্তাজুড়ে আঁকা আলপনা বাঙালির সংস্কৃতিতে এক নতুন মাত্রা যুক্ত করে, সৃষ্টি করে নবচেতনার। ১৯৬৭ থেকে শিল্পীরা বিভিন্ন বার্তা বহনকারী ব্যানারের প্রদর্শনী করে এসেছিল। ১৯৬৯ বাঙালির আত্মপ্রতিষ্ঠার আন্দোলনে ভিন্নমাত্রা যুক্ত করে। সেই বছর ২১ ফেব্রুয়ারির স্লোগান ছিল ‘আজ পলাশ ফোটার দিন’। ঢাকা আর্ট কলেজের ছাত্ররা ‘অ’ ‘আ’ অক্ষর দিয়ে ফুলের বলয় এবং আন্দোলনের বার্তা বহনকারী স্বরবর্ণের ব্যানার শহীদ মিনারে টানায়। এই কাজে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিয়েছিলেন শিল্পী রফিকুন নবী, মুস্তাফা মনোয়ার, শাহাদাৎ চৌধুরী, প্রাণেশ মণ্ডল, আবুল বারক আলভী, সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ, আনোয়ার হোসেন, লুতফর রহমান, ইমদাদ হোসেন প্রমুখ।

১ দফা আন্দোলনে চারুশিল্পীদের ভূমিকা কী হবে তা নিয়ে প্রথম সভা হয় তৎকালীন ইকবাল হলে। এই সভায় রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন তোফায়েল আহমেদ, সাইফুদ্দীন আহমেদ মানিক, শাজাহান সিরাজ প্রমুখ। সিদ্ধান্ত হয় আন্দোলনের জন্য শিল্পীরা পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুন তৈরি করবে। সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখবেন ডাকসুর সেই সময়কার সাংস্কৃতিক সম্পাদক আসাদুজ্জামান নূর। আর্ট কলেজে প্রতিদিন রাত জেগে পোস্টার লেখা হতো। প্রতিদিন এক রিম কাগজে সর্বোচ্চ ৫০০ পোস্টার লেখার দায়িত্ব দেওয়া হয়। এই কাজে সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ, মঞ্জুরুল হাই, শহীদ কবির, রেজাউল করিম, বিজয় সেন, অলক রায়, স্বপন চৌধুরী, হাসি চক্রবর্তী, মনসুরুল করিমসহ আর্ট কলেজের ছাত্ররা যুক্ত ছিলেন।

১৯৬৯ সালের ১৭ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের প্রথম কর্মসূচি ছিল ১১ দফার পর। ২০ জানুয়ারি পুনরায় সভা হয়। সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা আসাদ পুলিশের গুলিতে শহীদ হন। ২৪ জানুয়ারি শহীদ হন নবকুমার ইনস্টিটিউটের নবম শ্রেণির ছাত্র মতিউর। রচিত হয় বিখ্যাত কবিতা ‘আসাদের শার্ট’। মিছিলের স্লোগান ও চারুশিল্পীদের আঁকা ব্যানার পোস্টারে মানুষের প্রতিবাদ উচ্চারিত হয়। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু বাংলার মানুষের বাঁচার দাবি ৬ দফা ঘোষণার কিছু দিন পর গ্রেপ্তার হন। ১৯৬৯-এ সারা দেশ জনরোষে ফুঁসছিল। ১৯৬৯-এর ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনার চত্বরে ১০-১২ ফুট আকারের ক্যানভাসজুড়ে শিল্পীরা ছবি আঁকেন। যেখানে ফুটে ওঠে পাকিস্তানি স্বৈরশাসকের নিপীড়ন, শোষণ ও বঞ্চনার কথা, বাঙালির অধিকারের কথা। সে সময় রাস্তায় নেমে ছবি এঁকেছেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন, কামরুল হাসান, রশিদ চৌধুরী, আমিনুল ইসলাম, হাশেম খান, মুস্তাফা মনোয়ার, রফিকুন নবীসহ অনেকে।

ঢাকার পাশাপাশি চট্টগ্রামের শিল্পীরাও প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে ব্যানার, ফেস্টুন অঙ্কন করেন। ‘অতি সাম্প্রতিক আমরা’ নামের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে ‘আবহমান বাংলা, বাঙালি’ শীর্ষক ম্যুরাল প্রদর্শনীর আয়োজন করে। শিল্পী সবিহ উল আলম, এনায়েত হোসেন, আবুল মনসুর শওকত হায়দার, চন্দ্রশেখর দে, তাজুল ইসলাম, শফিকুল ইসলাম এই ম্যুরাল করেন। শিল্পী রশীদ চৌধুরীর নেতৃত্বে চট্টগ্রামে সভা-সমাবেশ করেন ও চিত্রকর্মের মাধ্যমে পাকিস্তানি শাসকদের নিপীড়নের কথা তুলে ধরেন রং ও তুলিতে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ভারতে অবস্থানরত শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ারের কিছু দুর্লভ চিত্রকর্ম আমরা পাই, যেমন - ১৯৭১-এ দেশ পত্রিকায় শারদীয় সংখ্যায় প্রকাশিত কথাশিল্পী শওকত ওসমানের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস ‘জাহান্নাম হতে বিদায়’-এর জন্য বেশ কিছু স্কেচ, যা ছিল খুবই অসাধারণ। এই স্কেচগুলোতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নৃশংসতা, নারী নির্যাতন, সাধারণ মানুষের ভীতি প্রকটভাবে প্রতিফলিত হয়েছে।

৯৬৯-এর গণআন্দোলনে ‘বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজ’-এর ব্যানারে চারুশিল্পীরা সভা-সমাবেশ করেন। নেতৃত্ব দেন শিল্পী কামরুল হাসান, হাশেম খান, শাহাদাৎ চৌধুরী, বিজয় সেন, গোলাম সরোয়ার, মঞ্জুরুল হাইসহ অনেকেই। দেশের শিল্পী সমাজ মুক্তিযুদ্ধে নানাভাবে অংশ নিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধে তাদের রং-তুলি মারণাস্ত্রের চেয়েও কোনো কোনো সময় বেশি কাজ করেছিল। তাছাড়া অনেক শিল্পী রং-তুলি রেখে অস্ত্র হাতে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। শিল্পী শাহাবুদ্দীনের নাম তাদের মধ্যে অন্যতম।

একাত্তরের এপ্রিলে খালেদ মোশাররফের অধীনে দুই নম্বর সেক্টরে তিনি গেরিলা ট্রেনিং নিয়ে ছিলেন। তিনি ছিলেন পাকিস্তানি বাহিনীর আতঙ্ক ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্য। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে তিনি শাহবাগ রেডিও স্টেশনে ঢুকে পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়িয়ে দেন।

আরও যেসব শিল্পী মুক্তিযুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ করেছিলেন তারা হলেন - শাহাদাত চৌধুরী (বিচিত্রার সম্পাদক), জি এম এ রাজ্জাক, হরিহর সরকার, মইনুল হোসেন, সৈয়দ সালাউদ্দিন চৌধুরী, এম এ খালেক, গোলাম কিবরিয়া চৌধুরী, জি এম খলিলুর রহমান, স্বপন আচার্য, ইয়াকুব খান, মজিবুর রহমান সিরজুদ্দিন, বনিজুল হকসহ অনেকে।

১৯৭১ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে একটি প্রদর্শনীতে ১৭ জন শিল্পীর ৬৬টি শিল্পকর্ম স্থান পায়। ঐতিহাসিক এই প্রদর্শনী দেখেই বিশ্ববাসী বাংলার দুরবস্থার কথা জানতে পেরেছিল। প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণকারী শিল্পীর নাম ও শিল্প-গোলাম মোহাম্মদ, ‘সূর্য বিলোপ’; অঞ্জন বণিক, ‘রক্তাক্ত বাংলাদেশ’; বীরেন সোম, ‘কান্না’, ‘দুঃস্বপ্ন’; চন্দ্রশেখর দে, ‘নিষ্পাপ শিকার’, ‘চঞ্চল পাখি’; মুস্তাফা মনোয়ার, ‘গর্বিত মা’, ‘নারী এবং পশু’; নাসির বিশ্বাস, ‘ধর্ষণ’ ইত্যাদি।

মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণাদানকারী শিল্পীদের মধ্যে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র পটুয়া কামরুল হাসান। তিনি অনুভব করেছিলেন একমাত্র একটি স্বাধীন রাষ্ট্রীয় কাঠামো প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাঙালির সত্যিকারের মুক্তি সম্ভব। ১৯৭১-এর মার্চে স্বৈরাচারী শাসক ইয়াহিয়া খান যখন নিরস্ত্র বাঙালির ওপর হিটলারি কায়দায় গণহত্যা শুরু করলো, তখন তিনি ক্ষোভে জ্বলে উঠে ‘ইয়াহিয়া এই জানোয়ারটা আবার আক্রমণ করতে পারে’ শিরোনামে ১০টি পোস্টার আঁকেন।

পোস্টারগুলো শহীদ মিনারে জনসাধারণের জন্য প্রদর্শন করা হয়। যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে কামরুল হাসান পশ্চিমবঙ্গে চলে যান এবং নবগঠিত মুজিবনগর সরকারের তথ্য ও প্রচার বিভাগের প্রধান দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তখন তিনি ইয়াহিয়া খানের প্রতিকৃতি দিয়ে একটি বিখ্যাত ব্যঙ্গচিত্র আঁকেন ‘এই জানোয়ারদের হত্যা করতে হবে’ শিরোনামে। সেখানে দানব আকারে দেখানো হয় ইয়াহিয়াকে; যা প্রকৃত অর্থে পুরো হানাদার বাহিনীর নগ্ন চরিত্রের পরিচয় বাহক। সেই চিত্রটি দিয়ে পোস্টার ছাপিয়ে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

এই পোস্টার চিত্রটি পাকিস্তানি বর্বর সেনাবাহিনীর এবং তাদের এ দেশীয় দালালদের বিরুদ্ধে অর্থাৎ রাজাকারদের বিরুদ্ধে জনগণের মধ্যে ঘৃণা ও বিদ্রোহের উদ্রেক বাড়িয়ে দেয় বহুগুণে। এ ধরনের আরও অনেক পোস্টার তিনি এঁকেছিলেন। তার এমন একটা পোস্টারের উপরিভাগে স্লোগান লেখা রয়েছে - ‘রক্তের ঋণ রক্তে শুধবো, দেশকে এবার মুক্ত করবো’।

এছাড়া ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’, ‘রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেবো’, ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো’, ‘মুক্তিবাহিনী আপনার পাশেই আছে’ - বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও প্রচার দপ্তর থেকে প্রচার করা হয়। এগুলো প্রচণ্ডভাবে নাড়া দেয় বীর বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাদের।

বরেণ্য চিত্রশিল্পী আমিনুল ইসলাম মুক্তিযুদ্ধের অগণিত শহীদ নর-নারীর নির্মম নারকীয় হত্যাকাণ্ড নিয়ে ‘গণহত্যা’ শিরোনামে একটি বড় তৈলচিত্র নির্মাণ করেন। যাতে দেখা যায় অগণিত নর-নারীর কঙ্কাল স্তূপকৃত হয়ে আছে। উপরের দিকে বাংলার সবুজ শ্যামল পটভূমি দেখে মনে হয় শহীদদের স্মরণে বাংলাদেশ বিলাপ করছে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন অপেক্ষাকৃত তরুণ শিল্পী রফিকুন নবী ঢাকায় অবরুদ্ধ ছিলেন। যুদ্ধের ৯ মাস আতঙ্ক ও উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়ে বিজয়ের আকাক্সক্ষা করেছেন প্রতিটি মুহূর্তে।

এ ভাবনা থেকেই আঁকেন ‘বিজয়’ নামের চিত্রটি। ১৯৭১ সালের আগস্টে এই চিত্রটির কাজ শুরু করেন আর শেষ করেন ১৬ ডিসেম্বরে। এই ছবিটিতে বিজয়ের মাহাত্ম্য বোঝাতে প্রতীক হিসেবে হাতির ফিগার ব্যবহার করেন। চিত্রকলা যে প্রতিবাদের অনেক বড় হাতিয়ার হতে পারে এবং অবদান রাখতে পারে ‘বিজয়’ তারই প্রমাণ।

মুক্তিযুদ্ধে পটুয়া কামরুল হাসান, শিল্পী দেবদাস চক্রবর্তী, নিতুন কুণ্ডু ও প্রাণেশ মণ্ডলের করা পোস্টারগুলোর মধ্যে ‘সদা জাগ্রত বাংলার মুক্তিবাহিনী’, ‘বাংলার হিন্দু, বাংলার খ্রিস্টান, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার মুসলমান, আমরা সবাই বাঙালি’, ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম’, ‘একেকটি বাংলা অক্ষর একেকটি বাঙালির জীবন’, ‘রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেবো’ উল্লেখযোগ্য।

মুক্তিযুদ্ধকালীন মানচিত্র সমেত যে পতাকা, তার ডিজাইনার ছিলেন স্বভাবশিল্পী শিবনারায়ণ দাস। পরবর্তীতে যার চূড়ান্ত নকশা করেন শিল্পী কামরুল হাসান। মুক্তিযুদ্ধে শিল্পী স্বপন চৌধুরী একদল শিল্পীকে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ক্যাম্পে ও শরণার্থী শিবিরে গেয়ে শোনাতেন চেতনা জাগানিয়া সব গান। লেভিলেয়ারের সেসব দুর্লভ ফুটেজ দিয়ে তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদ নির্মাণ করেন মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র ‘মুক্তির গান’।

আমরা বিভিন্ন দেশের সংগ্রামে সেসব দেশের শিল্পী-লেখকদের ভূমিকার কথা বলি। লেখক-শিল্পীদের দায়বদ্ধতার কথা বলি। শুধু নিজেদের দেশের খবর রাখি না বা রাখতে চাই না। মুক্তিযুদ্ধে কেন, তেভাগা আন্দোলনে সোমনাথ হোড়ের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তার কাজ দেখলে সেটা পরিষ্কার হয়। মুক্তিযুদ্ধে রাজনীতি সচেতন শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী তার ক্যানভাসে তুলে এনেছেন কানসাটের প্রতিবাদী আন্দোলনকেও। শুধু তাই নয়, দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মম গণহত্যা, অত্যাচার তুলে ধরে চিন্তামণি কর ও কামরুল হাসানের নেতৃত্বে কলকাতার বাংলাদেশ সহায়ক শিল্পী-সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী সহায়ক সমিতির সহায়তায় ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ বিড়লা একাডেমিতে চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করেন। উদ্বোধন করেন প্রখ্যাত ভাস্কর শ্রী দেবীপ্রসাদ রায় চৌধুরী।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধ গৌরবময় ইতিহাসের স্মারক নির্মাণ করেছেন আমাদের দেশের দেশপ্রেমিক শিল্পীরা। মুক্তিযুদ্ধে একজন সশস্ত্র যোদ্ধার কাজ তারা করেছেন তুলি-কলম-রঙের বর্ণিল আঁচড় দিয়ে। মাতৃভূমির প্রতি, দেশের মানুষের প্রতি যে দায় তা তারা পালন করেছেন সর্বাত্মকভাবে। তাদের এই দায়বদ্ধতার ইতিহাস সঠিকভাবে সংরক্ষণ করলে এই প্রজন্ম জানবে শিল্পীর স্বাধীনচেতা স্বভাব ও মাটি মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা, যার মধ্যে নিহিত রয়েছে শিল্পের রাজনীতি। শিল্পকলার বিকাশে শিল্পীর দায়বদ্ধতার পাটাতনকে পোক্ত করার পর বিকল্প নেই।

লেখক : প্রবন্ধকার

 

ভোরের আকাশ/রন