logo
আপডেট : ২১ ডিসেম্বর, ২০২৪ ০৯:৫৮
মন্ত্রীর পিএস-এপিএস দুদকের নজরে
শিপংকর শীল

মন্ত্রীর পিএস-এপিএস দুদকের নজরে

এবার আওয়ামী লীগের চার মেয়াদের মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীদের ব্যক্তিগত সচিব (পিএস) ও সহকারী ব্যক্তিগত সচিবদের (এপিএস) ওপর নজর দিয়েছে দুর্র্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ইতোমধ্যে দায়ের হয়েছে দশটি মামলা। অভিযোগ রয়েছে, ক্ষমতার খুব কাছে থাকায় মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের পিএস-এপিএসরা কোটি কোটি টাকা বানাতে পেরেছেন এবং সেগুলো ব্যবহার করে বিলাসবহুল গাড়ি-বাড়ি করেছেন। নামে-বেনামে তারা হয়েছেন অঢেল সম্পত্তির মালিক। তাদের প্রায় অধিকাংশই এখনও প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে বহাল তবিয়তে আছেন।

জানা গেছে, একজন মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রীর ফোন কল ধরা, মিটিংয়ের সময়সূচির হিসাব রাখা কতটা লাভজনক হতে পারে তা এই পিএস-এপিএসরা আওয়ামী লীগ আমলের টানা সাড়ে ১৫ বছর ধরে উপভোগ করেছেন। কাগজ-কলমের হিসাব-কিতাবই তাদের বিলাসবহুল জীবনের যাত্রা তৈরি করে দিয়েছে। টেন্ডার কারসাজি, কমিশন এবং চাকরিতে পদোন্নতি বা বদলির মতো কাজে কাউকে সহযোগিতার মাধ্যমে তারা পকেটস্থ করেছেন কোটি টাকা। আর এসবই করা হয়েছে তাদের বসদের নাম ব্যবহার করে। তাই আওয়ামী লীগের চার মেয়াদে শুধুমাত্র মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও সংসদ সদস্যরাই বিপুল পরিমাণ সম্পদ অর্জন করেননি, তাদের পিএস ও এপিএসরাও বানিয়েছেন কোটি কোটি টাকা।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পিয়ন (সহকারী) জাহাঙ্গীর আলমের কথা কে না জানেন - যিনি ৪০০ কোটি টাকার মালিক বনেছেন। এ তথ্য হাসিনা নিজেই এক সংবাদ সম্মেলনে দিয়েছেন।

৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দুর্নীতি দমন কমিশন সাবেক ক্ষমতাসীনদের ব্যাপক দুর্নীতির বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে। দুদক ইতোমধ্যে অন্তত ২৫ সাবেক মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীর বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে। শুধু তারা নন, দুদকের নজর তাদের পিএস-এপিএসদের উপরও ছিল। কারণ, তারা ক্ষমতাসীনদের কাছে থাকাকে শোষণ ও উপার্জনের হাতিয়ার বানিয়ে নিয়েছিলেন।

এমন অন্তত ১০ সচিব দুদকের তদন্তাধীন রয়েছে। তারা এখন তাদের সন্দেহজনক বিলাসী জীবনযাপনের বিষয়ে প্রশ্নের মুখে।

তাদের মধ্যে রয়েছেন- সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক এপিএস হাফিজুর রহমান লিকু, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাবেক পিএস ড. হারুন অর রশিদ বিশ্বাস ও তার এপিএস মনির হোসেন, সাবেক শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মুন্নুজান সুফিয়ানের সাবেক এপিএস মো. শাহাবুদ্দিন, সাবেক নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর সাবেক এপিএস এএনএম আহমদুল বাশার, সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদের সাবেক এপিএস মিজানুর রহমান, সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের এপিএস মীর মোশাররফ হোসেন, সাবেক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রীর ড. এনামুর রহমানের এপিএস শামীম আহমেদ, সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানের এপিএস হাসনাত হোসেন ও সাবেক পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর সাবেক এপিএস এমদাদুল হক।

অবৈধভাবে প্রায় ৫০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাবেক এপিএস মনির হোসেনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক।

লিকুর বিরুদ্ধে দুদকে দাখিল করা অভিযোগে বলা হয়েছে, তিনি তার স্ত্রীর নামে রামদিয়া কাশিয়ানীতে মেসার্স রাফি এগ্রো অ্যান্ড ফিশারিজের নামে কয়েকশ বিঘা জমি কিনেছেন। এ ছাড়া, তিনি মোহাম্মদপুরের মধু সিটিতে একটি ফ্ল্যাট কিনেছেন এবং উত্তরায় একটি সরকারি প্লট অবৈধভাবে নিয়েছেন।

অভিযোগে আরও বলা হয়েছে, লিকু গোপালগঞ্জে ১০ ডিসিমাল জমি কিনেছেন, পৈতৃক জমিতে পাঁচতলা বাড়ি তৈরি করেছেন এবং তার শ্যালকের নামে ছয়তলা ও ১০তলা বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ করেছেন। তিনি কুয়াকাটায় ওশান ব্লু রিসোর্ট এবং তার আত্মীয়দের নামে বিভিন্ন সম্পত্তির মালিক বলে জানা গেছে।

দুদক সূত্রে জানা গেছে, হারুন অর রশিদ বিশ্বাস ও মনির হোসেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের নেতৃত্বে ঘুষ সিন্ডিকেটের মূল হোতা ছিলেন। তারা জেলা পুলিশ সুপার এবং অন্যান্য পদে নিয়োগের জন্য ঘুষ নিয়েছেন বলে জানা গেছে।

এনামুর রহমানের এপিএস শামীম আহমেদের বিরুদ্ধে ময়মনসিংহের ত্রিশালে একটি এগ্রো পার্কসহ বেশ কয়েকটি ব্যবসায়িক উদ্যোগ ও সম্পত্তির মালিক হওয়ার অভিযোগ রয়েছে। তিনি পোড়াবাড়িতে ১০০ বিঘা জমিতে মাছের খামার ও ‘বেলা’ নামে একটি ইনস্টিটিউট এবং সাভারে দুটি ফ্ল্যাট ও গুলশানের নাভানা টাওয়ারে একটি অফিসের মালিক বলে অভিযোগ রয়েছে।

খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর সাবেক এপিএস বাশার ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর বিআইডব্লিউটিএতে একচেটিয়া আধিপত্য তৈরি করেছিলেন বলে জানা গেছে।

এক সময়ে মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীরা পছন্দ করে পিএস নিতে পারতেন। ২০১৪ থেকে ২০১৮ মেয়াদে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের পিএস-এপিএসদের অনেকের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। এর জেরে ২০১৯ সালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরামর্শে ব্যাচভিত্তিক বিসিএস কর্মকর্তাদের তালিকা তৈরি করে মন্ত্রিসভার সদস্যদের পিএস নিয়োগ দেয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এবারও এই প্রক্রিয়ায় নিয়োগ হবে বলে জানানো হয়েছে।

পিএস হতে আগ্রহী একাধিক উপসচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের পিস-এপিএস হলে কিছু সুযোগ-সুবিধা রয়েছে; যেমন - নিয়মিত পদোন্নতি, পদায়নে অগ্রাধিকার থাকে।

রাজনৈতিক সান্নিধ্যে প্রাইজ পোস্টিং বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ড. মোসলেহ উদ্দীন। তিনি বলেন, একটা সময়ে রাজনৈতিক মন্ত্রীদের পিএস হওয়ার প্রতি অনাগ্রহ ছিল। কারণ ওই কর্মকর্তাদের বাকি চাকরিজীবন বঞ্চনায় পার করতে হয়; কিন্তু রাজনৈতিক মন্ত্রীদের একান্ত সচিব থাকার সুবাদে পদোন্নতি ও পদায়নে বিশেষ সুবিধা মেলে। যে কারণে কর্মকর্তারা এখন পিএস হওয়ার জন্য তদবির করেন।

আ.লীগ আমলের পিএস-এপিএস: সর্বশেষ ক্ষমতায় আসার পর গত ১৫ ও ১৬ জানুয়ারি বেশ কয়েকজন পিএস ও এপিএসদের নিয়োগ প্রজ্ঞাপন জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের পিএস মোহাম্মদ সানোয়ার হোসেন এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের পিএস মো. আলমগীর হোসেনকে একই পদে পুনরায় নিয়োগ দেওয়া হয়। এছাড়া তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের (আইসিটি) প্রতিমন্ত্রী থেকে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাওয়া প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের পিএস (আইসিটি বিভাগে থাকাকালীন) মো. মুশফিকুর রহমান, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর পিএস মো. রোকন-উল-হাসান এবং নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর পিএস হিসেবে চলতি দায়িত্ব পালন করা নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব মোহা. আমিনুর রহমানকে আগের পদেই নিয়োগ দেওয়া হয়।

অন্যদিকে বাকি মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীরা নতুন পিএস পান। এর মধ্যে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব মোহাম্মদ আবদুল হামিদ মিয়াকে পরিকল্পনামন্ত্রী আব্দুস সালামের পিএস, জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের উপ-সচিব এ এস এম হুমায়ুন কবীরকে গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরীর পিএস, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের উপসচিব কমল কুমার ঘোষকে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেনের পিএস, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের উপসচিবকে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরীর পিএস এবং স্থানীয় সরকার বিভাগের উপসচিব মো. শাহগীর আলমকে শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীর পিএস নিয়োগ দেওয়া হয়।

একইভাবে তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাতের পিএস হিসেবে নিয়োগ পান জনপ্রশাসনের উপসচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের উপসচিব মো. মোস্তাফিজার রহমানকে মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী সিমিন হোসেন রিমির পিএস পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সংযুক্ত উপসচিব মোহাম্মদ আল আমীনকে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভীর পিএস নিয়োগ দেওয়া হয়।

অপর এক প্রজ্ঞাপনে পাঁচ মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) নিয়োগ দেয় সরকার। এর মধ্যে অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর এপিএস হিসেবে নিয়োগ পান দিনাজপুরের খানসামা উপজেলার কাউয়াশাহপাড়া গ্রামের শাহ সালাউদ্দীন। অর্থমন্ত্রীর বাড়িও দিনাজপুরে। ভোলা চরফ্যাশনের মিয়াজানপুর গ্রামের মনির হোসেনকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের এপিএস নিয়োগ দেওয়া হয়। যুব ও ক্রীড়ামন্ত্রী নাজমুল হাসান পাপনের এপিএস নিয়োগ পেয়েছেন কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার টামনী নয়াপাড়া গ্রামের মোহাম্মদ আলমগীর। মন্ত্রীর বাড়িও কিশোরগঞ্জে। নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর এপিএস নিয়োগ পেয়েছেন দিনাজপুরের বোচাগঞ্জ উপজেলার টেনা গ্রামের আ ন ম আহমাদুল বাশার। প্রতিমন্ত্রীর বাড়িও বোচাগঞ্জ। এ ছাড়া মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী সিমিন হোসেন রিমির এপিএস নিয়োগ পান রাজশাহীর রাণীবাজারের পারভেজ আহমেদ।

প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়, মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা যত দিন এ পদ অলংকৃত করবেন অথবা তাদের জন্য পদায়ন করা একান্ত সচিবদের এ পদে বহাল রাখার অভিপ্রায় পোষণ করবেন, তত দিন এ নিয়োগ আদেশ কার্যকর থাকবে। একইভাবে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা যত দিন এ পদ অলংকৃত করবেন অথবা তাদের জন্য পদায়ন করা এপিএসকে এ পদে বহাল রাখার অভিপ্রায় পোষণ করবেন, তত দিন এ নিয়োগ আদেশ কার্যকর থাকবে।

 

ভোরের আকাশ/রন