সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে যথাযথ ও বিশেষজ্ঞ সংস্থার মাধ্যমে নতুন করে তদন্ত করা প্রয়োজন বলে অভিমত দিয়েছেন হাইকোর্ট। এজন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া উচিত বলেছেন আদালত। হাইকোর্ট বলেছেন, আমাদের দেশের ইতিহাসে এটা একটা জঘন্য মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড। যেখানে তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেত্রী আইভি রহমানসহ বহু মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। এইসব নিহতদের আত্মার ন্যায়বিচারের জন্য এই হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া প্রয়োজন, যা আজ পর্যন্ত এই ঘটনায় সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। আদালত বলেন, আমরা মনে করি, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় একটি সঠিক ও বিশেষজ্ঞ তদন্ত সংস্থার মাধ্যমে নতুন করে তদন্ত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য মামলার নথি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো উচিত। আদালত বলেন, উল্লিখিত পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
বহুল আলোচিত ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় (ডেথ রেফারেন্স ও আসামিদের আপিল) পূর্ণাঙ্গ রায়ে এই অভিমত দিয়েছেন হাইকোর্ট। গত পহেলা ডিসেম্বর বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি সৈয়দ এনায়েত হোসেনের হাইকোর্ট বেঞ্চ নিম্ন আদালতের রায় বেআইনি, কর্তৃত্ব বহির্ভূত ও বাতিল বলে রায় দেন। ফলে এ মামলায় নিম্ন আদালতের রায়ে সাজাপ্রাপ্ত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ও সাবেক উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টুসহ সকল আসমি খালাস পেয়েছেন। তবে গত ১৯ ডিসেম্বর ৭৯ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়েছে। এই রায় ওইদিনই সুপ্রিম কোর্টের নিজস্ব ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে।
গত পহেলা ডিসেম্বর দুপুরে এক জনাকীর্ণ আদালতে রায় ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। ওইদিন আদালত বলেন, তখনকার বিরোধীদলীয় নেত্রীর সমাবেশে গ্রেনেড হামলা, আইভি রহমানসহ ২৪ জনের মৃত্যু ট্রাজিক ঘটনা। কিন্তু অধিকতর তদন্ত, মুফতি আব্দুল হান্নান মুন্সীর দ্বিতীয়দফার জবানবন্দি, অধিকতর তদন্ত শেষে দ্বিতীয়দফা অভিযোগপত্র দাখিলের প্রক্রিয়াসহ নিম্ন আদালতের বিচারিক প্রক্রিয়ার সবকিছুই ছিলো বেআইনি।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ সব আসামিকে খালাস দিয়ে হাইকোর্ট রায় ঘোষণার পর ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কেউ কেউ লিখেন, ওইদিন কোনো হত্যাকাণ্ডই ঘটেনি। কেউ প্রশ্ন করেন, তাহলে কি ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় নিহতদের পরিবার বিচার পাবে না? তবে হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায়ে নতুন করে যথাযথ তদন্তের কথা বলায় জঘন্যতম এই হত্যাকাণ্ডের বিচারের পথ খুললো।
হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায়ে বলা হয়েছে, এই মামলায় আমরা লক্ষ্য করেছি যে একজন দায়রা জজ নিজের আদেশের মাধ্যমে সম্পূরক অভিযোগপত্র আমলে নিয়েছেন এবং তার উপর ভিত্তি করে বিচার করেছেন। ফলে এমন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অনুষ্ঠিত বিচারটি দৃশ্যত অবৈধ এবং এখতিয়ার বহির্ভূত। এমন বিচারের মাধ্যমে বিচারক বিধিবদ্ধ বিচার ব্যবস্থা কলুষিত করেছেন। রায়ে বলা হয়, প্রশ্ন হলো প্রথম চার্জশিট আমলে নিয়ে অভিযোগ গঠনের পর ৬১ জন জনের সাক্ষ্য নেওয়া হলো। এরপর নতুন করে তদন্তের সুযোগ আছে কিনা? উত্তর হলো মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এজন্য আদালতে আবেদন দিতে পারেন। কিন্তু এক্ষেত্রে তার ব্যপ্তয় ঘটেছে। তদন্ত কর্মকর্তা অধিকতর তদন্তের জন্য কোনো আবেদন দেননি। কিন্তু প্রসিকিউশন (পিপি) আবেদন দিয়েছেন যা বেআইনি। এই বেআইনি আবেদনের ভিত্তিতে অধিকতর তদন্তের আদেশ দেওয়া বেআইনি হয়েছে। এই বেআইনি আদেশের পর অধিকতর তদন্ত শেষে আগের অনেক কিছু বাদ দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন করে দ্বিতীয়দফা অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে, যা বেআইনি।
রায়ে বলা হয়েছে, এই মামলায় নিরাপদে বলা যেতে পারে যেকোনো আইনগত বা সমর্থনযোগ্য প্রমাণ ছাড়াই নিছক অনুমানের ভিত্তিতে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল। এখন পর্যন্ত আইনি যুক্তির বিষয়ে আমাদের সর্বোচ্চ আদালতের নিষ্পত্তি হয়েছে এমন অনেক সিদ্ধান্ত রয়েছে যে একবার অভিযোগপত্র গ্রহণ করার পর মামলাটি পুনরায় খোলা যাবে না বা অধিকতর তদন্তের জন্য পাঠানো যাবে না বা দ্বিতীয়বার তদন্ত করা যাবে না। তবে যদি বাদী বা তদন্তকারী কর্মকর্তা দেখাতে পারেন যে, ঘটনায় নতুন ডকুমেন্ট পাওয়া গেছে এবং উল্লিখিত ডকুমেন্টের ভিত্তিতে কথিত ঘটনার ওপর তদন্ত হতে পারে। তাহলেই কেবল নতুন ডকুমেন্টের ভিত্তিতে একটি সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল করতে পারেন। কিন্তু আদালত প্রসিকিউশনের আবেদনে মামলাটি পুনঃতদন্তের জন্য অনুমতি দেওয়া একেবারেই বেআইনি। এই বেআইনি আদেশের ফলে দাখিল করা অবৈধ অভিযোগপত্রের ওপর ভিত্তি করে বিচার কাজ পরিচালনা করা বেআইনি। আইনগতভাবে যেমন আমরা লক্ষ্য করেছি যে বিচারটি যেমন এখতিয়ার বহির্ভূত ও বেআইনিভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তেমনি দ্বিতীয় তদন্তটি সঠিকভাবে সম্পন্ন হয়নি। ঠিক তেমনি মামলার যথাযথ জ্ঞান না রেখেই বিচার অনুষ্ঠিত হয়েছিল। একারণেই এই মামলায় অভিযুক্ত করা আসামিদের দোষী সাব্যস্ত করে সাজা দেওয়া বেআইনি।
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনায় পৃথক দুই মামলায় (হত্যা ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলা) আসামিদের ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ডাদেশ অনুমোদন), আপিল ও জেল আপিলের ওপর শুনানি শেষে এই রায় দেওয়া হয়। হাইকোর্ট প্রধানত তিন কারণে নিম্ন আদালতের রায় বেআইনি ও বাতিল বলে ঘোষণা করেছেন। হাইকোর্ট রায়ে বলেন, একই মামলায় একজন আসামি দুইবার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে পারেন কিনা এবং সেটি আইনগতভাবে বৈধ ও গ্রহণযোগ্য কিনা? উত্তর হচ্ছেÑ একজন আসামির ১৬৪ ধারায় দেওয়া জবানবন্দির ভিত্তিতে একবার চার্জশিট দাখিলের পর তা আমলে নিয়ে বিচার কাজ শুরু হলে একই আসামির দ্বিতীয়দফা ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি নেওয়া বেআইনি। এই মামলায় সেই বেআইনিভাবেই মুফতি আব্দুল হান্নান মুন্সীর জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে। এই আসামি আদালতে লিখিতভাবে জানিয়েছেন, স্বেচ্ছায় স্বীকারোক্তি দেননি। তাকে নির্যাতন করে ঘটনার সঙ্গে নিজেকে ও অন্যদের জড়িয়ে জবানবন্দি দিতে বাধ্য করা হয়েছে। যা আইনের দৃষ্টিতে এটা গ্রহণযোগ্য নয়।
রায়ে বলা হয়, আইন অনুযায়ী ১৬৪ ধারায় দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি হতে হবে স্বেচ্ছামূলক ও সত্য। কিন্তু এই মামলায় যারা ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন তারা সকলেই বলেছেন তাদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে জবানবন্দি দিতে বাধ্য করা হয়েছে। তারা বলেছেন, টাস্কফোর্স ইনটেলিজেন্স (টিএফআই) সেলে নিয়ে তাদের সেখানে অসংখ্য দিন আটকে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তাদের ওপর নির্যাতন করা হয়েছে। যা বেআইনি। তাছাড়া আইনের কোথাও টিএফআই সেলের অস্তিত্ব নেই। এই টিএফআই সেল গঠনের আইনগত কোনো ভিত্তি নেই।
রায়ে বলা হয়, ফৌজদারি মামলায় সাজা দিতে হয় তথ্য-প্রমাণ, অকাট্য সাক্ষ্যের ভিত্তিতে। আলোচিত এই মামলায় যে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে তা ট্র্যাজেডিক (বেদনাদায়ক)। কিন্তু ওই ঘটনায় কে বা কারা গ্রেনেড নিক্ষেপ করেছে তার কোনো প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী নেই। তদন্ত কর্মকর্তা গ্রেনেড নিক্ষেপকারী আসামিকেও খুঁজে পাননি। এছাড়া এই মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে যে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনা হয়েছে এবং সাজা দেওয়া হয়েছে, তাও আইনগতভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা মামলা ও ব্যবসায়ী মোবাইল কাদের হত্যা মামলার ষড়যন্ত্র প্রমাণের বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ বলেছেন, সাক্ষ্য আইনের ১০ ধারায় আসামিদের ষড়যন্ত্রের অভিযোগে সাজা দিতে হলে যথাযথ নথি (ডকুমেন্ট), মৌখিক বা পারিপার্শিক সাক্ষ্য থাকতে হবে। কিন্তু আলোচিত এই মামলায় তা অনুপস্থিত। ফলে এই মামলায় ১০ ধারায় সাজা দেওয়া যথাযথ হয়নি।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় হতাহতের ঘটনায় দুইদিন পর ২৩ আগস্ট মতিঝিল থানায় পৃথক চারটি মামলা হয়। আওয়ামী লীগের সে সময়কার সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিল, সাবের হোসেন চৌধুরী ও বাহাউদ্দিন নাসিম পৃথক তিনটি মামলা করেন। আর মতিঝিল থানার সে সময়কার এসআই শরিফ ফারুক আহমেদ আরেকটি মামলা করেন। তদন্তকালে ২০০৭ সালে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন মুফতি আব্দুল হান্নান মুন্সী। ১৬১ ধারায় তদন্ত কর্মকর্তার কাছে জবানবন্দি দেন শেখ হাসিনা। সেখানে তিনি তারেক রহমানকে জড়িয়ে কোনো বক্তব্য দেননি। এই চার মামলায় একসঙ্গে তদন্ত শেষে ২০০৮ সালের ৯ জুন দণ্ডবিধি ও বিস্ফোরক আইনে দুটি ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। এভাবেই দাঁড়িয়ে যায় পৃথক দুই মামলা। উভয় মামলায় আসামি করা হয় ২৮ জন করে। এই অভিযোগপত্রে তারেক রহমান বা লুৎফুজ্জামান বাবর, হারিছ চৌধুরী, মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদসহ বেশ কয়েকজন আসামি ছিলেন না। এই অভিযোগপত্র ম্যাজিস্ট্রেট আদালত আমলে নিয়ে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়াসম্পন্ন শেষে বিচারের জন্য দায়রা জজ আদালতে পাঠিয়ে দেয়। পরবর্তীতে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে মামলার বিচার কাজ শুরু হয়। রাষ্ট্রপক্ষে ৬১ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ সম্পন্ন হয়। এমন অবস্থায় ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হন শেখ হাসিনার সরকার। এর কয়েক মাস পর একইবছরের ২৫ জুন অধিকতর তদন্ত চেয়ে বিচারিক আদালতে আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী (পিপি)। আইন অনুযায়ী অধিকতর তদন্তের আবেদন করার দায়িত্ব তদন্ত কর্মকর্তার। পিপির আবেদনে একই বছরের ৩ আগস্ট এক আদেশে অধিকতর তদন্তের অনুমতি দেয় আদালত। এরপর ১২ আগস্ট তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয় আব্দুল কাহহার আকন্দকে। কাহহার আকন্দ দায়িত্ব পেয়ে মুফতি হান্নানকে ফের রিমান্ডে নেয়। এর কয়েকদিন ১৬৪ ধারায় দ্বিতীয়দফা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন মুফতি হান্নান। এবার তার জবানবন্দিতে তারেক রহমান, বাবরসহ আরো অনেকের নাম জড়ানো হয়। পরবর্তীতে ২০১১ সালের ২ জুলাই তারেক রহমান, বাবরসহ ৩০ জনকে আসামি করে সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল করা হয় বিচারিক আদালতে। ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল না করে সরাসরি বিচারিক (দায়রা জজ) আদালতে দাখিল করা হয়। বিচারিক আদালত এই অভিযোগপত্র ২০১১ সালের ২৫ আগস্ট আমলে নিয়ে আসামিদের বিচার শুরু করেন। এ পর্যায়ে মুফতি হান্নান তার ১৬৪ ধারার জবানবন্দি প্রত্যাহারের জন্য লিখিত আবেদন দেন। তিনি আবেদনের বলেন, তাকে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন চালিয়ে এ ধরনের জবানবন্দি দিতে বাধ্য করা হয়েছে। কিন্তু বিচারক শাহেদ নূও উদ্দিন (পরবর্তীতে হাইকোর্টের বিচারপতি) ওই আবেদন খারিজ করে বিচার কাজ অব্যাহত রাখেন। বিচার কালে আদালত মোট ২২৫ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ, কারাবন্দি আসামিপক্ষের আইনজীবী ও রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর আলোচিত এ মামলায় রায় দেন। রায়ে হত্যা মামলায় বাবরসহ ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড, তারেক রহমানসহ ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও ১১ জন আসামিকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলায়ও অভিন্ন আসামিদের অভিন্ন সাজা দেওয়া হয়। এই রায়ের একবছর পর ২০১৯ সালের ২১ অক্টোবর হাইকোর্টের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় শাহেদ নূর উদ্দিনকে। আর তদন্ত কর্মকর্তা আব্দুল কাহহার আকন্দকে কিশোরগঞ্জ থেকে সংসদ সদস্য পদে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের টিকিট পান।
এই মামলায় নিম্ন আদালতের রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের সাজা অনুমোদনের জন্য ২০১৮ সালের ২৭ নভেম্বর হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্স পাঠানো হয়। নিয়ম অনুযায়ী কোনো ফৌজদারি মামলায় বিচারিক আদালতের রায়ে কোনো আসামির মৃত্যুদণ্ড হলে তা কার্যকরে হাইকোর্টের অনুমোদন লাগে। এটি ডেথ রেফারেন্স মামলা হিসেবে পরিচিত। পাশাপাশি দণ্ডাদেশের রায়ের বিরুদ্ধে আসামিদের জেল আপিল, নিয়মিত আপিল ও বিবিধ আবেদন করার সুযোগ রয়েছে। ডেথ রেফারেন্স এবং এসব আপিল ও আবেদনের ওপর সাধারণত একসঙ্গে শুনানি হয়ে থাকে। আলোচিত ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আসামিপক্ষে আপিল করার পর পেপারবুক তৈরির পর ২০১৯ সালের ১৬ আগস্ট হাইকোর্টে পাঠানো হয়। দুটি মামলায় প্রায় ২২ হাজার পৃষ্ঠার পেপারবুক হাতে পাবার পর মামলাটি (ডেথ রেফারেন্স ও আসামিদের আপিল) হাইকোর্টে শুনানির জন্য প্রস্তুত করা হয়। পলাতক আসামিদের বিরুদ্ধে স্টেট ডিফেন্স আইনজীবীও নিয়োগ শেষে বেশ কয়েকবছর এই মামলা শুনানির জন্য অপেক্ষায় ছিল। বেশ কয়েক বছর এমন অবস্থায় থাকার পর সম্প্রতি প্রধান বিচারপতি বেঞ্চ নির্ধারণ করে দেন। এরপর গত ৩১ অক্টোবর শুনানি শুরু হয়ে ২১ নভেম্বর শুনানি সম্পন্ন হয়। সেদিন আদালত মামলা দুটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখেন। এর ধারাবাহিকতায় গত পহেলা ডিসেম্বর রায় ঘোষণা করা হয়।
রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনায় সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের সহধর্মিণী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত হয়। আর তখনকার বিরোদীদলীয় নেতা শেখ হাসিনাসহ অনেকে আহত হন। এ ঘটনার পর হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি মো. জয়নুল আবেদীনের নেতৃত্বে একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠিত হয়। এই হামলার ঘটনায় ওই কমিশন প্রতিবেশী একটি দেশের গোয়েন্দা সদস্যদের জড়িত থাকার তথ্য তুলে ধরেন। একারণে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ওই বিচারপতির বিরুদ্ধে একাধিক মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তবে এই মামলায় জজ মিয়া নামক এক আসামির ১৬৪ ধারায় দেওয়া জবানবন্দি নিয়ে পরে ব্যাপক সমালোচনা হয়। বিএনপি সরকারের বিদায়ের পর সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে ‘জজ মিয়া নাটক’ নামে ব্যাপক সমালোচনা হয়। পরে ওই জজ মিয়া অভিযোগ করেন তার ওপর অত্যাচার চালিয়ে পুলিশ জবানবন্দি আদায় করেছে। একারণে আওয়ামী লীগ সরকার ওই জজ মিয়াকে ব্যাপকভাবে আর্থিক সহায়তা দেয়।
মামলায় প্রথম অভিযোগপত্রে বলা হয়, শেখ হাসিনাকে হত্যা করে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করতে ওই হামলা চালিয়েছিল জঙ্গিরা। পরে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর অধিকতর তদন্ত হয়। আওয়ামী লীগ সরকার মুফতি আব্দুল হান্নানের ওপর নির্যাতন চালিয়ে তার কাছ থেকে কথিত জবানবন্দি আদায় করে তার ভিত্তিতে তারেক রহমান, বাবরসহ ৩০ জনকে আসামি করে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেয়। এরপর বিচার শেষে ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর রায় দেয় ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১। রায়ে হত্যা মামলায় সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক শিক্ষা উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর (খালেদা জিয়া) রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী (বর্তমানে প্রয়াত) ও সাবেক এমপি কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদসহ ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ১১ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। আর বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলায় অভিন্ন আসামিদের অভিন্ন সাজা দেওয়া হয়।
ভোরের আকাশ/রন