গত সাড়ে ১৫ বছরে আওয়ামী লীগের শাসনামলে সব চেয়ে আলোচিত, সমালোচিত ও চর্চিত বিষয় ছিল গুম। ভিন্ন মতের অনেক মানুষকে সরকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর দ্বারা গোপন ঘরে আটকে রাখতেন। সেখানে চালানো হতো ভয়াবহ নির্যাতন। মূলত ওই ঘরকেই আয়না ঘর বলা হয়ে থাকে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সেখান থেকে অনেকে ফিরে এসেছেন। তারা ভয়াবহ নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছেন।
যেখানে গুমের শিকার ব্যক্তিদের অনির্দিষ্টকালের জন্য আটকে রাখা হতো। কেউ জানতো না তাদের খবর। নিখোঁজ ব্যক্তিদের অনুসন্ধানে ব্যর্থ হয়ে পরিবার-পরিজন ধরেই নিত ওই ব্যক্তি আর বেঁচে নেই। কিন্তু কয়েক মাস বা বছর এমন কি আট বছর পরও এসব বন্দিশালা থেকে ফিরে আসার নজির আছে। শেখ হাসিনা দেশত্যাগের পর এমন অনেকে এসব বন্দিশালা থেকে ফিরে এসে রহস্যময় আয়নাঘরের বর্ণনা দিয়েছেন। তারপর এতদিন অজানা ছিল এসব বন্দিশালাগুলো কোথায়? এসব বন্দিশালার সন্ধানে গঠিত হয়েছিল গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিশন। সংবাদমাধ্যম বলছে, গুমের শিকার ব্যক্তিদের আটকে রাখা হতো, এমন আটটির বেশি গোপন বন্দিশালা শনাক্ত করেছে গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশন।
গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের ভাষ্যমতে, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর (ডিজিএফআই), র্যাব ও পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের মতো সংস্থাগুলো এসব গোপন বন্দিশালা পরিচালনা করত। দেশজুড়ে এসব গোপন বন্দিশালায় গুমের শিকার ব্যক্তিদের আটকে রাখা হতো। এর পাশাপাশি গুমের শিকার ব্যক্তিদের কাউকে কাউকে সাধারণ বন্দিদের সঙ্গেও রাখা হতো।
কমিশন গত শনিবার বিকেলে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার কাছে ‘আনফোল্ডিং দ্য ট্রুথ’ শিরোনামে প্রতিবেদনটি জমা দেয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, গুমের ঘটনায় কমিশনে এ পর্যন্ত ১ হাজার ৬৭৬টি অভিযোগ জমা পড়েছে। এর মধ্যে ৭৫৮টি অভিযোগ যাচাই-বাছাই করা হয়েছে।
এসব বন্দিশালার কথা শুনে রাশিয়ার গুলাগ বন্দিশালা এবং ন্যাৎসিদের বন্দিশিবিরের কথাই মনে পড়ে। ভিন্ন মতকে দমন করতে এভাবেই ফ্যাসিস্ট সরকারগুলো যুগে যুগে দেশে দেশে বন্দিশালা তৈরি করতো। শেখ হাসিনা সরকার কতটা ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠেছিল বোঝা যায় এসব বন্দিশালার বিবরণ পড়ে। বেঁচে ফেরা গুমের শিকার ব্যক্তিদের বর্ণনা অত্যন্ত রোমহর্ষক, বেদনাদায়ক। দীর্ঘদিন তাদের কারো সঙ্গে কথা বলতে দেওয়া হয়নি। আলো-বাতাস থেকে ছিলেন বঞ্চিত। তারা কোথায় আছেন জানতেন না। এমন কি কোনোদিন তারা বেঁচে ফিরবেন কি না তাও ছিল অজানা। এর মধ্যে চলতো নানারকম শারীরিক নির্যাতন। আর এসব গুমের নির্দেশদাতা স্বয়ং শেখ হাসিনা।
২০০৯ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মদদে নিখোঁজ হন ৪০২ জন মানুষ। এ তথ্যটি প্রকাশ করে ঢাকা ভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন অধিকার। ২০১৪ থেকে জুলাই ২০১৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে ৩৪৪ জন ব্যক্তি গুমের শিকার হয়। তাদের মধ্যে ৪০ জন ব্যক্তিকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়, ৬৬ জনকে সরকারি হেফাজতে গ্রেপ্তার অবস্থায় পাওয়া গেছে এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যমতে ২০৩ জন এখনো গুম রয়েছেন। যারা দীর্ঘদিন গুম থাকার পর ফিরে আসেন, তারা গুমের ব্যাপারে মৌন অবলম্বন করেন। ধারণা করা হয় এসব মানুষদের গুম করে রাখা হয় আয়না ঘরে।
গোপন বন্দিশালা দেখতে তদন্ত কমিশন যেসব দপ্তরে গিয়েছে সেগুলো হলো, ডিজিএফআই, সিটিটিসি, ডিএমপির ডিবির প্রধান কার্যালয়, চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের ডিবি, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন ইউনিট ২, ৪, ৭ ও ১১, র্যাব ২, সিপিসি ৩, র্যাবের সদর দপ্তর, চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার এবং এনএসআইয়ের চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়।
গণঅভ্যুত্থানের পর শেখ হাসিনা পলাতক, গণহত্যার দায়ে তার বিচারের দাবি উঠছে। শেখ হাসিনার নির্দেশে এসব গুম হলেও এসব গুমের সঙ্গে যেসব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জড়িত তাদেরও বিচারের আওতায় আনা উচিত। গুমের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের এমন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রয়োজন, যাতে আর কোনো সরকার এমন দুঃসাহস দেখানোর সাহস না পায়। আমরা চাই এরকম ভয়াবহ গুম সংস্কৃতি বন্দিশালা থেকে বাংলাদেশ চিরতরে মুক্তি পাক।
ভোরের আকাশ/রন