অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস নির্বাচনের ট্রেন ট্র্যাকে তুলে দিয়েছেন এবং ট্রেনটি ২০২৫ সালের ডিসেম্বর অথবা ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে বলে জানিয়েছেন। যে দেশে গত ১৫ বছরে সুষ্ঠু নির্বাচন হয়নি-২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে হয়েছে কারচুপির নির্বাচন - সে দেশে নির্বাচন আয়োজনের সম্ভাব্য সময়ের ঘোষণায় ছয় মাসের পার্থক্য থাকাটা বড় কোনো উদ্বেগের বিষয় হওয়ার কথা না। তবে, দেশের অর্থনীতি, বিনিয়োগে স্থবিরতা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং জনগণের নির্বাচিত সরকার ও সংসদ দেখার আগ্রহসহ সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় আমরা মনে করি, ড. ইউনূস ও তার অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত প্রস্তাবিত দুটি সময়ের মধ্যে প্রথমটি বেছে নেওয়া।
এর কারণ হচ্ছে - অন্তর্বর্তী সরকারের মূল লক্ষ্য হলো সংস্কার ও নির্বাচনসম্পন্ন করা। সংস্কার জরুরি। কারণ, আমরা অতীতের সেই ধারায় ফিরে যেতে চাই না, যেখানে নির্বাচনের পর বিজয়ী দল যা ইচ্ছা তাই করার সুযোগ পাবে, বিশেষ করে যদি দলটি দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। আমাদের সংবিধান সংশোধন করতে হবে, যাতে নির্বাহী, আইনসভা ও বিচার বিভাগের ভারসাম্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয়; প্রধানমন্ত্রীর একতরফা ক্ষমতা কমানো যায়; বিচার বিভাগকে কার্যকরভাবে স্বাধীন করা যায়; মানবাধিকার কমিশন, তথ্য কমিশন, নির্বাচন কমিশন ও অন্যান্য সংবিধিবদ্ধ সংস্থাগুলোকে স্বাধীন করা যায়; মহা হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়কে স্বায়ত্তশাসিত করা যায় এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা যায়। সেখানে একটি মৌলিক সংস্কার হবে সংসদকে কার্যকর করা এবং নির্বাহী বিভাগকে প্রকৃত অর্থে জবাবদিহিতার আওতায় আনা।
তবে, সংস্কার যত গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরিই হোক না কেন, নির্বাচন আয়োজনেও বেশি দেরি করা যাবে না। সংবিধান মেনে অন্তর্বর্তী সরকারের অস্থায়ী অবস্থা থেকে উত্তরণ করে একটি স্থিতিশীল নির্বাচিত সরকারের দিকে এগিয়ে যেতে হবে; যা নতুন সরকারকে বিশ্বের যেকোনো দেশের গণতান্ত্রিক সরকারের মতো বৈধতা, মর্যাদা ও স্বীকৃতি দেবে। নির্বাচন জরুরি, কারণ এর মাধ্যমে পুরো বিশ্ব আবার বাংলাদেশের ওপর আস্থা রাখতে পারবে এবং বুঝতে পারবে, এ দেশ যেকোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেও গণতন্ত্রের পথে এগিয়ে যেতে পারে। বিশ্বের কাছে এটা প্রমাণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আগামী ১২ মাসের মধ্যে দুটি লক্ষ্যই অর্জন করা সম্ভব।
প্রধান উপদেষ্টা যেমনটি বলেছেন, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছয়টি সংস্কার কমিশন চলতি মাসের শেষ নাগাদ বা সর্বোচ্চ জানুয়ারির মধ্যে তাদের প্রতিবেদন জমা দেবে। আমাদের মতে, কনসেনসাস কমিশন (সিসি) গঠনের বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রস্তাব একটি উদ্ভাবনী উদ্যোগ; যা আমাদের একটি স্থিতিশীল ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাবে। কনসেনসাস কমিশন সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কাজ করবে, যাতে ‘ঐকমত্য’র ভিত্তিতে লক্ষ্য অর্জিত হয় এবং কোনো সুপারিশ অন্তর্বর্তী সরকার অধ্যাদেশের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করবে এবং কোনগুলো নির্বাচিত সরকারের জন্য রেখে যাবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়। সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে ‘ঐকমত্য’ অর্জন একটি বড় রাজনৈতিক লক্ষ্য, যা সর্বশেষ ১৯৯০ সালে এরশাদ সরকারের পতনের পর সর্বদলীয় ঐক্যের মাধ্যমে দেখা গিয়েছিল। যেহেতু প্রধান উপদেষ্টা নিজেই কনসেনসাস কমিশনের চেয়ারম্যান হবেন, আমরা নিশ্চিত যে এর ইতিবাচক ফলাফল অবশ্যই আসবে।
নির্বাচনের সময়সীমার প্রসঙ্গে ফিরে আসলে বলা যায়, ডিসেম্বর বা জানুয়ারিতে সংস্কার কমিশনগুলো প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর কনসেনসাস কমিশন যদি তাদের কাজ শুরু করে, তাহলে অন্তর্বর্তী সরকারের হাতে নির্বাচন আয়োজনের জন্য প্রস্তুতি নিতে প্রায় ১০ মাস সময় থাকবে।
গত মঙ্গলবার প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এএমএম নাসির উদ্দিন বলেছেন, কমিশন দায়িত্ব গ্রহণের দিন থেকেই নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং প্রধান উপদেষ্টার প্রস্তাবিত তারিখ অনুযায়ী নির্বাচন আয়োজনের জন্য তারা পুরোপুরি প্রস্তুত। তিনি আরও বলেছেন, কমিশন আগামী দুই মাসের মধ্যে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করতে পারবে। নির্বাচন কমিশন যদি ভোটার তালিকা হালনাগাদের জন্য বাড়ি-বাড়ি যাওয়ার মতো দীর্ঘ প্রক্রিয়াও অনুসরণ করে, তার জন্যও ছয় থেকে সাত মাসের বেশি সময় লাগবে না। অর্থাৎ, সর্বোচ্চ আগামী বছরের জুলাই বা আগস্টের মধ্যে এই কাজসম্পন্ন করতে পারবে।
কাজেই, সার্বিক বিবেচনায় সংস্কার প্রক্রিয়াসম্পন্ন ও নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে আগামী ১২ মাস সময়কাল যথেষ্ট বলে মনে হয়। এ ছাড়া, ঐতিহ্যগতভাবে নির্বাচন আয়োজনের জন্য শীতকালকেই বেছে নেওয়া হয়। কারণ, এই সময় বৃষ্টি, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্ভাবনা কম থাকে। এই বিষয়টিও উপেক্ষা করা উচিত নয়।
বর্তমানে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে সক্রিয় রয়েছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং আরও অসংখ্য ছোট রাজনৈতিক দল। আরও একটি নতুন দল এখানে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। এটি হলো সেই শিক্ষার্থীদের দল, যারা শেখ হাসিনা সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে। তারা শিগগির একটি রাজনৈতিক দল গঠনের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছে এবং সেখানেও থাকবে ছাত্ররাজনীতি শাখা।
দৃশ্যত সকলের কাছেই মনে হচ্ছে, বিএনপি ক্ষমতাসীন হওয়ার দ্বারপ্রান্তে রয়েছে। কাজেই, যত দ্রুত নির্বাচন আয়োজন করা যায়, সেটা নিশ্চিত করার জন্য তারা চাপ প্রয়োগ করবে এটা প্রত্যাশিত। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ১৮ ডিসেম্বর তার দলীয় নেতাকর্মীদের ‘প্রতিশোধ নয়, সংস্কারের প্রতি মনোযোগ’ দেওয়ার যে আহ্বান জানিয়েছেন, তা প্রশংসার দাবিদার। তিনি আরও বলেছেন, ‘আমরা এই নির্যাতনের জবাব যদি তাদের (আওয়ামী লীগ) মতো দেই, তাহলে তো হবে না। তারা অধম বলে আমরা অধম হব নাকি।’ এটি অত্যন্ত ইতিবাচক ও স্বাগত জানানোর মতো একটি অবস্থান এবং খুবই শক্তিশালী ও দূরদর্শী চিন্তাধারা।
সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশ জমা দেওয়ার আগেই তারেক রহমান বলেছেন, তিনি ও তার দল সংবিধানের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ দুইবারে সীমাবদ্ধ রাখার প্রস্তাব দেবেন। নির্বাচনে জিতলে যিনি এই পদে আসীন হতে পারেন, তিনিই যখন নিজের ভবিষ্যৎ মেয়াদে সীমাবদ্ধতা আনতে চাচ্ছেন, সেটা অত্যন্ত প্রশংসনীয় ও নজিরবিহীন একটি উদ্যোগ। তিনি দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের পক্ষেও সমর্থন জানিয়েছেন। এই দুটি প্রস্তাব এ দেশের রাজনীতিতে গভীরভাবে প্রভাব ফেলবে এবং স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে যে আজকের বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ভবিষ্যতের কথা ভাবছেন।
৩১ দফা কর্মসূচির মাধ্যমে স্পষ্টভাবে তুলে ধরা হচ্ছে যে বিএনপি ক্ষমতায় গেলে কী করতে চায়। অবশ্য, আমরা এটা দেখেও অভ্যস্ত যে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের আগে বড় বড় প্রতিশ্রুতি দেয় এবং ক্ষমতায় যাওয়ার পর সেগুলো ভুলে যায়। কিন্তু জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে আমরা যে নতুন দেশ পেয়েছি, আশা করি সেখানে এই পরিস্থিতিরও পরিবর্তন হবে।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী প্রধান উপদেষ্টার নির্বাচনি পরিকল্পনায় শর্তসাপেক্ষে সমর্থন দিয়েছে। দলটির সেক্রেটারি জেনারেল বলেছেন, প্রথম দিকে বিলম্ব নিয়ে দ্বিধা থাকলেও যতক্ষণ প্রধান উপদেষ্টা তার নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবেন, আমরা ধৈর্য ধরে থাকব...আমরা তাকে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। তার এ বক্তব্য স্পষ্ট করে যে জামায়াত কোনো তাড়াহুড়ো করছে না। কারণটি সহজ - যত বেশি সময় পাবে, নির্বাচনের জন্য জামায়াত তত বেশি সংগঠিত হতে পারবে, বিশেষ করে দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে।
আমাদের মতে, ছোট রাজনৈতিক দলগুলো ২০২৬ সালের মাঝা-মাঝি সময়ে নির্বাচনের বিষয়ে আপত্তি করবে না। কারণ, নির্বাচনের ক্ষেত্রে তাদের খুব বেশি প্রত্যাশা নেই। সেই সঙ্গে বর্তমানে তারা বাকি দলগুলোর মতোই সমান সুযোগ পাচ্ছে বলে তুলনামূলকভাবে ভালো অবস্থায় রয়েছে।
দেশের রাজনীতিতে অন্যতম সম্ভাবনার মধ্যে একটি হলো শিক্ষার্থীদের পরিকল্পিত নতুন দল গঠন। তারা রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হলে, নির্বাচনে অংশ নিয়ে ভোটারদের সমর্থন পেলে এবং সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে শাসন প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারলে সেটা ভিন্ন মাত্রা যোগ করবে। নতুন দলটি আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে, যার লক্ষ্য হবে সমাজ থেকে বৈষম্য দূর করার জন্য নতুন ও সাহসী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা। তবে তারা নির্বাচনের আগে নিজেদের আরও ভালোভাবে সংগঠিত করার জন্য সময় চাইবে এবং এ কারণে তারাও দ্রুততম সময়ে নির্বাচনের বিরোধিতা করছে।
বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অবস্থান যতই ভিন্ন হোক না কেন, আমাদের মতে গত ১৫ বছর ধরে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত সাধারণ মানুষ তাদের প্রতিনিধি নিজেরা বেছে নিয়ে একটি সরকার নির্বাচিত করতে চায়।
লেখক : সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার
ভোরের আকাশ/রন