কিংবদন্তি অভিনেতা প্রবীর মিত্রকে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় শেষ বিদায় জানিয়েছেন তার সহকর্মী ও ভক্তরা। গতকাল সোমবার দুপুরে তার মরদেহ রাজধানীর আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়। এর আগে এফডিসি ও চ্যানেল আই কার্যালয়ে তার জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।
গত রোববার রাতে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান প্রবীর মিত্র। তার বয়স হয়েছিল ৮২ বছর এবং তিনি চার সন্তানের জনক। তার সন্তানরা হলেন মিঠুন মিত্র, ফেরদৌস পারভীন, সিফাত ইসলাম এবং সামিউল ইসলাম। তার স্ত্রী অজন্তা মিত্র ২০০০ সালে মারা যান।
পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, গত কয়েক দিন থেকে প্রবীর মিত্রর শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা কমতে থাকে। ভেতরে রক্তক্ষরণের সঙ্গে প্লাটিলেটও কমছিল। শনিবার অক্সিজেনের মাত্রা বাড়লেও প্লাটিলেট আরও কমে যায়। রোববার সকালে প্লাটিলেট ও অক্সিজেনের মাত্রা আরও কমতে থাকে। কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাসের ব্যবস্থার আগেই এ অভিনেতার মৃত্যু হয়। রাত ১০টা ১০ মিনিটে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
রাতে গোসল শেষে ফ্রিজার গাড়িতে প্রবীর মিত্রর মরদেহ তার ধানমন্ডির বাসায় রাখা হয়। গতকাল জোহরের নামাজের পর এফডিসিতে প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর চ্যানেল আই প্রাঙ্গণে দ্বিতীয় জানাজা শেষে আজিমপুর কবরস্থানে তার মরদেহ দাফন করা হয়। বেশ কিছু শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন তিনি। ১৩ দিন ধরে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। ২২ ডিসেম্বর তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার অবস্থার অবনতি হয়।
কয়েক বছর ধরে হাঁটুর হাড়ক্ষয় রোগে ভুগছিলেন প্রবীর মিত্র। মাঝেমধ্যে অস্ত্রোপচার করা হলেও তিনি পুরোপুরি সুস্থ হননি। নিয়মিত ফিজিওথেরাপি নিতে হতো। স্বাভাবিক হাঁটাচলা করতে না পারায় তিনি হুইলচেয়ারের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। বাসার বাইরে খুব একটা যাওয়া হতো না। পত্রিকা পড়ে কিংবা টিভি দেখে, শুয়ে-বসে সময় কাটাতেন তিনি। পরিবার জানিয়েছে, ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেই প্রবীর মিত্র বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হন। তার মুসলিম নাম ছিল হাসান ইমাম। তার পুত্র জানান, ‘মাকে বিয়ে করার আগে বাবা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন।’
১৯৪৩ সালের ১৮ আগস্ট চাঁদপুরের নতুনবাজারের গুয়াখোলায় মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন প্রবীর মিত্র। তার পুরো নাম প্রবীর কুমার মিত্র। পুরান ঢাকায় বড় হওয়া প্রবীর মিত্র স্কুলজীবন থেকেই নাট্যচর্চার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। স্কুলজীবনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ডাকঘর’ নাটকে অভিনয় করেছিলেন। তার স্কুল জীবনের বন্ধু ছিলেন প্রয়াত অভিনেতা এটিএম শামসুজ্জামান। তার মৃত্যুর সংবাদ প্রবীর মিত্রকে কখনোই জানানো হয়নি, কারণ এটি তার মানসিক স্বাস্থ্যে আঘাত করতে পারে।
১৯৭১ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ৫০ বছরের ক্যারিয়ারে তিনি ২১৩টি ছবিতে অভিনয় করেছেন। তার সর্বশেষ মুক্তিপ্রাপ্ত ছবিটি এফআই মানিক পরিচালিত ‘সৌভাগ্য’। ১৯৬৯ সালে এইচ আকবরের ‘জলছবি’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে তিনি প্রথম ক্যামেরার সামনে দাঁড়ান। যদিও চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায় ১৯৭১ সালের ১ জানুয়ারি। ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে তিনি নায়ক হিসেবে কয়েকটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। পরে চরিত্রাভিনেতা হিসেবেও তিনি দর্শকপ্রিয়তা অর্জন করেন। ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, ‘দুই পয়সার আলতা’, ‘বড় ভালো লোক ছিল’, ‘বেদের মেয়ে জোসনা’র মতো চলচ্চিত্রে অভিনয় করে দর্শকদের হৃদয়ে জায়গা করে নেন। অভিনয় করেছেন ‘জীবন তৃষ্ণা’, ‘সেয়ানা’, ‘জালিয়াত’, ‘ফরিয়াদ’, ‘রক্ত শপথ’, ‘চরিত্রহীন’, ‘জয় পরাজয়’, ‘অঙ্গার’, ‘মিন্টু আমার নাম’, ‘ফকির মজনু শাহ’, ‘মধুমিতা’, ‘অশান্ত ঢেউ’, ‘অলংকার’, ‘অনুরাগ’, ‘প্রতিজ্ঞা’, ‘তরুলতা’, ‘গাঁয়ের ছেলে’, ‘পুত্রবধূ’সহ চার শতাধিক চলচ্চিত্রে।
ভোরের আকাশ/রন