logo
আপডেট : ১০ জানুয়ারি, ২০২৫ ১২:০৪
স্থানীয় সরকারে শূন্যতা
জনদুর্ভোগের শেষ কোথায়
সিরাজুল ইসলাম

জনদুর্ভোগের শেষ কোথায়

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। এর তিন দিনের মাথায় নোবেল জয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে। দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই সর্বোচ্চ বিচারালয় থেকে শুরু করে মাঠ প্রশাসনের ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়। স্থানীয় সরকারের সিটি মেয়র ও কাউন্সিলর, উপজেলা পরিষদের প্রশাসক ও সদস্য এবং পৌরসভার মেয়র ও কাউন্সিলরদের বরখাস্ত করা হয়। এর ফলে স্থানীয় সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলো জনপ্রতিনিধি শুন্য হয়ে পড়ে। সেখানে সরকার প্রশাসক নিয়োগ দিলেও ন্যূনতম সেবা মিলছে না। প্রশাসকরা কেবল ‘রুটিন ওয়ার্ক’ করছেন। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান-মেম্বরদের বরখাস্ত করা হয়নি, তবে তাদের সিংহভাগ পলাতক। কারণ তাদের সিংহভাগই গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত শাসক দল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ছিলেন। ফলে জন্ম-মৃত্যু সনদ, ওয়ারিশ সনদ, নাগরিক সনদের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় সেবা মিলছে না। দিনের পর দিন সেবাপ্রার্থীকে ঘুরতে হচ্ছে। তাদের মুখে এখন ক্ষোভ আর হতাশার সুর। অনেক স্থানে নিয়মিত ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করা হচ্ছে না। রাস্তাঘাট ভেঙে গেছে। সেগুলো মেরামতের উদ্যোগ নেই।

যে কারণে জনপ্রতিনিধিদের অপসারণ

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আওয়ামী লীগের টানা সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে সব কিছুতে অতিমাত্রায় দলীয়করণ করা হয়। নির্বাচনগুলোর মান নিয়েও যথেষ্ট প্রশ্ন ছিল। অনিয়ম, দুর্নীতি, ভোট ডাকাতির অভিযোগ ছিল। এসব নির্বাচনে যারা বিজয়ী হয়েছিলেন; তাদের সিংহভাগই আওয়ামী লীগ সমর্থিত। এর বাইরে অন্য দল থেকেও কিছু প্রতিনিধি নির্বাচিত হন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। দলটির নেতাকর্মীদের সঙ্গে অধিকাংশ জনপ্রতিনিধি গা ঢাকা দেন। ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার শপথ নেয়। ১৯ আগস্ট সব সিটির মেয়রকে বরখাস্ত করে প্রশাসক নিয়োগ দেয় স্থানীয় সরকার বিভাগ। গত ২৬ সেপ্টেম্বর একযোগে সব সিটি করপোরেশন ও ৩২৩টি পৌরসভার কাউন্সিলরকে বরখাস্ত করা হয়।

এর আগে ‘স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৪’, ‘স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৪’, ‘জেলা পরিষদ (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৪’ ও ‘উপজেলা পরিষদ (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৪’-এর খসড়া অনুমোদন করে উপদেষ্টা পরিষদ। পরে তা অধ্যাদেশ আকারে জারি করা হয়। ‘উপজেলা পরিষদ (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৪’-এ দুইটি নতুন ধারা যোগ করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৩ঘ ধারায় রয়েছে, বিশেষ পরিস্থিতিতে চেয়ারম্যান বা ভাইস চেয়ারম্যান বা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান বা অন্য সদস্যগণকে অপসারণের ক্ষেত্রে সরকারের ক্ষমতা এবং ১৩ঙ ধারায় রয়েছে বিশেষ পরিস্থিতিতে প্রশাসক নিয়োগের ক্ষেত্রে সরকারের ক্ষমতা। বিশেষ পরিস্থিতিতে চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও সদস্যগণের অপসারণের ক্ষেত্রে সরকারের ক্ষমতা শীর্ষক অধ্যাদেশের ১৩ (ঘ) ধারায় বলা হয়েছে, ‘এই আইনের অন্যান্য বিধানে কিংবা আপাতত বলবৎ অন্য কোন আইনে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, সরকার, বিশেষ পরিস্থিতিতে সরকার অত্যাবশক বিবেচনা করিলে বা জনস্বার্থে, সকল জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, ভাইস-চেয়ারম্যান, মহিলা ভাইস-চেয়ারম্যান বা অন্যান্য সদস্যগণকে অপসারণ করিতে পারিবে।’ একইভাবে বিশেষ পরিস্থিতিতে স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিদের অপসারণ এবং প্রশাসক নিয়োগের ক্ষমতা সরকারের হাতে রেখে পৌরসভা, উপজেলা, জেলা ও সিটি করপোরেশনের আইন সংশোধনের আলাদা আলাদা অধ্যাদেশ জারি করে সরকার।

অধ্যাদেশ জারির পরে ৪৯৩ উপজেলা চেয়ারম্যানকে অপসারণ করা হয়। আর খুলনার কয়রা উপজেলা চেয়ারম্যান জি এম মোহসিন রেজা মারা যাওয়ায় শূন্য ঘোষণা করা হয় তার পদটি। চেয়ারম্যানশূন্য সব উপজেলাতেই সংশ্লিষ্ট ইউএনও প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। পরে এসব উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান (পুরুষ ও মহিলা) সরানো হয়। উপজেলা পরিষদের মতো জেলা পরিষদ ও পৌরসভার ক্ষেত্রেও একই পদক্ষেপ নেয় সরকার। সবশেষ নির্বাচনের পর ৪৯৪ উপজেলার সব মিলিয়ে ৯৮৮ জন ভাইস চেয়ারম্যান ও নারী ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন।

বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদে অনুপস্থিত রয়েছেন এমন চেয়ারম্যানদের বদলে দায়িত্ব পালন করবেন প্যানেল চেয়ারম্যানরা- এমন প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মহ. শের আলী এবং ঢাকা উত্তর সিটিতে নিয়োগ পেয়েছেন স্থানীয় সরকার বিভাগের মহাপরিচালক মাহমুদুল হাসান।

খুলনা, রাজশাহী, সিলেট, বরিশাল, রংপুর ও ময়মনসিংহ বিভাগের কমিশনারদের দেওয়া হয়েছে। এছাড়া স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন; বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমির মহাপরিচালককে (অতিরিক্ত সচিব) কুমিল্লা সিটি করপোরেশন এবং ঢাকার বিভাগীয় কমিশনারকে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের প্রশাসকের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। জেলা পরিষদের দায়িত্ব পেয়েছেন ডিসিরা। স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, সিনিয়র সহকারী কমিশনার ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) পদের কর্মকর্তাদের পৌর প্রশাসক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এজন্য তারা ভাতা প্রাপ্ত হবেন।

মিলছে না নাগরিক সেবা

স্থানীয় সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে সেবা যে মিলছে না, তা নিয়মিতই উঠে আসছে সংবাদ মাধ্যমের প্রতিবেদনে। সম্প্রতি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ৪৩ নম্বর ওয়ার্ড কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, ফাঁকা অফিসে একজন অফিস সহকারী বসে আছেন। সেখানে ওয়ারিশ সার্টিফিকেট নিতে আসা শাহিন সুলতানা বলেন, ‘সকাল ৯টায় এসেছি, অফিসে কেউ নেই। কাগজ নিয়ে বসে আছি।’ সেগুনবাগিচায় কাঁচাবাজার মার্কেটের তৃতীয় তলায় ২০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয় থেকেও সেবা না পেয়ে ফিরে যাচ্ছে মানুষ। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে মার্কেটের নিচে দেখা হয় মাঝবয়সী চান শেখের সঙ্গে। প্রত্যয়নপত্র নিতে এসেছেন তিনি। তবে কাউন্সিলর কার্যালয়ে ঢুকতে পারেননি। কারণ নিচতলার সিঁড়ির কেচিগেটে তালা ঝুলছে। গত ৫ আগস্ট থেকে এই গেটে তালা ঝুলছে। একই অবস্থা ঢাকা উত্তর সিটির ওয়ার্ডগুলোতে। ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মিজানুর রহমান এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘পরিবর্তিত অবস্থায় নগরসেবা চালু রাখতে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় কাজ চলছে। কাউন্সিলরদের অনুপস্থিতিতে বিশেষ কোনো অসুবিধা হবে না।’

সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ অনেক সড়ক ভেঙেচুরে তছনছ হয়ে গেছে। সেগুলো মেরামতের উদ্যোগ নেই। এ রকম পরিস্থিতিতে আগে কাউন্সিলররা নগর ভবনে গিয়ে তদবির করে নিজ নিজ এলাকার রাস্তা মেরামতের ব্যবস্থা করতেন। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে পাড়া-মহল্লায় মাইকিং, লিফলেট বিতরণ, মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম তদারকি করতেন। মাঝে মাঝে বৃষ্টি হওয়ার কারণে ডেঙ্গু পরিস্থিতি উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। প্রতিদিনই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যু হচ্ছে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) সাবেক কাউন্সিলর সুরাইয়া বেগম তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, প্রতিদিনই এলাকাবাসী নানা প্রয়োজনে তার বাসায় ভিড় করছেন। কারও প্রত্যয়নপত্র দরকার, কারও নাগরিক সনদ দরকার। কিন্তু এগুলো দেওয়ার এখতিয়ার এখন তার নেই। একই ধরনের ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বিএনপিপন্থি কয়েকজন কাউন্সিলর। তারা বলছেন, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি থেকে নির্বাচিত কাউন্সিলররা কেন বাদ পড়লেন? তাদের অপরাধটা কী?

চট্টগ্রামে মেয়র আছে, কাউন্সিলর নেই

গত ১ অক্টোবর নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল ডা. শাহাদাত হোসেনকে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র ঘোষণা করেন। ৩ নভেম্বর তিনি শপথ নেন। ২০২১ সালের ২৭ জানুয়ারি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে ৩ লাখ ৬৯ হাজার ২৪৮ ভোট পেয়ে মেয়র নির্বাচিত হন নৌকার প্রার্থী রেজাউল করিম চৌধুরী। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির প্রার্থী ডা. শাহাদাত হোসেন ধানের শীষ প্রতীকে পান ৫২ হাজার ৪৮৯ ভোট। ভোটে কারচুপির অভিযোগ তুলে ফল বাতিল চেয়ে ওই মাসেই নির্বাচনি ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন ডা. শাহাদাত। সরকার পরিবর্তনের পর এ বছরের ১ অক্টোবর সেই মামলার রায়ে শাহাদাতকে নির্বাচিত ঘোষণা করেন চট্টগ্রামের নির্বাচনি ট্রাইব্যুনালের বিচারক যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ খাইরুল আমীন। কিন্তু দেশের অন্য সিটি করপোরেশনের মতো চট্টগ্রামও কাউন্সিলর শূূন্য। কর্পোরেশনের ১৩ কর্মকর্তা কাউন্সিলরের রুটিন দায়িত্ব পালন করছেন।

প্রশাসক দিয়ে কাজ চালানো সম্ভব কি না- এমন প্রশ্ন সামনে চলে এসেছে। এ বিষয়ে নগর পরিকল্পনাবিদ ও স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আকতার মাহমুদের ভাষ্য ‘জনপ্রতিনিধিরা যাই হোক, তাদের লাগবে। বিশেষ পরিস্থিতির কারণে এখন জনপ্রতিনিধি নেই। তবে এই অবস্থা বেশিদিন দীর্ঘায়িত করা ঠিক হবে না। এতে নাগরিক সেবা বিঘ্নিত হবে। এ জন্য যেসব সংস্কার প্রয়োজন, সেগুলো দ্রুত করে নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে।

তিনি বলেন, প্রশাসক দিয়ে যে কাজ চালানো সম্ভব না, তার উদাহরণ হতে পারে লোকবল কাঠামো। রাজধানীর দুই সিটির (উত্তর ও দক্ষিণ) দুই কমিটিতে সদস্য রাখা হয়েছে ২৫ জন করে ৫০ জন। এসব প্রতিনিধি কাউন্সিলর হিসেবে সেবা প্রদান করবেন। একইভাবে অন্যান্য সিটি করপোরেশন ও পৌরসভায় সংখ্যাভেদে কমিটি গঠনের কথা বলা হয়েছে।

আকতার মাহমুদ আরও বলেন, জনপ্রতিনিধিরা যেভাবে সাধারণ নাগরিকদের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকেন বা এলাকার সমস্যার কথা জানেন। তারা গভীর রাতেও অনেক সময় মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়ান। সরকারি কর্মকর্তাদের পক্ষে সেভাবে সেবা দেওয়া সম্ভব হবে না। রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনের সাধারণ ও সংরক্ষিত মিলিয়ে কাউন্সিলর ছিলেন ১৭২ জন। সেখানে দুই কমিটির ৫০ জনের পক্ষে এই কাজ করা সম্ভব হবে না বলে মনে করেন তিনি।

ভোরের আকাশ/ সু