logo
আপডেট : ১১ জানুয়ারি, ২০২৫ ১০:০৮
আ.লীগ সংগঠিত হতে পারছে না
নিখিল মানখিন

আ.লীগ সংগঠিত হতে পারছে না

অস্তিত্ব সংকটের মুখে আওয়ামী লীগ। চোখে পড়ছে না দলটির কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড। কেবল অজ্ঞাত স্থান থেকে অনলাইনে দলটির ফেসবুক পেজ থেকে কিছু কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে। সর্বশেষ সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দলীয় ভার্চুয়াল বৈঠক করার বিষয়টি আলোচনায় উঠে এসেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, দলটির স্বার্থপর নেতাদের ওপর ক্ষুব্ধ কর্মী-সমর্থকরা। বছরের পর বছর ধরে দলটির ‘পরিবার ও উত্তরাধিকারতন্ত্র’ ভিত্তিক রাজনীতির কষাঘাতে জর্জরিত লাখ লাখ ত্যাগী ও বঞ্চিত নেতাকর্মী। নিজেদের আখের গুছিয়ে পলাতক নেতারা, আর বঞ্চিত নেতাকর্মীদেরই সহ্য করতে হচ্ছে কষ্ট-যন্ত্রণা। তাই পলাতক নেতাদের কর্মসূচি পালনে সাড়া দিচ্ছে না ক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা।

গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে দেশত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত দলটির কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চোখে পড়েনি। এমনকি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ১৫ আগস্ট শোক দিবস পালন করতেও দেখা যায়নি। ওই দিন ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে আওয়ামী লীগের কিছু নেতাকর্মী জড়ো হলে তাদের ওপর শিক্ষার্থীদের হামলার ঘটনা ঘটে। এরপর থেকে এক অর্থে আত্মগোপনে চলে যায় দলটি। নতুন কোনো কর্মসূচিও ঘোষণা দেয়নি আওয়ামী লীগ। ইতোমধ্যে নিষিদ্ধ করা হয়েছে আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে। তবে, নতুন বছরে দলটি আবারও মাঠের রাজনীতিতে সক্রিয় হতে যাচ্ছে। দেশ-বিদেশে নিজেদের জানান দিতে ইতোমধ্যে লবিস্টও নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সাড়া মিলছে না।

আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল সম্প্রতি দেশের শীর্ষ সারির একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালিয়েছে। যার কারণে আমরা সতর্কতার সঙ্গে কর্মসূচি হাতে নিয়েছিলাম। এখন পরিস্থিতি পাল্টেছে। মানুষ বুঝতে পারছে যে, দেশকে কীভাবে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, চলতি মাসের মধ্যে আমরা রাজনৈতিক কর্মসূচি দেব। এ সরকারের বিদায় ঘণ্টা বেজে গেছে, এখন সময়ের ব্যাপার। আমরা জেলা, মহানগর, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ খুলে নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করছি। আমাদের নেত্রীও বিভিন্ন দেশে প্রবাসী নেতাকর্মীদের সঙ্গে ভার্চুয়াল মাধ্যমে কথা বলেছেন।

এদিকে গত ৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগের মধ্যে তৈরি হয় রাজনৈতিক শূন্যতা। ছেদ পড়ে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে। এ কারণে ২০২৪ সালকে বলা যায় আওয়ামী লীগের জন্য অন্ধকারময় বছর। বছরটি পার হয়েছে, এসেছে নতুন বছর। নতুন বছরে দেশবিরোধী অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করার অঙ্গীকার করেছে দেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দলটি। তারা বলছে, শুভ ও কল্যাণময় সময় প্রতিষ্ঠা করতে তারা নতুন করে নিজেদের আত্মনিয়োগ করবে। পাশাপাশি বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর সমর্থন চাওয়া হবে।

দলটির একাধিক সূত্র বলছে, ২০২৪ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে একের পর এক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে হাজার হাজার নেতাকর্মীকে। আজগুবি দুর্নীতির তথ্য ফাঁস করা হচ্ছে শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দের। আওয়ামী লীগের অস্তিত্ব নির্মূল করতে এমন কোনো কাজ নেই; যা করছে না বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। গঠন করা হয়েছে গুম কমিশন। আওয়ামী লীগ সরকারের গুম-খুন-দুর্নীতি নিয়ে জনমত তৈরির চেষ্টা করা হচ্ছে।

নতুন বছরে দেশবিরোধী অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করার অঙ্গীকার করেছে দেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দলটি। তারা বলছে, শুভ ও কল্যাণময় সময় প্রতিষ্ঠা করতে তারা নতুন করে নিজেদের আত্মনিয়োগ করবে। পাশাপাশি বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর সমর্থন চাওয়া হবে।

দলটির নেতারা বলছেন, নতুন বছরে তারাও সব ধরনের প্রতিবন্ধকতা ও ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে নতুন আঙ্গিকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু করতে চান। এজন্য নেওয়া হচ্ছে বিশেষ পরিকল্পনা ও উদ্যোগ। যেগুলো তৃণমূলের নেতাকর্মীদের নতুন করে উজ্জীবিত করবে, পাশাপাশি আওয়ামী লীগের হারিয়ে যাওয়া জনসমর্থন নতুন করে ফিরে পেতে সহায়ক হবে।

বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে আন্দোলনের মুখে গত আগস্টে ক্ষমতা হারানো আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনার একটি ভার্চুয়াল বৈঠকের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যেখানে মূলত তিনি ‘দিকনির্দেশনামূলক’ ভাষণ দিবেন এবং উদ্যোগটি সফল হলে এটিই হবে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার নেতাকর্মীদের প্রথম বৈঠক।

এ উদ্যোগটি এমন সময় নেওয়া হলো যখন দলটির সিনিয়র নেতাদের প্রায় সবাই জেলে কিংবা আত্মগোপনে। অন্যদিকে আত্মগোপনে থাকা সিনিয়র নেতাদের বিরুদ্ধে দলের কর্মীদের অনেকেই সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট দিয়ে তীব্র ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করছেন। অবশ্য সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত বলেছেন, আওয়ামী লীগ আগামী ২-৩ মাসের মধ্যে পূর্ণাঙ্গভাবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আবির্ভূত হবে। তবে সেটি কীভাবে হতে পারে সে সম্পর্কে কোনো ধারণা তিনি দেননি।

এর আগে শেখ হাসিনা লন্ডন, ফ্রান্স ও ব্রাসেলসে প্রবাসী নেতাকর্মী ও সমর্থকদের উদ্দেশে ফোনে বক্তব্য দিলেও দলটির নেতাদের সঙ্গে তার যোগাযোগের কোনো তথ্য এতদিন পাওয়া যায়নি।

ঢাকা, কলকাতা ও লন্ডনে থাকা আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা বলেছেন শেখ হাসিনা দলের নেতাদের উদ্দেশে ভাষণ দিবেন- এমন খবরে তারা উচ্ছ্বসিত এবং তারা মনে করেন ‘বর্তমান প্রতিকূল পরিস্থিতিতে’ জেলের বাইরে থাকা নেতাদের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের এ চেষ্টার মাধ্যমেই আওয়ামী লীগের ‘ঘুরে দাঁড়ানোর’ প্রচেষ্টা শুরু হতে যাচ্ছে।

দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেছেন, ‘শেখ হাসিনাসহ দলের নেতারা এর মধ্যেই তৃণমূলের ইউনিট নেতাদের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করেছেন। দেশের চল্লিশ ভাগ ভোটার আওয়ামী লীগের। সব প্রতিকূলতা মোকাবিলা করেই আমরা ঘুরে দাঁড়াবো। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড হলে নির্বাচনেও যাবো। এটাই আওয়ামী লীগের ঐতিহ্য। আমরা দলকে সংগঠিত করার কার্যক্রম শুরু করেছি।’

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জোবাইদা নাসরীন বলছেন, শেখ হাসিনা বা আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। সে কারণে তিনি তার দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে বৈঠক করতেই পারেন। এমন বৈঠক হলে সেটি হয়তো হবে দলটিকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টার অংশ হিসেবে একটি রাজনৈতিক কৌশল। তবে দেখার বিষয় হবে সে বৈঠকে শেখ হাসিনা কী বার্তা দেন।’ এমন তথ্য প্রকাশ পেয়েছে বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন।

নেতাদের ওপর ক্ষুব্ধ কর্মী-সমর্থকরা : আজ কোথায় গেল এত আওয়ামী লীগ-এমন প্রশ্ন সর্বসাধারণের। গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর রাজনৈতিক মাঠে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের দেখা নেই। নেতারা গেছেন আত্মগোপনে। আর দিশেহারা কর্মীরা হয়ে গেছেন নীরব। কর্মসূচি গ্রহণ তো দূরের কথা, বাসা-বাড়ি থেকে বের হওয়ার নিরাপদ পরিবেশ এখনও তৈরি হয়নি। তবে তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয় থাকার চেষ্টা করছেন বলে জানান আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।

দলটির নেতাকর্মীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, দলটি এখন নেতৃত্ব শূন্যতায় ভুগছে। মাত্র চার মাসের ব্যবধানে পরিস্থিতি এখন পুরোপুরি পাল্টে গেছে। দলটির নেতাকর্মীদের অনেকেই এখন উদ্বেগ ও আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। সংবাদমাধ্যমে কথা বলার সময় তারা তাদের নামও প্রকাশ করতে চাননি। আওয়ামী লীগের জেলা পর্যায়ের একজন নেতা বলেন, আমাদের দলের এখন দিশাহারা বিপর্যস্ত অবস্থা হয়ে গেছে। কারণ একমাস হয়ে গেল অথচ কেন্দ্র থেকে কার্যকর কোনো নির্দেশনা দেওয়া হলো না। ফোন দিলেও কেউ ধরে না। হামলা-মামলা সব মিলিয়ে নেতাকর্মীরা হতাশ হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় নেতাকর্মীদের অনেকে রাজনীতি ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবছেন। অন্যদিকে, আওয়ামী লীগের এখনকার যে অবস্থা দেখা যাচ্ছে, সেটার জন্য দলের সিনিয়র নেতাদের দায়ী করেছেন তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকরা। ফরিদপুরের একজন আওয়ামী লীগের কর্মী বলেন, ক্ষমতা হারালে এমন অবস্থা যে হতে পারে, সেটা তো নেতাদের অজানা থাকার কথা না। তারাই তো এর জন্য দায়ী। তিনি বলেন, ক্রিম খাইলো নেতারা, কোটি কোটি টাকা বানাইলো তারা; আর তাদের পাপের শাস্তি ভোগ করতে হচ্ছে আমাদের মতো তৃণমূলের নেতাকর্মীদের।

হামলার ভয়ে নিজেরা গা-ঢাকা দিলেও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বেশিরভাগের পরিবার-পরিজন তাদের এলাকাতে রয়েছেন। তবে আয়-রোজগার না থাকায় সংসার চালাতে গিয়ে অনেকের স্ত্রী-সন্তানরা বিপাকে পড়েছেন।

আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতাকর্মীরা বলছেন, ‘পরিবার ও উত্তরাধিকার তন্ত্র’ দলটির স্বাভাবিক কাঠামো তছনছ করে দিয়েছে। স্বার্থপর নেতারা আওয়ামী লীগকে নিজেদের প্রতিষ্ঠান বানিয়ে ফেলেছিলেন। নিজেদের কতিপয় লোকজন দিয়েই সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন। তাদের অসৎ স্বার্থবিরোধী ও মতামতের বিরুদ্ধে গেলেই গ্রুপ থেকে বাদ পড়তেন ত্যাগী নেতারা। কেন্দ্র থেকে ইউনিয়ন পর্যন্ত ত্যাগী ও বঞ্চিত নেতারা কোণঠাসা হয়ে পড়েছিলেন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষক মহল মনে করছেন, ক্ষমতায় থাকার সময়ই উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে আওয়ামী লীগের চেইন অব কমান্ড দুর্বল হয়ে পড়েছিল। সরকার ও দল একাকার হওয়ায় বেড়ে যায় জটিলতা। কোন্দলের শিকড় অনেক গভীরে বিস্তার লাভ করেছিল। আর এসব দ্বন্দ্বে অনেক কেন্দ্রীয় নেতা, স্থানীয় সংসদ সদস্য, জেলা-উপজেলার শীর্ষ নেতা ও মনোনয়নপ্রত্যাশীরা মদদ জোগাতেন বলে মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীরা অভিযোগ করেছেন।

আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতারা অভিযোগ করেন, ত্যাগী, দক্ষ ও স্বচ্ছ-পরিচ্ছন্ন ইমেজের নেতারা দলে জায়গা না পেয়ে হতাশ হয়ে নিজেদের গুটিয়ে নিচ্ছেন। কেউ কেউ স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে পৃথক পৃথক দলীয় গ্রুপিংয়ে জড়িয়ে পড়েছিলেন।

অভিযোগ রয়েছে, অধিকাংশ এলাকায় আওয়ামী লীগের উপজেলা ও ইউনিয়ন কমিটি গঠনে একচ্ছত্র ক্ষমতা ব্যবহার করেছিলেন স্থানীয় সংসদ সদস্যরা। তাদের আশীর্বাদপুষ্ট লোকজন ছাড়া কমিটিতে স্থান পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছিল। এক্ষেত্রে যোগ্যতার বিষয়টি বিচার-বিবেচনায় আনা হয়নি। আওয়ামী লীগের বিভাগীয় টিম এবং জেলা নেতারাও কমিটি বাণিজ্যে জড়িয়ে গিয়েছিলেন। আর পদবঞ্চিত যোগ্য নেতারা তৈরি করেন পৃথক দলীয় বলয়। এটি শুধু আওয়ামী লীগ নয়, তার সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সব সংগঠনের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। তাই গোপন জায়গা থেকে যতই কর্মসূচি গ্রহণ করা হোক না কেন, নেতাকর্মী ও সমর্থকদের সাড়া সহজে পাবে না আওয়ামী লীগ।

 

ভোরের আকাশ/রন