বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে ভারতের নানা বিষয়ে টানাপড়েনের মধ্যেই নতুন করে আবার সীমান্ত ইস্যুটি সামনে এলো। বিশেষ করে ভারতীয় সীমান্তরক্ষীরা কয়েকটি এলাকায় কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ কাজ শুরুর পর সীমান্ত উত্তেজনা বেড়েছে কয়েকগুণ। বাংলাদেশের তরফ থেকে তীব্র প্রতিবাদ করা হচ্ছে। দু’দেশের সীমান্তরক্ষীসহ জনসাধারণের অংশগ্রহণ বাড়তি উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। সীমান্তে দু’দেশের জনগণের মুখোমুখি বাগযুদ্ধ এবং দেশীয় অস্ত্র ও হুমকি প্রদর্শনের ঘটনাও ঘটেছে। গতকাল রোববার এবিষয়ে ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় কুমার ভার্মাকে তলব করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সীমান্তে ১৫০ গজের মধ্যে ভারত বেড়া নির্মাণ করতে পারবে না বলে জানিয়ে দিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা। দু’দশের মধ্যে বোঝাপড়া হয়েছে বলে দাবি করেছেন ভারতীয় হাইকমিশনার।
গত সপ্তাহজুড়ে আলোচনায় চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিনোদপুর, নওগাঁর ধামইরহাট, লালমনিরহাটের দহগ্রাম ও মহেশপুর উপজেলার মাটিলা সীমান্তের কোদলা নদী এলাকা। সীমান্তের শূন্যরেখায় ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কাঁটাতারের বেড়া দেওয়াকে কেন্দ্র করে বিজিবি-বিএসএফের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি হয়।
তথ্যমতে, লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার দহগ্রাম সীমান্তে ১০ জানুয়ারি সকাল থেকেই ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ শূন্যরেখায় কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের চেষ্টা করে। বিজিবির বাধায় শেষ পর্যন্ত কাজ বন্ধ করে তারা। গত বছরের আগস্টেও একই ঘটনা ঘটে দহগ্রামে। এ নিয়ে উত্তেজনা ছড়ায় দু’দেশের স্থানীয়দের মধ্যেও।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ সীমান্তে দু’দিনের উত্তেজনার পর গেল ৮ জানুয়ারি বেড়ার নির্মাণ বন্ধ করে বিএসএফ। একই কারণে গেল ৬ জানুয়ারি নওগাঁর ধামইরহাট সীমান্তেও উত্তেজনা ছড়ায়। একই দিনে ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার সীমান্ত এলাকায় কোদলা নদীর ৫ কিলোমিটার অংশ দখলমুক্ত করার দাবি করে বিজিবি। পরে ভারতের গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়, বিজিবির দাবি নাকচ করেছে বিএসএফ।
আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, সীমান্তের শূন্যরেখা থেকে ১৫০ গজের মধ্যে কোনো দেশ বেড়া কিংবা স্থাপনা নির্মাণ করতে পারবে না। কিন্তু বিএসএফ বলছে, ২০১০ সালের চুক্তি অনুযায়ী, আংগরপোতা-দহগ্রাম এলাকায় শূন্যরেখা বরাবর তারা একসারি বিশিষ্ট কাঁটাতার দিতে পারবে। তবে বিজিবি বলছে, ২০২১ সালে তিনবিঘা করিডোর দিয়ে আংগরপোতা-দহগ্রাম এলাকায় অপটিক্যাল ফাইভার ক্যাবল স্থাপনকাজে বিএসএফ বাধা দেয়। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমোদনের অজুহাত দেখিয়ে আজ পর্যন্ত তার সমাধান হয়নি। যদি সেটা না হয় তবে ভারতও কাঁটাতার দিতে পারবে না।
যা বললেন ভারতীয় হাই কমিশনার : সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার ব্যাপারে দুই দেশের মধ্যে বোঝাপড়া রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা। তিনি বলেন, দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী ভারতের বিএসএফ ও বাংলাদেশের বিজিবি সহযোগিতার মাধ্যমে সীমান্তে অপরাধ দমনের বিষয়ে কাজ করবে। গতকাল দুপুরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ভারতীয় হাইকমিশনারকে বর্ডার ইস্যু নিয়ে তলব করলে পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে সাংবাদিকদের তিনি এ কথা জানান।
প্রণয় ভার্মা বলেন, ‘আমি পররাষ্ট্রসচিবের সঙ্গে আলোচনা করেছি। অপরাধমুক্ত সীমান্ত নিশ্চিতের ব্যাপারে ভারতের প্রত্যয় নিয়ে কথা বলেছি। চোরাচালান, অপরাধীদের চলাচল, পাচারের চ্যালেঞ্জ কার্যকরভাবে দমনের বিষয়ে আলোচনা করেছি।’
সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের বিষয়ে ভারতের হাইকমিশনার বলেন, ‘নিরাপত্তার জন্য সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার ব্যাপারে আমাদের মধ্যে বোঝাপড়া রয়েছে। এ ব্যাপারে দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ ও বিজিবির মধ্যে যোগাযোগ রয়েছে। আমরা আশা করি, সীমান্তে অপরাধ দমনের বিষয়ে সহযোগিতার মাধ্যমে সেই বোঝাপড়ার বাস্তবায়ন হবে।’
শূন্যরেখা থেকে ১৫০ গজের মধ্যে বেড়া নয় : সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নিয়ে কঠোর অবস্থানে বাংলাদেশ জানিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, সীমান্তের ১৫০ গজের মধ্যে ভারত কোনোভাবেই কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করতে পারবে না। তবে ১৫০ গজের বাইরে হলে আপত্তি থাকবে না।
ভারতীয় হাইকমিশনারকে তলব করার আগে গতকাল রোববার বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত পরিস্থিতি নিয়ে সচিবালয়ে প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি এসব কথা বলেন। উপদেষ্টা বলেন, ভারতকে এসব নির্মাণকাজ করতে দেয়া হবে না। ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। তিনি বলেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভারতীয় হাইকমিশনারকে ডেকে দুই একদিনের মধ্যেই বিস্তারিত তথ্য জানাবে এবং নির্মাণ কাজের প্রতিবাদ জানাবে।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘বিগত সরকারের সময়ে ভারত সীমান্তের কিছু এলাকায় কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের সুযোগ পেয়েছে। বাংলাদেশ ভারতের মধ্যে ৪ হাজার ১৫৬ কিলোমিটার সীমান্তের ৩ হাজার ২৭১ কিলোমিটার সীমান্তে ভারত কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণকাজ শেষ করেছে। বাকি ৮৮৫ কিলোমিটার সীমান্তে ভারত কাঁটাতারের নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। তিনি বলেন, সম্প্রতি ভারত লালমনিরহাটে তিন বিঘা করিডোর, ফেনী, কুমিল্লা, কুষ্টিয়া ও নওগাঁর পত্নীতলায় কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের চেষ্টা করেছিল। কিন্তু দুদেশের চুক্তি অনুসারে যেকোনো স্থানে এ ধরনের উন্নয়ন কাজ করতে হলে দুদেশের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে করতে হবে। কিন্তু ভারত সেটি করেনি।
উপদেষ্টা বলেন, বাংলাদেশের বিজিবি এবং জনগণের প্রতিবাদের মুখে ভারতের পক্ষ থেকে তিন বিঘা করিডোর এবং নওগাঁ ও লালমনিরহাটে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে ভারত।
২০২৪ সালে বিএসএফের গুলিতে ৩১ জন বাংলাদেশি নিহত : ২০২৪ সালে বিভিন্ন সময়ে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) কর্তৃক সরাসরি গুলি করায় ৩১ জন বাংলাদেশি নাগরিক নিহত হয়েছেন। ২৯ জন বাংলাদেশি নাগরিক গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হয়েছেন, ৪ জন নির্যাতনের শিকার হন। অপরদিকে ৭ জন বাংলাদেশি নাগরিক ভারতীয়দের গণপিটুনির শিকার হয়েছেন।
এসব তথ্য উঠে এসেছে মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে দেওয়া গত বছরের রিপোর্টে। মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল।
দুই দেশের মানুষ মুখোমুখি : গত ১০ জানুয়ারি বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের একটি অংশে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ নিয়ে তিন দিন ধরে একরকম টানাপড়েন বা উত্তেজনার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ এবং নওগাঁ জেলা সংলগ্ন সীমান্তের ভারতের দিকের অংশে বেড়া নির্মাণ নিয়ে বাংলাদেশ অংশ থেকে বাধা দেওয়া হয়েছে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার চৌকা সীমান্তের বাংলাদেশ-ভারত দুই দিকেই গ্রামের মানুষজন জড়ো হয় সীমান্তরক্ষীদের সঙ্গে। দুই দিকেরই বেশকিছু ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে। এতে দেখা গিয়েছে বাংলাদেশ অংশে বেশি সংখ্যক লোকজন জড়ো হয়েছে, অন্যদিকে ভারত অংশে কিছু মানুষকে লাঠি রামদা, কাস্তের মতো অস্ত্র হাতে ‘বান্দে মাতরম’ স্লোগান দিতেও দেখা যায়। যদিও বিবিসি স্বাধীনভাবে এ ভিডিও যাচাই করতে পারেনি।
সীমান্তের ১২০০ গজের মতো অংশে কোনো কাঁটাতারের বেড়া ছিল না এবং সেই বেড়া তৈরির পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে ভারতের অভ্যন্তরে ১০০ গজ ভেতরে মাটি খোঁড়া হচ্ছিল বলে জানান ৫৯ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল গোলাম কিবরিয়া। বিজিবি থেকে এনিয়ে বাধা দেওয়া হয় এবং সাময়িকভাবে কাজ থামানো হয়।
নিয়ম অনুযায়ী সীমান্ত লাইন থেকে দেড়শ গজের মধ্যে কিছু করা হলে সেটা অপর পাশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে সঠিক নিয়ম মেনে অবহিত করতে হয় যেটা এক্ষেত্রে ভারতের বিএসএফ বাংলাদেশের বিজিবিকে জানায়নি বলে জানান লে. কর্নেল কিবরিয়া।
গত সোমবার দুই দেশের বাহিনীর পতাকা-বৈঠক হলেও মঙ্গলবারে আবারও নির্মাণকাজ শুরু হয়। মঙ্গলবারেও দুই পক্ষের বৈঠক হয় এবং তার পরও বুধবারে আবারও একই পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি হয়।
এনিয়ে স্থানীয় দুজন জানান মূলত মঙ্গলবার (৭ জানুয়ারি) ও বুধবারে (৮ জানুয়ারি) ব্যাপকহারে মানুষের জমায়েত বেড়ে যায় এবং একরকম উত্তেজনার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। ভারতের দিকেও বিএসএফের সঙ্গে সেখানকার স্থানীয় লোকজনও ছিল।
বাংলাদেশের অংশের মানুষ ভারতের উদ্দেশে এবং ভারতীয় অংশের মানুষ বাংলাদেশের উদ্দেশে স্লোগান দেন বলে জানান বিনোদপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. রুহুল আমিন।
সেখানে অনেকর হাতে রামদা দেখা গেলেও একরকম হাস্যরসাত্মক পরিবেশ লক্ষ্য করা যায়। যেমন - একজন রামদা শানাচ্ছেন বাংলাদেশ থেকে কেউ এলে কাটার জন্য শান দিচ্ছেন বলে হাসতে হাসতে জানান।
ভোরের আকাশ/রন