logo
আপডেট : ১৫ জানুয়ারি, ২০২৫ ১০:৪৫
বিএনপি চায় পঁচিশের মাঝামাঝি
জামায়াতের দাবি ডিসেম্বরে
এম. সাইফুল ইসলাম

বিএনপি চায় পঁচিশের মাঝামাঝি

চলতি বছরের জুলাই মাসের মধ্যেই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন করা সম্ভব বলে মনে করছে বিএনপির সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী ফোরাম দলটির স্থায়ী কমিটি। সবশেষ স্থায়ী কমিটির বৈঠকের আলোচনা তুলে ধরে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতকাল মঙ্গলবার এ কথা বলেছেন। জামায়াত ইসলামীও এই বছরের ডিসেম্বর অর্থাৎ চলতি বছরের মধ্যেই ভোট চাইছে। দলটির নায়েবে আমির ডা. আব্দুল্লাহ মো. তাহের সম্প্রতি এমন বক্তব্য দিয়েছেন। তবে প্রয়োজনীয় সংস্কার ও জুলাই গণহত্যার বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্তু জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন ছাত্র আন্দোলনের নেতারা। তারা বলছেন, ছাত্র-জনতার আত্মত্যাগ ভুলে দেশ ফের আগের অবস্থায় ফিরে গেলে জীবনদান বৃথা হয়ে যাবে।

ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গতবছর ৫ আগষ্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর থেকেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে দেশের বড় রাজনৈতিক দল বিএনপির পাশাপাশি জামায়াত নেতারা কথা বলতে শুরু করেন। দল দুটির মধ্যে কিছু কিছু বিষয় নিয়ে মত বিরোধও সৃষ্টি হয়। আওয়ামী লীগের পতনের পর থেকেই বিএনপি দ্রুত জাতীয় নির্বাচনের কথা বলে আসছে। আর জামায়াত শুরু থেকেই সংস্কার ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বিচার কাজে গুরুত্ব দিয়ে কথা বলছে। রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ ইস্যু ছাড়াও সম্প্রতি মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বিএনপির কোনো কোনো নেতা বক্তব্য দিলে তা নিয়েও দল দুটিতে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়। তবে সম্প্রতি দল দুটির নেতারা নির্বাচনের সময় প্রশ্নে একই ধরনের বক্তব্য দিচ্ছেন। অপরদিকে জুলাই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা নির্বাচনের চেয়েও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি সংস্কার ও আওয়ামী লীগের বিচার কাজ আগে সম্পন্ন করার কথা বলছেন। এই দুটি কাজ শেষ করে তারা নির্বাচনের পক্ষে।

গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দলের স্থায়ী কমিটির সভায় সিদ্ধান্তের কথা জানাতে সংবাদ সম্মেলন করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, দলের স্থায়ী কমিটির মনে করে যেহেতু নির্বাচন কমিশন ইতোমধ্যে গঠিত হয়েছে সেহেতু জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিলম্বিত হওয়ার কারণ নেই। ২০২৫ সালের জুলাই মাসের মধ্যেই নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব। এ বিষয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, নির্বাচন কমিশন ও সব রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐকমত্যে আসার আহ্বান জানিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রশ্নই ওঠে না।

তিনি বলেন, আমরা বারবার বলছি যে নির্বাচিত সরকারের কোনো বিকল্প নেই। এটা গণতন্ত্রের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমরা মনে করি যে, এ বছরের মাঝামাঝি সময়ে অর্থাৎ জুলাই-আগষ্টের মধ্যেই নির্বাচন সম্ভব। এ কারণে আমরা সরকারকে আহ্বান জানাতে চাচ্ছি, নির্বাচন কমিশনকেও আহ্বান জানাচ্ছি এবং রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিও আহ্বান জানাচ্ছি দেশের বৃহত্তর স্বার্থে এ বছরের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য ব্যবস্থা নিতে পারি।

মির্জা ফখরুল বলেন, নির্বাচন বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার যে বক্তব্য ছিল এ বছরের শেষের দিকে অথবা আগামী বছরে অর্থাৎ ২০২৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে। এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটিতে সোমবার দীর্ঘক্ষণ আলোচনা হয়েছে। আমরা মনে করি যে, এত বিলম্বিত করার কোনো কারণ নেই।

তিনি আরও বলেন, যেহেতু নির্বাচন কমিশন গঠন হয়ে গেছে এবং মোটামুটি একটা স্ট্যাবিলিটি এসেছে, সেক্ষেত্রে এ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য মনে হয় যে আজ বুধবার সংস্কার সংক্রান্ত কমিশনের রিপোর্ট এসে যাবে। সুতরাং মনে হয় না আরও বিলম্বিত করার কোনো কারণ আছে। যত বিলম্ব হচ্ছে ততই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট বৃদ্ধি পাচ্ছে।

বিএনপি মহাসচিব বলেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রশ্নই ওঠে না। আমরা আগে সংসদ নির্বাচন চাই। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে মির্জা মির্জা ফখরুল বলেন, স্থানীয় সরকারের নির্বাচনের বিষয়ে আমাদের সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত হচ্ছে, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকারের নির্বাচনের কোনো প্রশ্নই আসে না। কারণ এখন পুরো দেশের, জাতির ফোকাসটা হচ্ছে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ওপরে।

এদিকে, গত ১১ জানুয়ারি শনিবার বিকেলে চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ সরকারি মডেল পাইলট হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজ মাঠে উপজেলা জামায়াত আয়োজিত কর্মী সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ও সাবেক সংসদ ড. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের বলেছেন, প্রয়োজনীয় সংস্কার করে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন দিয়ে জনগণের সরকারের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। তিনি বলেছেন, সংস্কারের নামে ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করবেন, জনগণ তা মানবে না। তিনি বলেন, জাতীয় ঐক্যের বিকল্প নেই। ঐক্যবদ্ধ থাকলে কোনো দেশ আমাদের কাবু করতে পারবে না। এই মুহূর্তে দেশের বড় দুটি রাজনৈতিক দল বিএনপি-জামায়াতকে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। মত-পার্থক্য থাকবে এবং থাকতে পারে। তা যেন মতবিরোধে রূপান্তরিত না হয়। আমরা ভারতসহ সব দেশের সঙ্গে সু-সম্পর্ক রাখতে চাই। তবে ভারত প্রভুর আচরণ করলে, তা মেনে নেওয়া হবে না। জামায়াতের এই নেতা অন্তর্বর্তী সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, যে আশা আকাক্সক্ষা নিয়ে ৫ আগস্ট ঘটেছিল, তা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন হচ্ছে। এ পরিবর্তন আমরা চাই না। উপদেষ্টা সদস্যদের মধ্যে ভূত রয়েছে, এ ভূত তাড়ান। তা না হলে জনগণ তাড়াবে।

এদিকে, গত ৭ জানুয়ারি বিকেলে ফরিদপুর সরকারি রাজেন্দ্র কলেজ মাঠে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমাবেশে জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক ও বৈষম্যবিরোধী জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সম্পাদক সারজিস আলম বলেন, যারা ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য মানুষের রক্ত ও জীবনকে বিন্দুমাত্র মূল্য দেয় না, তাদের বাংলার মানুষ ক্ষমতায় দেখতে চায় না। দেশের মানুষের জীবনের দিকে আর যদি কোনো শকুন দৃষ্টি দেয়, তাহলে তার চোখ উপড়ে ফেলব আমরা। হোক সে দেশের ভেতরের শক্তি বা বাইরের শক্তি। আমরা আগে বিচার চাই, নির্বাচন পরে।

সারজিস আলম বলেন, আমরা আমাদের শহীদ ভাইদের হত্যার বিচার চাই। শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আসবে ঠিকই, তবে দেশে এসে সরাসরি বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াবে। সংবিধানের একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় জুলাই অভ্যুত্থানের স্বীকৃতি থাকতে হবে। এই অভ্যুত্থানের স্বীকৃতি সংবিধানে লিপিবদ্ধ থাকতে হবে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, এখন পর্যন্ত অনেকে আমাদের বিপ্লবকে অনেকে মেনে নিতে পারেনি। সেই জন্য কিছু দিন পর পর আমরা দেখি, বিচার বিভাগে ক্যু করা হয়, পুলিশ-আনসারে বিদ্রোহ হয়, সচিবালয়ে আগুন লাগানো হয়। হাসনাত বলেন, আপনাদের প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতার সঙ্গে যদি তরুণ প্রজন্মের আত্মবিশ্বাস ও ফ্যাসিবাদকে উৎখাতের প্রত্যয়ের সম্মিলন না ঘটাতে পারেন, তাহলে ২৪-পরবর্তী বাংলাদেশ বিনির্মাণে আমরা ব্যর্থ হব। তাই আপনারা এই তরুণ প্রজন্মকে স্বীকৃতি দিন।

তিনি বলেন, অতীতে ঢাকার ক্ষমতার চেয়ারে কে বসবে, সেটি নির্ধারণ করা হতো দিল্লি থেকে। আমাদের নতজানু পররাষ্ট্রনীতির কারণে দেখেছি নির্বাচনের আগে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো দিল্লিমুখী হতো। আমরা স্পষ্টভাবে বলতে চাই, এ দেশের জনগণই ঠিক করবে কে ঢাকার মসনদে বসবে। তিনি বলেন, জুলাই বিপ্লবে গণহত্যার বিচার, গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার শেষ হওয়ার পরে নির্বাচন হবে। অন্যথায় যার জীবন দিয়েছে তাদের আত্মত্যাগ বৃথা যাবে।

 

ভোরের আকাশ/রন