বাংলাদেশের পরিবেশের অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে। ঢাকার বায়ুদূষণ বিশ্বে শীর্ষ ৫-এ থাকছে নিয়মিতই। এদেশে পাহাড়-টিলার শরীরে নিয়মিত কোপ পড়ছে। ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে প্রকৃতির এই অমূল্য সম্পদ। পাহাড়-টিলা কেটে বিরানভূমি বানানোর দৌরাত্ম্য এ দেশে নতুন নয়। সংবাদমাধ্যমে এসব নিয়ে বহু লেখালেখি হওয়া সত্ত্বেও কোনো সরকারের আমলেই এটা থামেনি, বরং উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে। গণঅভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগে এটা আরও বহুগুণ বেড়েছে। বিশেষ করে সিলেট অঞ্চলেই পাহাড় কেটে ভূমি দখল ও পাথর চুরির ঘটনা বেশি ঘটছে। পরিবেশবাদীদের অভিযোগ, আইন অমান্য করে সিলেটে এখনো দেদার পাহাড়-টিলা কাটা চলছে। তারা বলছেন, টিলা কাটার কারণে প্রাণহানিও হচ্ছে। ২০১২ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সিলেটে ৫১ জন নিহত হয়েছেন।
সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার শাহ আরেফিন টিলার পাথর লুট করে কঙ্কাল বানিয়ে ফেলেছে দুর্বৃত্তরা। এই পাথর লুটে কারা জড়িত তাদের তালিকাও স্থানীয় প্রশাসনের কাছে নেই। স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে স্থানটি ‘পাথরের খনি’ হিসেবে পরিচিত ছিল। চূড়া আর টিলার ভাঁজে ভাঁজে এক সময় ছিল সবুজ গাছ-পালা। ‘পাথরখেকোদের’ লুটপাটে ধীরে ধীরে সাবাড় হতে থাকে পাথর, সুউচ্চ টিলার জায়গায় এখন গভীর গর্ত। চক্রটি খোঁড়াখুঁড়ি করে টিলা দুটির অন্তত ৮৫ শতাংশ জায়গা থেকে পাথর আর মাটি লুট করে নিয়েছে।
স্থানীয়রা ২০০০ সালের দিকে এসব টিলায় পাথরখেকোদের প্রথম নজর পড়ে। এরপরই প্রকাশ্যে চলতে থাকে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন। ২০১৪ থেকে ২০১৫ সালের দিকে এখানে পাথর উত্তোলনে অবৈধ ‘বোমা মেশিনের’ (পাথর ভাঙার কল) ব্যবহার শুরু হয়। গত আড়াই দশকে পাথর ও মাটি সাবাড় করে নেওয়ায় এক সময়ের অনিন্দ্যসুন্দর টিলা দুটি এখন অনেকটা ‘কঙ্কাল’ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
সিলেটের পরিবেশকর্মীরা জানিয়েছেন, স্থানীয় প্রশাসনকে ‘ম্যানেজ’ করে পাথরখেকো চক্রটি দিনের পর দিন শাহ আরেফিন টিলা ও আশপাশের এলাকায় খোঁড়াখুঁড়ি করে ও বোমা মেশিন চালিয়ে অবৈধভাবে পাথর ও মাটি উত্তোলন করে আসছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) তথ্য মতে, এসএ রেকর্ড অনুযায়ী সিলেটে ২০০৯ সালে টিলার সংখ্যা ছিল ১ হাজার ২৫টি। এখন এটা পৌঁছেছে মাত্র ৫৬৫টিতে। সিলেটের টিলাগুলো মূলত ধ্বংস হচ্ছে সরকারি ও ব্যক্তি উদ্যোগ, শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা এবং আইন প্রয়োগের অভাবে। বর্তমান পৃথিবীর তিনটি বড় বিপর্যয়ের একটি হচ্ছে পরিবেশ বিপর্যয় এবং ভূপ্রকৃতি ও ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ, তা সত্ত্বেও প্রাণ-প্রকৃতি ধ্বংস করে এখানে যে ধ্বংসযজ্ঞ চলছে তা আমাদের ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত হুমকি স্বরূপ। আমরা জানি পাহাড়-টিলা কেবল প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষা করে তা না, ভূমিকম্পের হাত থেকে রক্ষার জন্য পাহাড়-টিলা ভূপৃষ্ঠের পেরেক হিসেবে কাজ করে। চ্যুতি রেখা বা ফল্ট লাইনের কারণে সিলেট অঞ্চলটি বিশেষভাবে ভূমিকম্পপ্রবণ। অতীত ইতিহাস বলছে, সিলেট অঞ্চল বরাবরই ভূমিকম্পপ্রবণ। ১৫৪৮ সালে প্রচণ্ড ভূমিকম্পে সিলেট এলাকায় ব্যাপক ভূ-পরিবর্তন ঘটে। উঁচু-নিচু ভূমি সমতলে পরিণত হয়। এরপর ১৬৪২, ১৬৬৩, ১৮১২ ও ১৮৬৯ সালের ভূমিকম্পে সিলেটের মানচিত্র পাল্টে যায় অনেকটাই।
এ রকম এক ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে যে হারে দেদার পাহাড়-টিলা কাটা হচ্ছে তা কোনোভাবেই সুবুদ্ধির পরিচয় নয়। প্রশাসন কোনোভাবেই এ ব্যাপারে অন্ধ থাকতে পারে না। যখন প্রয়োজন অতিরিক্ত নজরদারি ও সচেতনতার সঙ্গে এসব অঞ্চল রক্ষা করা, তখন প্রশাসনের অবহেলায় এসব ঘটনা ঘটে তা অত্যন্ত দুঃখজনক। প্রশাসনের সচেতনতায় এখনো হয়তো শেষ রক্ষা সম্ভব। ক্ষতি যা হওয়ার হয়েছে, আর যেন না হয় সে ব্যাপারে এখনই সচেতন হতে হবে। আরেফিন টিলাসহ সিলেট ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের সমস্ত পাহাড়-টিলা-বনাঞ্চল রক্ষার জন্য সরকারকে এখনই তৎপর হতে হবে। আমাদেরও সচেতন হতে হবে। কেউ পাহাড়-টিলা কাটলে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
ভোরের আকাশ/রন