logo
আপডেট : ১৫ জানুয়ারি, ২০২৫ ১৫:১০
মানিকগঞ্জে
ফসলি জমি দখল করে ডেরা রিসোর্ট নির্মাণ
কৃষকদের আহাজারি
মানিকগঞ্জ প্রতিনিধি

ফসলি জমি দখল করে ডেরা রিসোর্ট নির্মাণ

মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার বালিয়াখোড়া ইউনিয়নের পুরান গ্রামের কৃষক রেজ্জাক মিয়া। ৩৯ শতাংশ জমি চাষাবাদ করে ভালোই চলছিলো তার দিনকাল। এক যুগ আগে তার এসব জমির উপর নজর পড়ে ডেরা রিসোর্ট কর্তৃপক্ষের। জোর করে কোন দলিল-দস্তাবেজ ছাড়াই রেজ্জাকের কাছ থেকে ফসলি জমি দখলে নেয় ডেরা রিসোর্ট। পরে ওই জমির বিনিময়ে একযুগেও কোন টাকা-পয়সা পাননি কৃষক রেজ্জাক মিয়া। একদিকে জমি হাতছাড়া, অন্যদিকে জমির বিনিময়ে টাকা না পাওয়ায় লোকসানে তিনি। জমি বা টাকা ফেরত পেতে দ্বারে দ্বারে ঘুরেও কোন সুরাহা করতে পারেননি। রেজ্জাকের মতো এমন অসংখ্য কৃষকের জমি দখল করে ৩৩ একর জমিতে গড়ে তোলা হয়েছে ডেরা রিসোর্ট। প্রতিষ্ঠানটির এমন অনিয়মের প্রতিবাদ করায় কৃষকরা ফেঁসেছেন মামলার জালে। কোথাও কোন সমাধান না পাওয়ায় সম্প্রতি কৃষকরা তাদের দাবি আদায়ে রাস্তায় নেমেছেন, করেছেন মানববন্ধন। কৃষকদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে ডেরা রিসোর্টের অসামাজিক কার্যকলাপ বন্ধে জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছেন আলেম-ওলামা, বৈষমী বিরোধী ছাত্র-জনতা। ডেরা রিসোর্ট কর্তৃপক্ষের দাবি, দ্রুত কৃষকদের বকেয়া টাকা পরিশোধ করবেন তারা।

অনুসন্ধান বলছে, শুধু কৃষকদের কাছ থেকে জোর করে জমি নিয়ে ক্ষান্ত হননি প্রতিষ্ঠানটি। সরকারি খাস জমি নানা অপকৌশলে ডেরা রিসোর্টের নামে করে নিয়েছেন তারা। ওই সময় প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিরা বিষয়টি জানলেও বেহাত হওয়া জমি উদ্ধারে কেউ উদ্যোগ নেননি।

কৃষক ইসমাইল হোসেন বলেন, "যেখানে ডেরা রিসোর্ট ওইখানে আমার ১৩ শতক জমিতে ১০৩টা ইউক্যালিপটাস গাছ ছিল, যার একটাও আমায় কাটতে দেয়নি। গাছের তখনকার বাজার মূল্যই ছিল ৬-৭ লাখ টাকা। জমি এবং গাছের কোন টাকাই আমি পাইনি। অনেক তাগো (দখলকারী এশিউর গ্রুপ) কাছে যাওয়ার চেষ্টা করেছি, কেউ দেখা করে না। উল্টা আমার নামে মামলা দিয়ে দিয়েছে। মামলায় ১২ বছর হাজিরা দিয়েছি। মামলায় জরাইয়া আমি এখন নিঃস্ব।"

বালিয়াখোড়া ইউনিয়নের পুরান গ্রামের কৃষক হযরত আলী বলেন, "ডেরা রিসোর্টের থাবায় কবরস্থানও নিঃস্ব হয়ে গেছে। জোর করে কবরস্থানে রিসোর্ট বানিয়েছে। ওই সময় নেতাদের ডরে কেউ কথা বলতে পারেনি। কবরস্থানের জন্য অন্য জায়গা দেওয়া হয়েছে। তবু কথা ছিলো, যাদের বাপ-দাদার কবর আছে, তারা রিসোর্টের কার্ড পাবেন। ওই কার্ড নিয়ে রিসোর্টে গিয়ে কবর জিয়ারত করতে পারবেন। কিন্তু কবরস্থান দখল করার পরে কার্ডও দেয়নি, কেউ কবর জিয়ারতও করতে পারেনি। কবরস্থানের জমিতে এখন হরিণ পালছে। এর চেয়ে কষ্টের আর কি হতে পারে?"

আরেক কৃষক সত্তার মিয়া বলেন, "জমির মূল্য পরিশোধ না করে দখল নিয়ে রিসোর্ট নির্মাণ করায় কৃষকদের সাথে ডেরা রিসোর্টের দ্বন্দ্ব শুরু হয়। তাদের সাথে আওয়ামী লীগের নেতাদের সখ্যতা থাকায় ও মামলার ভয়ে ওই সময় অনেকে আর তাদের বাঁধা দিতে পারেননি। এখন কৃষকরা সবাই একজোট হয়ে তাদের দাবি আদায়ে সোচ্চার হয়েছেন। শুধু জমির টাকা ফেরত নয়, কৃষকদের সাথে যে অন্যায় করা হয়েছে তার শাস্তি চাই আমরা।"

এলাকাবাসীর ভাষ্য, ডেরা রিসোর্ট কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠানটির সূচনা লগ্ন থেকেই এলাকার কৃষকদের সাথে মিথ্যাচার করেছেন। প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিলো কৃষি জমিতে আধুনিক এগ্রো ফার্ম নির্মাণ করা হবে। সেই অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটি জমি কিনতে শুরু করে। ওই জমিগুলোতে কয়েক বছর এগ্রো ফার্মকেন্দ্রিক কার্যক্রম থাকলেও পরে তারা রিসোর্টে পরিণত হয়। সবার সামনে এগ্রো বিষয়টি নিয়ে আসলেও তাদের মতলব ছিলো ভিন্ন। ব্যবসায়িক কৌশল হিসেবে তারা এগ্রোকে দৃশ্যমান করে ডেরা রিসোর্ট করেছেন। ফলে প্রথম দিকে স্থানীয়রা এগ্রো বিষয়গুলোকে এলাকার উন্নয়ন চিন্তা করে তেমন বাধা দেননি। পরবর্তীতে জমি দখল শুরু করলে বাঁধা দিলেও প্রভাবশালীদের তোপের মুখে আর মামলা-হামলার ভয়ে মুখ খোলার সাহস পাননি তারা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দ্বিতীয় মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর স্থানীয় সাবেক এমপি নাঈমুর রহমান দুর্জয় ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফের সহযোগিতায় বালিয়াখোড়া গ্রামে অত্যাধুনিক এগ্রো ফার্ম করতে কৃষি জমি দখলে নেওয়া শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। ওই জমি দখল করে মাটি ভরাট করে ডেইরি ফার্ম নির্মাণ করা হয়। পরে ২০২২ সালে ওই ডেইরি ফার্ম এলাকায় এশিউর গ্রুপের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ডেরা রিসোর্ট এন্ড স্পা সেন্টার নামে পাঁচ তারকা মানের রিসোর্ট নির্মাণ করা হয়। ডেইরী ফার্মের সাইনবোর্ড থাকা অবস্থায় চারিদিকে নিরাপত্তা বেষ্টনি দিয়ে শুরু হয় রিসোর্ট নির্মাণের কাজ। সে সময় এ বিষয়টি নিয়ে এলাকাবাসীর সমালোচনার মুখে পড়ে কাজ বন্ধ রাখা হয়। এলাকাবাসীকে দমাতে তাদের মামলায় ফাঁসানো হয়। পরে স্থানীয় সংসদ সদস্য এবং জেলা আওয়ামী লীগের ঊর্ধ্বতন নেতাদের আশকারায় রিসোর্টের কাজ পুরোদমে চালু হয়। দুই বছর কাজ শেষে ২০২২ সালের জুলাই মাসের ৫ তারিখে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন হয় পাঁচ তারকা মানের এই অবকাশযাপন কেন্দ্রটির।

রিসোর্টটির তথ্য বলছে, হেরিটেজ কটেজে ৩টি রুম, হাব কটেজে ৪টি রুম, সুপেরিয়র ফ্যামিলি কটেজে ২টি রুম, প্রেসিডেন্সিয়াল কটেজে ৩টি রুম, গল্ফ ভিউ ৫টি কটেজে মোট ১০টি রুম, ভিআইপি কটেজে ২টি রুম, লেকসাইড ৭টি কটেজসহ মোট ১৪টি রুম রয়েছে। এছাড়াও রয়েছে মিটিং এন্ড কনফারেন্সের জন্য ৪৫শ স্কয়ার ফিটের শোভা ব্যাঙকুয়েট হল, সিনেপ্লেক্স, ট্রি হাউস, ওয়েভ পুল, গ্রিনহল, সুইমিংপুল, গল্ফ গ্রাউন্ড, জিমনেশিয়াম, এভি সিস্টেমসহ মিটিং রুম, ছোট-বড় মিলিয়ে ৩৬টি হলরুম, কায়াকিং করার সুবিধা। রিসোর্টটির বড় এডভেঞ্চার এখানকার স্পা সেন্টার। রিসোর্টটিতে ন্যূনতম ভাড়া শুরু হয় প্রতি রাতের জন্য ৮ হাজার টাকা। কক্ষের রকম বা সুযোগ-সুবিধা ভেদে ৫০ হাজার টাকা প্রতি রাতের ভাড়া এমন কক্ষও রয়েছে রিসোর্টটিতে। কনফারেন্স রুমের ভাড়া দৈনিক ২ লাখ টাকা।

এ বিষয়ে ডেরা রিসোর্ট এন্ড স্পা সেন্টারের ব্যবস্থাপক ওমর ফারুক বলেন, "এটা একটা এগ্রো বেইজড রিসোর্ট। আমরা বাংলাদেশে এগ্রো রিসোর্টের জন্য উদাহরণ। আমাদের এখানে বিভিন্ন ধরণের কৃষি চাষ এবং আবাদ আছে। আমরা এখানে হাঁস, গরু, মাছ এবং বিভিন্ন অর্গানিক শাক-সবজি, কলা, লেবু, সরিষা, আলু চাষ করি। যেটা এখান থেকে আমাদের অতিথিরাও নিয়ে থাকেন, আবার আমরা নিজেরাও ব্যবহার করি। আমাদের আগের যে এগ্রো লাইসেন্স সেটি রিসোর্ট লাইসেন্সে রূপান্তর করে এখন রিসোর্ট লাইসেন্স হিসেবে পরিচালিত হচ্ছে। কয়েকজন কৃষকের টাকা প্রক্রিয়াগত কারণে আংশিক পরিশোধ হয়নি। দ্রুত তাদের বকেয়া টাকা পরিশোধ করা হবে। গ্রামবাসীর বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে ভয় দেখিয়ে জমি দখলে নেওয়া হয়েছে, এমন প্রশ্নের বিষয়ে তিনি বলেন, "আমি এই প্রতিষ্ঠানটিতে দুই বছর যাবত কর্মরত আছি। আমাদের হিস্ট্রিতে এমন কোন ঘটনা নেই। এগুলো সব মিথ্যা বানোয়াট।"

মানিকগঞ্জের জেলা প্রশাসক ড. মানোয়ার হোসেন মোল্লা বলেন, "ডেরা রিসোর্টের বিষয়ে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসব অভিযোগ খতিয়ে দেখে অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া গেলে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।"

 

ভোরের আকাশ/রন