logo
আপডেট : ১৬ জানুয়ারি, ২০২৫ ১২:০৮
সরকারি মাল দরিয়া মে ঢাল...
সিরাজুল ইসলাম

সরকারি মাল দরিয়া মে ঢাল...

১. আওয়ামী লীগের টানা সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামল নানা কারণে আলোচিত-সমালোচিত। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র; পায়রা সমুদ্র বন্দর; মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র; রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র; ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল; বঙ্গবন্ধু টানেল; পদ্মা সেতু; শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনালসহ বড় বড় প্রকল্প গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন করে গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিদেশেও ভূয়সী প্রশংসা পেয়েছিলেন। খোদ পাকিস্তানের মিডিয়াতেও তার প্রশংসা করে নিবন্ধ প্রকাশ করা হয়েছে। আবার গুম-খুন, বিরোধী দল দমন-পীড়নের অভিযোগে তিনি সমালোচিতও হয়েছিলেন। এ সবের বাইরে তার দীর্ঘ শাসনামলে একটা শ্রেণি টাকা কামানোর নেশায় বুঁদ হয়েছিলেন। আরেকটা শ্রেণি ছিল লুটপাট ও পাচারে ব্যস্ত। রাজনীতিক থেকে আমলা - কেউ যেন কারো যে কম যাননি। যে যেভাবে পেরেছেন; দুহাতে লুটে নিয়েছেন সরকারি মাল। বিষয়টি বোধ হয় শেখ হাসিনা নিজেও টের পেয়েছিলেন। এ কারণে তিনি প্রায়ই বলতেন ‘সরকারি মাল, দরিয়া মে ঢাল (সরকারি মাল পানিতে ঢেলে দাও)’ হবে না। দুর্নীতির বিরুদ্ধে তিনি ‘জিরো টলারেন্স নীতি’ ঘোষণা করেছিলেন। বাস্তবে সেটা যে খুব কাজে আসেনি; তা এখন প্রমাণ হচ্ছে। প্রতিদিনই তার সাবেক মন্ত্রী, এমপি ও আমলাদের দুর্নীতির খবর বের হচ্ছে। গণমাধ্যমের কিছু খবর দেখে তো ভিমড়ি খাওয়ার অবস্থা। মনে হয় লুটপাটের একটা সাগরে আমরা হাবুডুবু খাচ্ছি।

ডিজিটাল বাংলাদেশের নামে সাড়ে ১৫ বছরে ৬৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেছে আওয়ামী লীগ সরকার। আইসিটি বিভাগ ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ৫৩টি প্রকল্প ও ৩৪টি কর্মসূচি হাতে নেয়। এগুলোর ২২টি প্রকল্প এখনো চলমান। বাকিগুলো বাস্তবায়ন শেষ। এতে সব মিলিয়ে ব্যয় প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। এর বাইরেও বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ ডিজিটালাইজেশন-সংক্রান্ত প্রকল্প নিয়েছে। ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের নেওয়া প্রকল্পের ব্যয় ৪০ হাজার কোটি টাকা। বিপুল এই অর্থ খরচ করেও ডিজিটাল সেবা; তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে দুর্নীতি কমানো; মানবসম্পদ ও দক্ষতা উন্নয়ন; আইসিটিসেবা রপ্তানিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। আইসিটি খাতে অনেক প্রকল্প নেওয়া হয়েছে; যেগুলোর কার্যত তেমন সুফল নেই। সম্ভাবনার নামে ‘গালগল্প’ শুনিয়ে অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে। তারপর দেখা গেছে, সেই অবকাঠামো তেমন কাজে আসছে না। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কম। প্রশিক্ষণের নামে শত শত কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে; কিন্তু সুফল কম। আইসিটি বিভাগের প্রকল্পগুলোয় অতিরিক্ত ব্যয় ধরা; ঘনিষ্ঠ লোকদের কাজ দেওয়া; চাকরিতে স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি ও অনিয়মের বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। (প্রথম আলো, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৪)।

২. এবার ঘাস চাষ শিখতে বিদেশে যাওয়ার বায়না ধরেছেন সরকারের ৩২ কর্মকর্তা। ‘অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান’ অর্জন করতে তারা যেতে চান নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম। শুধু যেতে চান না। এরই মধ্যে তারা সকল আয়োজনও সম্পন্ন করে ফেলেছেন। তাদের কথিত জ্ঞান অর্জনের ব্যয় ধরা হয়েছে মাত্র ৩ কোটি ২০ লাখ টাকা। প্রত্যেকে খরচ বাবদ পাবেন ১০ লাখ টাকা। এই টাকা কিন্তু মোটেও কম না। ‘প্রাণীপুষ্টির উন্নয়নে উন্নত জাতের ঘাসের চাষ সম্প্রসারণ ও লাগসই প্রযুক্তি হস্তান্তর’ নামের এই প্রকল্পের কর্মকর্তারা যে প্রশিক্ষণের নামে বিদেশ ঘুরতে চান; তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে এই বিদেশ ভ্রমণ আটকে দেওয়ার কথা বলেছেন কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের প্রধান (অতিরিক্ত সচিব) মো. ছায়েদুজ্জামান। প্রকল্পের কর্মকর্তাদের ভাষ্য, নেপিয়ার ঘাসের চার-পাঁচটি জার্মপ্লাজম দেশে আনা হবে। এগুলো কীভাবে প্রস্তুত করা যায়, সে বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেবেন কর্মকর্তারা। সে বিষয়ে তিনটি দেশে কর্মকর্তারা যাবেন। কর্মকর্তাদের এই যুক্তি কারো কাছে সঠিক বলে মনে হবে। যদি প্রশিক্ষণের দরকার-ই হয়; তাহলে নিউজিল্যান্ড বা অস্ট্রেলিয়া থেকে একজন প্রশিক্ষককে এনে তারা প্রশিক্ষণ কেন নিচ্ছেন না? এতে তো নামমাত্র খরচ হওয়ার কথা। আসলে তারা সরকারি টাকায় ব্যক্তিগত শ্রাদ্ধ করার আয়োজন করছেন। এটাকে সরাসরি লুটপাটের আয়োজন বললে অত্যুক্তি হবে না বৈকি।

৩. ২০২০ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর অনলাইন পোর্টারগুলো একটি খবর প্রকাশ করে হই চই ফেলে দিয়েছিল। খবরে বলা হয়েছিল - এক হাজার সরকারি কর্মকর্তাকে খিচুরি রান্না শিখতে বা অভিজ্ঞতা অর্জন করতে বিদেশে পাঠানোর প্রস্তাব করেছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর (ডিপিই)। স্কুল ফিডিং কর্মসূচির আওতায় প্রশিক্ষণের জন্য তাদেরকে বিদেশ পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কর্মকর্তারা বাজার থেকে কীভাবে দ্রব্যাদি ক্রয় করা হয়; খিচুরি রান্নার নিয়ম এবং তা বিতরণের উপায় সম্পর্কে ধারণা নেবেন। এই বিদেশ যাত্রার জন্য পাঁচ কোটি টাকা এবং দেশেই প্রশিক্ষণের জন্য আরো ১০ কোটি টাকা চাওয়া হয়। বিষয়টি কিন্তু তখন হাসির খোরাক হয়েছিল। একই সঙ্গে মানুষের মাঝে ক্ষোভ সৃষ্টি করেছিল। যারা তখন বিদেশ যেতে চেয়েছিলেন; তারা কী কখনো খিচুড়ি খাননি? তাদের মা, বোন কিংবা স্ত্রী খিচুড়ি রান্না করেননি কখনো? তারা কখনো বাজার করেননি? এসব প্রশ্ন তুলেছিলেন অনেকে। মুদ্দা কথা হলো - তারা একটা হরিলুটের আয়োজন করার চেষ্টা করেছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত সেটা হয়নি কেবল সাংবাদিকদের লেখালেখির কারণে।

৪. গরিব মানুষকে হাত ধোয়া শেখাতে ২০২০ সালে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছিল জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর। এতে ব্যয় ধরা হয়েছিল ৪০ কোটি টাকা। প্রকল্পের নাম ছিল ‘মানবসম্পদ উন্নয়নে গ্রামীণ পানি সরবরাহ এবং স্বাস্থ্যবিধি’। প্রকল্পের আওতায় ৫ বছরে ৯ জনের বেতন-ভাতায় খরচ ধরা হয় ৩ কোটি টাকা। বিদেশ ভ্রমণের খরচ ধরা হয় ৫ কোটি। প্রকল্প পরিচালক আনোয়ার ইউসুফের ভাষ্য, ‘আমরা যেটা প্রস্তাব করলাম, সেটাই পাশ হয়ে যাবে - এমন তো নয়। ভালো-মন্দ দেখার জন্য তো একনেক ও প্ল্যানিং কমিশন আছে।’ পরে অবশ্য এই প্রকল্প পাস হয়েছিল কি না; তা জানা যায়নি। আনোয়ার ইউসূফের কাছে আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে - আপনি কী কখনো হাত ধোননি? খাওয়ার আগে-পরে; কিংবা শৌচকাজ শেষে আপনি হাত ধোন না? এর উত্তর যদি হ্যাঁ বলুন; তাহলে আপনি কেমনে এমন একটা প্রকল্পের প্রস্তাব করেন? আর যদি আপনার উত্তর ‘না’ হয়; তাহলে বলব - চালিয়ে যান। সরকারি চাকরি করছেন। লুটপাট করে সম্পদের পাহাড় না গড়লে কী হয়?

৫. কুকুর ব্যবস্থাপনা, হ্যান্ডলিং ও প্রশিক্ষণের জন্য ১৪ দিনের জন্য ইতালি যাচ্ছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সহকারী কমিশনার ওবাইন, সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) এম রাকিবুল হাসান ভুঁইয়া, ডিএমপির নায়েক মো. সালাউদ্দিন প্রধান, কনস্টেবল মজুবুর রহমান ও সুজয় মহন্তা জয়। তারা ১৪ জানুয়ারি থেকে ২৭ জানুয়ারি পর্যন্ত ইতালিতে অবস্থান। তামাম করপোরেশন পুলিশের ডগ স্কোয়াডের জন্য ইতালি থেকে ১০টি কুকুর কেনার দরপত্রে কার্যাদেশ পেয়েছে। মূলত এই কুকুরগুলো পরিচালনায় প্রশিক্ষণ নিতেই ইতালি যাওয়ার কথা দলটির। শর্ত অনুযায়ী সব খরচ বহন করবে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান। ৯ হাজার ৭২ মার্কিন ডলার বা বাংলাদেশি মুদ্রায় ১১ লাখ টাকা দরে কেনা হচ্ছে এসব কুকুর।

৬. আমি একেবারেই একজন সাধারণ মানুষ। পড়ালেখার দৌড়ও খুব বেশি না। জ্ঞান-গরিমা নেই বললেই চলে। আমলাতন্ত্রের জটিলতা; কিংবা রাজনীতির কঠিন হিসাব-নিকাশ বুঝি না। বোঝার চেষ্টাও করি না। তবে এতটুকু বলতে পারি - খিচুড়ি রান্না, হাত ধোয়া কিংবা ঘাষ চাষ শিখতে যারা বিদেশে যেতে চান; তাদের দিয়ে দেশ ও জাতির কিছুই হবে না। তারা জনগণের ট্যাক্সের টাকায় বেতন ভাতা নিচ্ছেন - এটা অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়।

লেখক : বার্তা সম্পাদক, দৈনিক ভোরের আকাশ

 

ভোরের আকাশ/রন