logo
আপডেট : ১৮ জানুয়ারি, ২০২৫ ১০:১২
অস্তিত্ব সংকটে আ.লীগ
নিখিল মানখিন

অস্তিত্ব সংকটে আ.লীগ

গণহত্যার অভিযোগে মামলা-গ্রেপ্তার এবং রাজনৈতিক দল ও সমন্বয়কদের হুমকির মুখে দৃশ্যত আওয়ামী লীগের কোনো কার্যক্রম নেই। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, কেন্দ্রীয় থেকে তৃণমূল পর্যন্ত কোনো পর্যায়েই দল গোছানো ও নির্বাচন নিয়ে ভাবনার কোনো সুযোগ পাচ্ছেন না নেতাকর্মীরা। শুধু তাই নয়, হামলা-মামলা আতঙ্কে অবাধে ‘দলীয় পরিচয়’ পর্যন্ত প্রকাশ করছেন না তারা। আর দলটির স্বার্থপর নেতাদের ওপর ক্ষুব্ধ কর্মী-সমর্থকরা।

গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে দেশত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত দলটির কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চোখে পড়েনি। এমনকি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে ১৫ আগস্ট শোক দিবস পালন করতেও দেখা যায়নি। ওই দিন ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে আওয়ামী লীগের কিছু নেতাকর্মী জড়ো হলে তাদের ওপর শিক্ষার্থীদের হামলার ঘটনা ঘটে। এরপর থেকে এক অর্থে আত্মগোপনে চলে যায় দলটি। নতুন কোনো কর্মসূচিও ঘোষণা দেয়নি আওয়ামী লীগ। ইতোমধ্যে নিষিদ্ধ করা হয়েছে আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে। তবে, নতুন বছরে দলটি আবারও মাঠের রাজনীতিতে সক্রিয় হতে যাচ্ছে। দেশ-বিদেশে নিজেদের জানান দিতে ইতোমধ্যে লবিস্টও নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সাড়া মিলছে না।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বছরের পর বছর ধরে দলটির ‘পরিবার ও উত্তরাধিকারতন্ত’ ভিত্তিক রাজনীতির কষাঘাতে জর্জরিত লাখ লাখ ত্যাগী ও বঞ্চিত নেতাকর্মী। নিজেদের আখের গুছিয়ে পলাতক নেতারা, আর বঞ্চিত নেতাকর্মীকেই সহ্য করতে হচ্ছে কষ্ট-যন্ত্রণা। তাই পলাতক নেতাদের কর্মসূচি পালনে সাড়া দিচ্ছে না ক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা।

আওয়ামী লীগের এমন পরিস্থিতি নিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বিবিসি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগের জন্য বাস্তবতা প্রতিকূল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এমনকি গত ৫ আগস্টের পর দলটিকে নিষিদ্ধ করার মতো দাবিও উঠেছে বিভিন্ন পক্ষ থেকে। যদিও কোনো কোনো রাজনৈতিক দল আবার এর বিরোধিতাও করেছে। তবে আদালতে জুলাই গণহত্যার বিচারে দোষী সাব্যস্ত হলে বিচারিকভাবেই নিষিদ্ধ হওয়ার ঝুঁকি আছে আওয়ামী লীগের। ফলে তেমন পরিস্থিতিতে পড়ার আগেই কর্মসূচি বাস্তবায়নের মতো সাংগঠনিক অবস্থা তৈরি করতে চায় আওয়ামী লীগ।

দলটি মনে করছে, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন কারণে অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে তাদের ভাষায় ‘জনরোষ এখন সময়ের ব্যাপার’। ফলে বিভিন্ন ইস্যুতে মাঠে নামার পর সেখানে জনসমর্থন পাওয়া যাবে বলেই আশাবাদী আওয়ামী লীগ। যদিও রাজনীতির জটিল সমীকরণ যে এতো সরলভাবে মিলে যাবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।

বিবিসির প্রতিবেদনে জানানো হয়, তৃণমূলের নেতারা দলের নির্দেশনা নিয়ে অন্ধকারে আছেন। তার চেয়ে বেশি ক্ষুব্ধ হয়ে আছেন দলের দুর্নীতিবাজ ও অযোগ্য নেতাদের উপর। তাদের দাবি, এইসব নেতাদের জন্যই দলের এই অবস্থা।

জনরোষ আতঙ্ক : রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, আওয়ামী লীগের সব পর্যায়ের নেতাকর্মীরা ‘জনরোষ আতঙ্কে’ ভুগছেন। দলটির কেন্দ্রীয়, বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের প্রথম সারির প্রায় সকল নেতাই পলাতক আছেন। গ্রেপ্তার হয়ে অনেকে জেলে আছেন। একাধিক মামলার শিকার অসংখ্য নেতাকর্মী এখনও জামিন পাননি। দলীয় পরিচয় দিলেই বা দলীয় লোক চিহিৃত হলেই প্রতিদিন জনরোষের শিকার হচ্ছেন নেতাকর্মীরা।

নেতাদের ওপর ক্ষুব্ধ কর্মী-সমর্থকরা : আজ কোথায় গেল এত আওয়ামী লীগ-এমন প্রশ্ন সর্বসাধারণের। গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর রাজনৈতিক মাঠে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের দেখা নেই। নেতারা গেছেন আত্মগোপনে। আর দিশেহারা কর্মীরা হয়ে গেছেন নীরব। কর্মসূচি গ্রহণ তো দূরের কথা, বাসা-বাড়ি থেকে বের হওয়ার নিরাপদ পরিবেশ এখনও তৈরি হয়নি। তবে তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয় থাকার চেষ্টা করছেন বলে জানান আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।

দলটির নেতাকর্মীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, দলটি এখন নেতৃত্ব শূন্যতায় ভুগছে। মাত্র চার মাসের ব্যবধানে পরিস্থিতি এখন পুরোপুরি পাল্টে গেছে। দলটির নেতাকর্মীদের অনেকেই এখন উদ্বগ ও আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। সংবাদমাধ্যমে কথা বলার সময় তারা তাদের নামও প্রকাশ করতে চাননি। আওয়ামী লীগের জেলা পর্যায়ের একজন নেতা বলেন, ‘আমাদের দলের এখন দিশাহারা বিপর্যস্ত অবস্থা হয়ে গেছে। কারণ একমাস হয়ে গেলো অথচ কেন্দ্র থেকে কার্যকর কোনো নির্দেশনা দেওয়া হলো না। ফোন দিলেও কেউ ধরে না। হামলা-মামলা সব মিলিয়ে নেতাকর্মীরা হতাশ হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় নেতাকর্মীদের অনেকে রাজনীতি ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবছেন।’

আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতাকর্মীরা বলছেন, ‘পরিবার ও উত্তরাধিকার তন্ত্র’ দলটির স্বাভাবিক কাঠামো তছনছ করে দিয়েছে। স্বার্থপর নেতারা আওয়ামী লীগকে নিজেদের প্রতিষ্ঠান বানিয়ে ফেলেছিলেন। নিজেদের কতিপয় লোকজন দিয়েই সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন। তাদের অসৎ স্বার্থবিরোধী ও মতামতের বিরুদ্ধে গেলেই গ্রুপ থেকে বাদ পড়তেন ত্যাগী নেতারা। কেন্দ্র থেকে ইউনিয়ন পর্যন্ত ত্যাগী ও বঞ্চিত নেতারা কোণঠাসা হয়ে পড়েছিলেন।

অভিযোগ রয়েছে, অধিকাংশ এলাকায় আওয়ামী লীগের উপজেলা ও ইউনিয়ন কমিটি গঠনে একচ্ছত্র ক্ষমতা ব্যবহার করেছিলেন স্থানীয় সংসদ সদস্যরা। তাদের আশীর্বাদপুষ্ট লোকজন ছাড়া কমিটিতে স্থান পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছিল। এক্ষেত্রে যোগ্যতার বিষয়টি বিচার-বিবেচনায় আনা হয়নি। আওয়ামী লীগের বিভাগীয় টিম এবং জেলা নেতারাও কমিটি বাণিজ্যে জড়িয়ে গিয়েছিলেন। আর পদবঞ্চিত যোগ্য নেতারা তৈরি করেন পৃথক দলীয় বলয়। এটি শুধু আওয়ামী লীগ নয়, তার সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সব সংগঠনের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। তাই গোপন জায়গা থেকে যতই কর্মসূচি গ্রহণ করা হোক না কেন, নেতাকর্মী ও সমর্থকদের সাড়া সহজে পাবে না আওয়ামী লীগ।

আ.লীগকে চায় না সরকার, সমন্বয়ক ও দলগুলো : রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, আওয়ামী লীগের অস্তিত্ব দেখতে চায় না অন্তর্বর্তী সরকার এবং ছাত্র আন্দোলনের নেতারা। আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগকে দাঁড়াতে দিতে চায় না বিএনপিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল। ফলে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের পক্ষে সরকার, সমন্বয়ক ও রাজনৈতিকদলগুলোর বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর পরিবেশ ও সুযোগ পাচ্ছেন না। পরিচয় দিলেই শিকার হচ্ছেন জনরোষের।

টাইম ম্যাগাজিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য স্বাগত জানানো হবে তবে তার আগে জুলাই-আগস্টে ছাত্র আন্দোলনে হতাহতের ঘটনায় জড়িত আওয়ামী লীগ ও তাদের সহযোগীদের প্রত্যেকের বিচার নিশ্চিত করা হবে। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের যারা হত্যা ও নির্যাতনের জন্য দায়ী তাদের জবাবদিহির আওতায় আনা হবে। বিচারে অপরাধী প্রমাণিত না হলে তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণের অধিকার পাবে। যারা অপরাধী নয় তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য অন্যদের মতোই স্বাধীন। তাদের (আওয়ামী লীগ) বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ভিত্তিতে লড়াই করব আমরা। রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো এমনভাবে পুনর্গঠন করা হবে যাতে স্বৈরাচার আর কখনও ফিরে আসতে না পারে।

সম্প্রতি জাতীয় প্রেস ক্লাবের এক অনুষ্ঠানে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে ভারতে পালিয়ে যাওয়া আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা আবার ক্ষমতায় ফিরে আসুক বিএনপি তা চায় না। রাজনৈতিক দলগুলোর দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠেছিলেন শেখ হাসিনা। তিনি আবার ক্ষমতায় ফিরে আসুক বিএনপি তা চায় না।

গত বৃহস্পতিবার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেছেন, এই বাংলাদেশে হয় আওয়ামী লীগ থাকবে, না হয় আমরা থাকবো। হয় ফ্যাসিবাদ থাকবে, না হয় আমরা থাকব। এই দেশে যদি আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন করাতে হয় তাহলে সেটা আমাদের রক্তের ওপর দিয়ে করাতে হবে।

গত ৩ জানুয়ারি এক কর্মিসভায় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, কেউ কেই প্রশ্ন করেন আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ আবার ফিরবে কি না, কিন্তু বাংলাদেশের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের আর ফিরে আসার সুযোগ নাই।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তথ্য ও প্রযুক্তি উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, এখন বিভিন্ন জায়গায় কথা হচ্ছে আওয়ামী লীগ রাজনীতি করতে পারবে কিনা। আপনি যখন আওয়ামী লীগকে একটি ফ্যাসিস্ট রাজনৈতিক দল বলছেন, তখন প্রশ্ন আসে ফ্যাসিস্ট রাজনৈতিক দল গণতান্ত্রিক কাঠামোতে কীভাবে রাজনীতি করতে পারে? যদি আওয়ামী লীগ ফিরে আসে তাহলে গণঅভ্যুত্থান ও শহীদদের সাথে প্রতারণা করা হবে। আমাদের জীবন থাকতে আর তা হতে দেওয়া হবে না।

 

ভোরের আকাশ/রন