যে পাতায় লেখা হয়েছে সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যের বাণী, সে পাতা নিয়েই হট্টগোল, মারামারিতে ৩৩ জন আহত। এ রকম ঘটনা সম্ভবত বাংলাদেশেই সম্ভব। কারণ এ জাতি আজ কাণ্ডজ্ঞান হারিয়েছে, যৌক্তিক বুদ্ধি-বিচার হারিয়েছে। বিশেষ করে কিছু বিশেষ মহল সারাক্ষণই ঘোলা পানিতে রাঘব বোয়াল শিকারের পাঁয়তারা করে। এ ছাড়া এ ঘটনাকে আর কোনোভাবেই ব্যাখ্যা করা যায় না। গত বৃহস্পতিবার সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, পাঠ্যবই থেকে ‘আদিবাসী’ শব্দযুক্ত চিত্রকর্ম বাদ দেওয়ার প্রতিবাদে পাঠ্যপুস্তক ভবনের সামনে অবস্থান নেওয়া শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালিয়েছে ওই চিত্রকর্ম বাদ দেওয়ার পক্ষে অবস্থান নেওয়া অন্যপক্ষ। এতে অনেকে আহত হয়েছেন। বর্তমানে পরিস্থিতি স্বাভাবিক। পরিস্থিতি স্বাভাবিক বলতে পাঠ্যপুস্তক ভবনের সামনে আর অরাজকতা নেই; কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা চলছে। ঘটনা বিশ্লেষণে জানা যায়, নবম-দশম শ্রেণির বাংলা ভাষার ব্যাকরণ ও নির্মিতি বইয়ের পেছনের প্রচ্ছদে ‘আদিবাসী’ শব্দ সংবলিত একটি চিত্রকর্ম স্থান পেয়েছিল। সেখানে একটি গাছের পাঁচটি পাতায় লেখা ছিল ‘মুসলিম, হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ ও আদিবাসী’; পাশে লেখা ছিল ‘পাতা ছেঁড়া নিষেধ’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী ‘স্টুডেন্টস ফর সভারেন্টি’ ব্যানারে গত ১২ জানুয়ারি জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) ঘেরাও করার পর রাতে ওই বইয়ের অনলাইন সংস্করণ থেকে চিত্রকর্মটি সরিয়ে ফেলা হয়। এর প্রতিবাদে ১৫ জানুয়ারি (বুধবার) সকাল ১১টায় পাঠ্যপুস্তক ভবন ঘেরাওয়ের ঘোষণা দেয় ‘সংক্ষুব্ধ আদিবাসী ছাত্রজনতা’ নামে আদিবাসী শিক্ষার্থীদের একটি সংগঠন। পরে ‘স্টুডেন্টস ফর সভারেন্টি’ একই সময়ে পাঠ্যপুস্তক ভবন ঘেরাও করার ঘোষণা দেয়। দুপুর নাগাদ দুপক্ষের মারামারি লেগে যায়। এখন এক পক্ষ আরেক পক্ষকে দায়ী করছে। এবার শিক্ষাক্রম পরিবর্তন ও পাঠ্যবই পরিমার্জনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন শিক্ষাবিদ রাখাল রাহা। ‘স্টুডেন্টস ফর সভারেন্টি’-এর পক্ষ থেকে রাখাল রাহার বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হয়েছে যে, ‘পাতা ছেঁড়া নিষেধ’ গ্রাফিতিটি তিনিই সংযুক্ত করেছেন। ঘটনার আগের দিন থেকেই রাখাল রাহা ‘স্টুডেন্টস ফর সভারেন্টি’-এর কারও সঙ্গে কথা বলতে চাইছিলেন। অনেক যোগাযোগ করা হলেও তাদের কারও পক্ষ থেকে সাড়া পাওয়া যায়নি। ১৫ জানুয়ারি সকালবেলা রাখাল রাহা এনসিটিবি ভবনের সামনেও এসেছিলেন ‘স্টুডেন্টস ফর সভারেন্টি’-এর কারো সঙ্গে কথা বলতে। স্টুডেন্টস ফর সভারেন্টির কয়েকজন তার সঙ্গে কথা বললেও কোনো যৌক্তিক বুদ্ধির পরিচয় দেননি। পরের দিন (১৬ জানুয়ারি) সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিস্তৃত লিখে রাখাল রাহা নিজের অবস্থান ও ওই দিনের ঘটনার ব্যাখ্যা করেন। রাখাল রাহা জানান, পাঠ্যবই পরিমার্জনে কোনো সিদ্ধান্তই তিনি একা নেননি, গ্রাফিতিগুলো কমিটির ৫৭ জন মানুষ নির্বাচন করেছেন। এর সঙ্গে মন্ত্রণালয়সহ উপদেষ্টরাও জড়িত ছিলেন। রাখাল রাহা আরও জানান, তাও কোনো কথা থাকলে তারা যেন বলেন; কিন্তু রাখাল রাহার বক্তব্য অনুযায়ী, ‘স্টুডেন্টস ফর সভারেন্টি’-এর ছাত্রদের কথা বলতে আগ্রহী দেখা যায়নি, তারা বরং রাস্তায় গিয়ে হট্টগোল সৃষ্টি করেন। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রাপ্ত খবরে এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্যে এটাই বোঝা যাচ্ছে যে, অপ্রত্যাশিত অরাজকতা সৃষ্টির জন্য মূলত ‘স্টুডেন্টস ফর সভারেন্টি’ সংগঠনটিই বেশি দায়ী। বিভিন্ন ভিডিওতে দেখা গেছে তারাই বেশি মারমুখী। আহতদের মধ্যে বেশির ভাগই আদিবাসী বা পাহাড়ি। প্রথম প্রশ্ন, ‘আদিবাসী’ শব্দটি বাদ দেওয়ার জন্য তারা কেন চাপ সৃষ্টি করছে? তারা কারা তার সঠিক পরিচয়ও এখনো জানা যায়নি। যদিও দাবি করা হচ্ছে, তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক একটি ছাত্র-সংগঠন; কিন্তু বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত অনেক শিক্ষার্থী তাদের পরিচয় জানেন না বলে জানান। দ্বিতীয় প্রশ্ন, কিছুদিন আগ পর্যন্ত খুব একটা নামধাম শোনা না যাওয়া ছোট একটি সংগঠনের কী এমন শক্তি যে, তাদের হুমকি-ধমকির মুখে পাঠ্যপুস্তকের মতো রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পর্যন্ত পরিবর্তন এসে যায়? তার মানে কি শক্তি প্রদর্শন করে যে যার মতো এভাবে পাঠ্যপুস্তক পরিবর্তন করে ফেলতে পারবে? আর রাষ্ট্র বা সরকারও তা মেনে নেবে? সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এবং সংবাদমাধ্যমে ‘স্টুডেন্টস ফর সভারেন্টি’-এর এহেন হীন কাজের তীব্র নিন্দা প্রকাশ করেছে দেশের সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে শিক্ষাবিদ, রাজনীতিবিদরা।
ভোরের আকাশ/রন