অবশেষে বহুল প্রতীক্ষিত যুদ্ধবিরতি শুরু হয়েছে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায়। কয়েক ঘণ্টা বিলম্বের পর স্থানীয় সময় গতকাল রোববার (১৯ জানুয়ারি) বেলা ১১টা ১৫ মিনিটে (৯টা ১৫ জিএমটি) এই যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছে। এর পরপরই হাজারো ফিলিস্তিনি রাস্তায় নেমে আসেন। তারা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। দিনটি ছিল তাদের কাছে ঈদের মতো।
কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাজিদ আল-আনসারি গতকাল ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি শুরু হওয়ার কথা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, গাজায় যুদ্ধবিরতি শুরু হওয়ার পর ইসরায়েলের কাছে তিন জিম্মিকে তুলে দেওয়া হবে। তারা তিনজনই ইসরায়েলের নাগরিক। তিন জিম্মির নাম প্রকাশ করেছেন হামাসের সশস্ত্র শাখা ইজ্জেদিন আল-কাসেম ব্রিগেডের মুখপাত্র আবু ওবেইদা। তিনি বলেন, চুক্তির শর্ত অনুযায়ী আমরা তিনজনকে মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তারা হলেন— রোমি গোনেন (২৪), এমিলি দামারি (২৮) ও দোরোন স্টেইনব্রিচার (৩১)। এর আগে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কার্যালয় গতকাল সকালে তিন ঘণ্টা বিলম্বে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হবে বলে ঘোষণা দেয়।
গত শনিবার (১৯ জানুয়ারি) ভোরের দিকে ইসরায়েলের জোট সরকারের মন্ত্রিসভায় গাজায় যুদ্ধবিরতির চুক্তি অনুমোদন পায়। এর আগে গত শুক্রবার ইসরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তাবিষয়ক মন্ত্রিসভা যুদ্ধবিরতি চুক্তি অনুমোদন করে। চুক্তি অনুযায়ী, গাজায় স্থানীয় সময় গতকাল সকাল সাড়ে আটটায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা হয়নি। কয়েক ঘণ্টা বিলম্বের পর তা কার্যকর হয়।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালায় ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস। এই হামলায় ১ হাজার ২০০ জনের বেশি নিহত হন। জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যাওয়া হয় আড়াইশ জনের বেশি মানুষকে। তাদের মধ্যে অনেককে মুক্তি দিয়েছে হামাস। হামাসের হামলার দিন থেকেই গাজায় নির্বিচারে হামলা শুরু করে ইসরায়েল। গাজা কর্তৃপক্ষের হিসাবে, এই হামলায় এখন পর্যন্ত ৪৬ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ১ লাখ ১০ হাজারের বেশি মানুষ। বাস্তুচ্যুত হয়েছেন লাখো মানুষ।
উচ্ছ্বাস ও বেদনার মিশ্র প্রতিক্রিয়া: যুদ্ধবিরতি শুরুর পর গাজার রাস্তায় নেমে আসেন হাজারো ফিলিস্তিনি। তারা রাস্তায় নেমে উচ্ছ্বাস করেছেন। কেউ নেমেছেন যুদ্ধবিরতি উদযাপন করতে, কেউ প্রিয়জনদের কবর জিয়ারত করতে, আবার কেউ ফিরে যাচ্ছেন তাদের ধ্বংসস্তূপে পরিণত বাড়িতে।
গাজার মধ্যাঞ্চলের দেইর আল-বালাহতে আশ্রয় নেওয়া আয়শা বলছেন, ১৫ মাস ধরে মরুভূমিতে পথ হারানোর পর পানি খুঁজে পাওয়ার মতো মনে হচ্ছে। আমি যেন আবার বেঁচে উঠেছি। হামাসের সশস্ত্র যোদ্ধারা খান ইউনিস শহরের রাস্তায় গাড়ি চালিয়ে যাওয়ার সময় ভিড়ের মধ্যে জয়ধ্বনি ওঠে। উপস্থিত জনতা হামাসের আল-কাসাম ব্রিগেডকে শুভেচ্ছা জানায়। এক হামাস যোদ্ধা বলেন, এটি একটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধবিরতি, ইনশাআল্লাহ। আর যুদ্ধ হবে না।
আয়শা বলেন, আমাদের বাড়িঘর ধ্বংস হয়েছে, তাতে কিছু আসে যায় না। মৃত্যুর ভয় আর অনাহারের দুঃস্বপ্ন অন্তত শেষ হলো। যুদ্ধবিরতি গাজার ২৩ লাখ মানুষের জন্য নতুন আশার আলো দেখালেও, অনেকেই এই ক্ষতি আর ধ্বংসের বাস্তবতায় শোকগ্রস্ত। আহমেদ আবু আয়হাম বলেন, আমরা ভীষণ ব্যথিত। এটি উদযাপনের সময় নয়, বরং একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে কাঁদার সময়।
ইসরায়েলি হামলায় ৮ ফিলিস্তিনি নিহত: গাজা যুদ্ধবিরতি কার্যকরের নির্ধারিত সময়সীমা অতিক্রম হয়ে যাওয়ার কিছু পরই উত্তর গাজা উপত্যকায় হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। গতকাল বিমান হামলায় আটজন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
ফিলিস্তিনি বেসামরিক জরুরি পরিষেবা সংস্থা জানিয়েছে, ইসরায়েলি হামলায় অন্তত আটজন নিহত ও কয়েক ডজন মানুষ আহত হয়েছেন।
আন্তর্জাতিক সময় ভোর সাড়ে ছটায় যুদ্ধবিরতি কার্যকরের কথা ছিল। এর মাত্র এক ঘণ্টা আগে চুক্তি অনুযায়ী যে ৩৩ জন জিম্মিকে ছেড়ে দেওয়ার কথা ছিল, হামাসের কাছে তাদের নাম প্রকাশের দাবি জানান ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। নাম জানতে না পারার কিছুক্ষণ পরেই এই হামলা শুরু হয়।
স্বাস্থ্যকর্মীরা জানিয়েছেন, গাজা সিটির জেইতুন এলাকায় ট্যাংক দিয়ে হামলা চালানো হয়েছে। বিমান ও ট্যাংক হামলার কারণে উত্তরাঞ্চলীয় বেইত হানুন শহরের মানুষ আবার প্রাণভয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন। যুদ্ধবিরতি চুক্তি সম্পাদন হওয়ায় তারা নিশ্চিন্তে কেবল ঘরে ফিরেছিলেন।
এদিকে, হামাসপন্থি সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, রাফা থেকে ফিলাডেলফি করিডোর এবং মিসর ও গাজার সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে সেনা প্রত্যাহার শুরু করেছে ইসরায়েল।