বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ বন্ধুপ্রতিম দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ভারত ও চীন। দীর্ঘ সীমান্ত এবং বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে বিশেষ অবদান রাখায় বরাবরই ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক আছে। শেখ হাসিনা সরকারের টানা সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে ভারত ‘একটু বেশি’ সুবিধা পেয়েছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে তাদের বাড়াবাড়ির কারণে বাংলাদেশে ভারতবিরোধিতা চরম আকার ধারণ করে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন এবং ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার শপথ নেওয়ার পর ভারতবিরোধিতার আগুনে ঘি পড়ে। সেই সুযোগটা কাজে লাগাতে চায় চীন। শেখ হাসিনার সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকলেও তা আরও বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে বেইজিং। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেই চীনের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব অপরিসীম এবং এদেশে তাদের বিপুল বিনিয়োগ রয়েছে।
এছাড়া চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ কূটনীতিক সম্পর্ক রয়েছে। আবার ভারতের সঙ্গে তাদের রয়েছে বৈরিতা। একই সঙ্গে পাকিস্তান ও ভারত একে অপরকে চিরশত্রুই মনে করে। অন্যদিকে, এতদিন বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের শীতল সম্পর্ক ছিল। ড. ইউনূস ক্ষমতায় আসার পর সেই সম্পর্ক উষ্ণ হতে শুরু করে। ফলে পাকিস্তান ও চীন মিলেই বাংলাদেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা আরও বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। আর এর নেপথ্যে ভারতকে চাপে রাখার কৌশল বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
জানা গেছে, বেইজিংয়ে অস্ট্রেলিয়া ও এশিয়ার ২৫ দেশের জোট ‘বিওএও ফোরাম ফর এশিয়া’র সম্মেলন ২৫ থেকে ২৮ মার্চ অনুষ্ঠিত হবে। এতে যোগ দিতে ২৭-২৮ মার্চ প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে আনুষ্ঠানিকভাবে আমন্ত্রণ জানিয়েছে চীন। পাশাপাশি দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বসারও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান উপদেষ্টার জন্য চার্টার ফ্লাইটের ব্যবস্থার কথাও আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছে বেইজিং। এদিকে, দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে যোগ দিতে গতকাল সোমবার (২০ জানুয়ারি) বেইজিং গেছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন। তিনি আজ চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করবেন। বৈঠক ছাড়াও পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বেইজিং ও সাংহাইয়ের দুটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানে বক্তৃতা করবেন। দেশটির ব্যবসায়ীসহ শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করবেন।
উপদেষ্টার সফরকে কেন্দ্র করে ঢাকা-বেইজিং সম্পর্ক এগিয়ে নিতে অর্থনীতির পাশাপাশি স্বাস্থ্য খাতকে গুরুত্ব দিচ্ছে বাংলাদেশ। ঢাকায় একটি আধুনিক চীন-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল নির্মাণে চীনকে আহ্বান জানান হবে। আর এ বিষয়টিতে ইতোমধ্যে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে দেশটি। এ ছাড়া ঢাকার একটি হাসপাতালে ‘রিহ্যাবিলিটেশন ও ট্রমা সেন্টার’ স্থাপন করতে চায় চীন। আসন্ন সফরে বাংলাদেশিদের বিদেশে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে চীনের সহযোগিতা চাইবে ঢাকা। কুনমিংয়ে কিছু হাসপাতাল সুনির্দিষ্ট করে দেওয়ার আহ্বান জানানো হবে। যাতে দিল্লির পরিবর্তে সেখান থেকে চিকিৎসাসেবা নিতে পারে বাংলাদেশিরা।
দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে ২০১৬ সালের টেকসই পানি ব্যবস্থাপনাবিষয়ক সমঝোতা নবায়ন করবে দুই দেশ। এ সমঝোতার আওতায় তিস্তা প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই করেছিল চীন। এর মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে। বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর অংশে চীনের মেগা বাঁধ নির্মাণ নিয়ে আলোচনা হবে। তিব্বতে প্রায় ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রায় ১০০ বিলিয়ন ডলারের বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে দেশটি। ফলে নদীর ভাটির দেশগুলোর পানির প্রাপ্যতা নিয়ে তৈরি হয়েছে সংশয়। ইতোমধ্যে এ বাঁধ নির্মাণ নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে ভারত। বিষয়টি আলোচনায় থাকবে। আর বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তিস্তা নিয়ে আলোচনার সুযোগ রাখা হয়েছে।
ঢাকার চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন বলেন, তিস্তা নদীর সমন্বিত ব্যবস্থাপনা প্রকল্পে কমপক্ষে দুই কোটি বাংলাদেশি উপকৃত হবে। বাংলাদেশের অনুরোধে চীন এ প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই করেছে এবং এর বিস্তারিত বাস্তবায়ন পরিকল্পনা তৈরি করেছে। তিস্তার যৌথ প্রকল্পে নদী ব্যবস্থাপনা ও এর প্রযুক্তি নিয়ে চীনের অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের সঙ্গে বিনিময় করতে প্রস্তুত বেইজিং। এখন এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে কি না- সে সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ বাংলাদেশের। চীন বাংলাদেশের সিদ্ধান্তকে সম্মান করবে।
গত রোববার (১৯ জানুয়ারি) সকালে উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গিয়েছিলেন রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন। বৈঠক শেষে তিব্বতে বাঁধ নির্মাণ নিয়ে জানতে চাইলে উপস্থিত সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘এ বাঁধ নির্মাণের ফলে নদীর ভাটির দেশগুলোর ওপর কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না।’ দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বিনিয়োগ, বাণিজ্য ও প্রকল্প অর্থায়নের গুরুত্ব দেওয়া হবে। সুদের হার ২ শতাংশ থেকে কমিয়ে যৌক্তিক পর্যায়ে নিয়ে আসার পাশাপাশি ঋণের প্রতিশ্রুতি ফি দশমিক ৫ শতাংশ বাতিল চাইবে ঢাকা। এ ছাড়া আগের সমঝোতা অনুযায়ী চারটি জাহাজ সংগ্রহসহ বৈঠকে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলো নিয়ে আলোচনা করা হবে। বিশেষ করে যে প্রকল্পগুলোতে বর্তমানে অর্থায়ন বন্ধ রয়েছে। এ ছাড়া রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীনের সহযোগিতা চাইবে ঢাকা। বিশেষ করে জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিলে রোহিঙ্গাদের পক্ষে থাকার আহ্বান জানানো হবে চীনকে। সেই সঙ্গে চীন থেকে আরও বিনিয়োগ প্রত্যাশা করে বাংলাদেশ। গত ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর চীনই ২০ কোটি ডলারের ওপর বিনিয়োগ নিয়ে এগিয়ে এসেছে। এ ছাড়া বাংলাদেশের অন্যতম বাণিজ্যিক অংশীদার দেশটি। বিলম্বিত অর্থ দেওয়াসহ পণ্য ও এর কাঁচামালের অবাধ বাণিজ্যে সহযোগিতা চাইবে ঢাকা। সেই সঙ্গে স্বল্প আয়ের দেশ থেকে উত্তরণের পর অতিরিক্ত আরও তিন বছর চীনের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা চাইবে।
বাংলাদেশে বিপুল বিনিয়োগ : বাংলাদেশের বাজারে ব্যবসা ও বিনিয়োগে চীনের আধিপত্য বাড়ছে। ছোট-বড়-মাঝারি মিলিয়ে অন্তত ২৫টি প্রকল্প চলমান রয়েছে। এ ধরনের নয়টি বৃহৎ প্রকল্পেই চীনের বিনিয়োগ ৮ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার; যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ১ লাখ কোটি টাকার বেশি। এর প্রায় ৭০ শতাংশই হয়েছে বিআরআইয়ের (বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ) আওতায়। বাংলাদেশে বিনিয়োগকারী একক দেশ হিসেবে চীনের অবস্থান দ্বিতীয়। প্রথম জাপান। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। এসব প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে- পদ্মা সেতুতে রেলসংযোগ, কর্ণফুলী টানেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, বাঁশখালী বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র, ন্যাশনাল ডেটা সেন্টার অ্যান্ড পাওয়ার গ্রিড নেটওয়ার্ক, ঢাকেশ্বরী স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্লান্ট, ডেভেলপমেন্ট অব আইসিটি ইন্ট্রা নেটওয়ার্ক ফর ফেজ-২৫, অষ্টম বাংলাদেশ-চায়না ফ্রেন্ডশিপ ব্রিজ। এ ছাড়া যোগাযোগ, প্রযুক্তি, বিদ্যুৎ-জ্বালানি ও শিক্ষা খাতের আরও অনেক প্রকল্পে বিনিয়োগ করছে চীন।
সূত্র জানায়, চীনা ঋণে নেওয়া নয় প্রকল্পের মধ্যে সবশেষ প্রকল্পটি ২০২৬ সালের মাঝামাঝি শেষ হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের বাংলাদেশ সফরকালে ২০ বিলিয়ন ডলার খরচে ২৭টি প্রকল্প নিয়ে ‘বিনিয়োগ ও উৎপাদন সক্ষমতা সহযোগিতা জোরদারকরণ’ সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। এর অংশ হিসেবে এখন পর্যন্ত ২৫টি প্রকল্পে ঋণ দিয়েছে; একই সঙ্গে কিছু অনুদানও দিয়েছে চীন।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের তথ্যানুযায়ী, স্বাধীনতার পর থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন খাতে ঋণ ও অনুদান হিসেবে মোট ১ হাজার ৭৭ কোটি ডলারের বেশি অর্থ বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে চীন। এর মধ্যে প্রায় ৬৯৪ কোটি ডলার ছাড় হয়েছে। অনুদান হিসেবে এসেছে খুব সামান্য। সিংহভাগই ঋণ। এসব ঋণের বেশির ভাগই এসেছে গত দুই দশকে।